in

চলচ্চিত্র নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার

হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার
হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার

হুমায়ূন আহমেদকে কোন একক পরিচয়ে বেঁধে ফেলা সহজ কাজ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন, বছরের পর বছর বই মেলায় সবার আগ্রহের কেন্দ্রে থেকেছেন, নাট্যকার হিসেবে জনপ্রিয়তার এভারেস্ট ছুঁয়েছেন- এতটুকু পরিচয়ই তো যথেষ্ট ছিল একজন মানুষের জন্য। তাই না? কিন্তু মানুষটির নাম হুমায়ূন আহমেদ বলে কথা! হঠাৎ কি মনে করে নিজেই নেমে গিয়েছিলেন নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণে। নিজেই পরিচালনা করেছেন মোট ৮টি চলচ্চিত্র।

হুমায়ূন আহমেদের সিনেমার তালিকায় আছে আগুনের পরশমণি (১৯৯৪), শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯), দুই দুয়ারী (২০০০), চন্দ্রকথা (২০০৩), শ্যামল ছায়া (২০০৫), নয় নম্বর বিপদ সংকেত (২০০৭), আমার আছে জল (২০০৮), ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২)।

হুমায়ূন নিজের অনেক লেখায় চলচ্চিত্র বিষয়ে তার চিন্তা ভাবনার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু খুব সম্ভবত হুমায়ূনের চলচ্চিত্র ভাবনা ভালোভাবে রেকর্ড করতে পেরেছিলেন সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র কর্মী শফিউজ্জামান খান লোদী। ২০০৭ সালে নয় নম্বর বিপদ সংকেত মুক্তি পাওয়ার পরপরই তিনি হুমায়ূনের চমৎকার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। হুমায়ূনের চলচ্চিত্র দর্শন সম্পর্কে আগ্রহী পাঠকদের জন্য সে সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি।

হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার

আগুনের পরশমণি (১৯৯৪)

এই ছবি বানানোর প্রেক্ষাপট… 

হুমায়ূন আহমেদঃ আমি মূলত একজন শিক্ষক ছিলাম দীর্ঘ দিন, তারপর আমি একজন লেখক। তো ছবি বানাবার চিন্তাটা মাথায় আসলো, কারণ সে সময় একটা ছবি আমাদের মোস্তাফিজুর রহমান বানাচ্ছিলেন। নাম হচ্ছে শঙ্খনীল কারাগার। আমার খুব প্রিয় একটা উপন্যাস। এটা থেকে নিয়ে তিনি ছবি বানাচ্ছেন, সরকারি অনুদানে ছবি বানাচ্ছেন। তো আমি উনার সঙ্গে সব সময় থাকি এবং উনিও চান সারাক্ষণ আমি যেন তার সাথে থাকি। ছবি বানানোর নানান প্রক্রিয়াগুলো দেখে দেখে মনে একটা আগ্রহ তৈরি হলো, এটা তো তেমন জটিল কিছু না। আমি একটা ছবি বানাই না কেন?

কিন্তু টাকা পয়সা তো অনেক, প্রচুর টাকা লাগে। এত টাকা দিবে কে? কাজেই আমার ইচ্ছার কথা যখন আমি প্রচার করলাম, তখন আমার বন্ধু আসাদুজ্জামান নূর তিনি এগিয়ে আসলেন। এবং আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের অনেক বড় বড় ধনী ব্যক্তিদের কাছে গেলেন। যদি কোন অর্থ সাহায্য পাওয়া যায়, তা দিয়ে যদি একটি ছবি বানানো যায়। এরা সবাই আমাদেরকে চা-টা খাইয়েছেন, খুবই আদর যত্ন করেছেন কিন্তু কোন টাকা পয়সা দেন নাই। আমি যখন পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেলাম, তখন হঠাৎ করেই আমাদের তথ্য মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা (তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী) একটা সরকারি অনুদান দিলেন আমাকে ছবিটা বানানোর জন্য। ১৭ লাখ বা ১৮ লক্ষ টাকা আমাকে দিলেন ছবিটা করার জন্য। উনি ওই অনুদানটা দেয়ার কারণেই কিন্তু ছবিটা বানানো সম্ভব হলো আমার জন্য।

কাজেই আজকে যদি আপনাদের কেউ বলেন যে, আমি ছবির একজন পরিচালক হতে পেরেছি, which I doubt vey much আমার খুবই সন্দেহ আছে এখনো, তাহলে তার মূলে কিন্তু ওই মানুষটি আছেন। সে সময় তিনি যদি আমাকে ওই টাকাটি না দিতেন, আমার কখনোই ছবির পরিচালক হওয়া হতো না।

এই ছবিতে সব টেলিভিশন তারকাদের সাথে কাজ করার কারণ…  

হুমায়ূন আহমেদঃ ওদের সঙ্গে দীর্ঘ দিন কাজ করেছি। প্রথম ছবি বানাতে যাচ্ছি নানাবিধ ভুল ভ্রান্তি হবে, তারা যেন রাগ না করেন এটাও হয়তো আমার মাথার মধ্যে ছিল। আর তাদের অভিনয়ের ওপর আমার বিশ্বাস ছিল। বাংলাদেশের ফিল্ম তো সেভাবে কখনোই দেখা হয়ে ওঠে নাই। তাই ফিল্মে কারা কারা ভালো কাজ করছে জানতামও না।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রসঙ্গে… 

হুমায়ূন আহমেদঃ আমি খুবই সারপ্রাইজড হয়েছি। যে ছবিটি শ্রেষ্ঠ ছবি, যেটি ৮টি শাখাতে পুরষ্কার নিয়ে নিচ্ছে সেখানে পরিচালক পুরস্কার পাবে না কেন?

(আগুনের পরশমণি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ৮টি শাখায় পুরস্কার পায়। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ কাহিনী ও সংলাপ, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী শাখায় বিপাশা হায়াত, শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক শাখায় সত্য সাহা, শ্রেষ্ঠ শব্দ গ্রাহক শাখায় মোফিজুল হক, শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী শাখায় শিলা আহমেদ, জুরি কমিটির বিচারে হোসনে আরা পুতুল পুরস্কৃত হন)

সত্য সাহার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা… 

হুমায়ূন আহমেদঃ সত্য সাহা খুবই ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ ছিলেন। উনি যখন আমার ছনিতে মিউজিক দিতেন উনি অস্থিরতা চেপে রাখতে পারতেন না। এই এখানে বসছেন, একটু পরে দেখছি ছুটে গিয়ে ওখানে বসছেন, তারপর মাথার চুল টানছেন। তার এই অস্থিরতাটা দেখে আমি খুবই মজা পেতাম।

উনার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে যখন শুনলাম যে তিনি এত দীর্ঘ দিন ধরে সুর করে যাচ্ছেন, তিনি কোন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান নাই। খুবই মনটা খারাপ হলো। আমি খুবই আনন্দিত যে, আমার ছবিতে কাজ করার পর, এই ছবির কারণে উনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রথমবারের মতো পেয়েছেন।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রসঙ্গে… 

হুমায়ূন আহমেদঃ আমাদের সব রকম পুরস্কার, আমাদের একুশে পদক বলেন বা স্বাধীনতা পদক বলেন বা যে কোন পুরষ্কারই বলেন সমস্ত পুরস্কারই বিতর্কিত। আমরা আমাদের পছন্দের মানুষদের পুরস্কার দেয়ার চেষ্টা করি। আমাদের একটা ক্যাটাগরি আছে, সেটা হচ্ছে গীতিকারের। তারা সেখানে শ্রাবণ মেঘের দিনের গীতিকার ক্যাটাগরিতে হঠাৎ করে পুরস্কার দিলেন একজনকে, তার নাম হচ্ছে উকিল মুন্সী। আমি যত দূর জানি গীতিকার হিসেবে তাকেই পুরস্কার দেয়া হবে যিনি এই particular ছবির জন্য গান করেছেন।

উকিল মুন্সী ২০০ বছর আগে মারা গেছেন। এই ছবির সাথে তার কোন সম্পর্ক নাই। আর যদি উকিল মুন্সীকেই গীতিকার হিসেবে পুরস্কার দিতে হয় তাহলে রবীন্দ্রনাথকে না কেন? আমি তো তার গানও ব্যবহার করেছি। নজরুলকে না কেন? আমি তো সেই গানও ব্যবহার করেছি।

কাজেই এই পুরস্কারগুলি খুবই হাস্যকর। আমি এক সময় কিন্তু জাতীয় পুরস্কার কমিটিতে ছিলাম। দীর্ঘ দিন ছিলাম। সেই সময় আমি প্রশ্নগুলো তুলেছি। কোন লাভ হয় নাই।

আবার মাটির ময়না ছবিটি কিন্তু কোন পুরস্কার পায় নাই। কেন পায় নাই? এই ছবিটি দেশের বাইরে পুরস্কার পেয়েছে, দেশে বাইরে প্রশংসিত হয়েছে। আমি নিজে মুগ্ধ হয়ে ছবিটি দেখেছি কিন্তু এই ছবি একটা ক্যাটাগরিতেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার যদি না পায় তাহলে এই চলচ্চিত্র পুরস্কারের তো কোন credibility নাই। আমি ঠিক করেছি আমার কোন ছবি যেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে না যায় কখনো।

শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯)

বছর বিরতি… 

হুমায়ূন আহমেদঃ ৫ বছর বিরতি দিলাম। কারণ হচ্ছে এই ৫ বছরে টাকা পয়সা যা কামালাম, আমার কাছে মনে হলো দ্বিতীয় ছবি প্রথমটার চেয়ে ভালো বানাতে পারবো, এখন ছবির উপরে আমার কিছুটা দখল এসেছে বলে আমার ধারণা হলো। ধারনাটা সঠিক ছিল না যদিও। যাইহোক, শ্রাবণ মেঘের দিন আমার খুবই পছন্দের একটি উপন্যাস। ভাটি অঞ্চলের কাহিনী। সে জন্যই অনেক দিন পর মনে হলো, আচ্ছা ঠিক আছে আরেকটি ছবি বানাই। কিছু টাকা পয়সা জমে গেছে, টাকাটা খরচ করি।

নিজের ছবিতে বৃষ্টি, গান জোছনা প্রসঙ্গে… 

হুমায়ূন আহমেদঃ এই তিনটির ভেতরে একটা গান। গানের কথাগুলো আমার লেখা। কিন্তু সুর আমার করা না। কাজেই ওই গানের সুরের যে কৃতিত্ব সেটা হচ্ছে সুরকারের। এবং একটি গান আকাশে ভেসে ওঠে প্রথমোট সুরকারের কারণে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে যিনি গানটা করছেন তার কারণে, তৃতীয় ব্যক্তি থাকেন গীতিকার হিসেবে, অনেক পেছনে। যে কারণে আমি গান লেখার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী না।

বৃষ্টি ও জোছনা- প্রকৃতির এই দুটি বিষয়ের উপর আমার প্রবল একটা আকর্ষণ আছে। আমি দুটোই সেলুলয়েডে ধরার চেষ্টা করেছি। জোছনা কখনোই ধরতে পারি নাই। বহু চেষ্টা করেছি। যা বলেছেন ক্যামেরাম্যানরা আমি তাই শুনেছি, যা করতে বলেছেন তাই করেছি তারপরেও কখনোই জোছনা সে অর্থে ধরা যায়নি।

বৃষ্টি ধরার ব্যাপারে আপনি বলছিলেন শ্রাবণ মেঘের দিনে খুব ভালোভাবে বৃষ্টি ধরতে পেরেছি। ধরতে পারিনি আসলে। বৃষ্টি সবচেয়ে ভালোভাবে ধরতে পেরেছি এইবার। আমার বহু সময় লেগেছে বৃষ্টিটাকে আয়ত্ত করতে। এবার নয় নম্বর নিপদ সংকেতে বৃষ্টিটাকে আমি ঠিকভাবে ধরতে পেরেছি।

দুই দুয়ারী (২০০০)

এই ছবির প্রেক্ষাপট… 

হুমায়ূন আহমেদঃ রহস্যময়তার প্রতি আমার এক ধরণের আকর্ষণ খুব ছোটবেলা থেকেই। আমার বেশিরভাগ লেখালেখিতে, লেখালেখির একটা বড় অংশজুড়েই আছে রহস্যময়তা। একটা রহস্যময় চরিত্র আমি নিয়ে আসার চেস্থা করেছি দুই দুয়ারীতে। সেই চরিত্রের জন্য প্রথমবারের মতো আমি ফিল্মে গিয়েছি। ফিল্মের সে সময়কার সবচেয়ে খ্যাতিমান তারকা রিয়াজকে নিলাম। একটু ভয়ে ছিলাম যে এরা কি আমার সাথে মিলাতে পারবে।

শুরুতেই ধাক্কার মতো খেলাম যখন বলা হলো রিয়াজকে প্রম্পট করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা বন্ধ করলাম এবং রিয়াজকে ডেকে বললাম, আমি জীবনে কখনো কাউকে দিয়ে  প্রম্পট করায় ফিল্ম বানাবো না। তুমি যদি মনে করো প্রম্পটিং ছাড়া তুমি কাজ করতে পারবে তাহলে কাজ করো, otherwise তুমি বাদ। রিয়াজ বললো যে, তার কোন সমস্যা হবে না। সময় দিলেই আমি সমস্ত সংলাপ মুখস্ত করে নিবো। প্রম্পট ছাড়াই অভিনয় করবো। তাকে দিয়ে প্রথম বিনা প্রম্পটে কাজ করালাম দুই দুয়ারীতে।

চন্দ্রকথা (২০০৩)

চন্দ্রকথা অয়োময় এর মিল প্রসঙ্গে… 

হুমায়ূন আহমেদঃ আসাদুজ্জামান নূর ছাড়া অন্য কোন মিল আছে বলে আমি নিজে মনে করি না। কেননা আমি নিজের কাজ নিজে রিপিট করতে পছন্দ করি না।  তবে প্রাচীন জমিদার ছলেন এক সময় প্রচুর ক্ষমতাবান। েদের character-এ এক ধরণের মিল আছে। একটা মিল আসলে থেকেই যায়। ওই মিলটি থেকে বের করে আনাও কঠিন ব্যাপার।

চন্দ্রকথায় এসে উপলব্ধি… 

হুমায়ূন আহমেদঃ আমার উপলব্ধির দিক থেকে মনে হইলো যে, আমি ভেবেছিলাম দুই-তিনটা ছবি বানানো শেষ হইলেই আমি ছবি বানানোটা মোটামুটি শিখে যাবো। আমার উপলব্ধি হলো, না ছবি বানানো শিখতে পারি নাই। আরও অনেক সময় লাগবে।

শ্যামল ছায়া (২০০৪)

শ্যামল ছায়া, মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রদর্শন প্রসঙ্গে… 

হুমায়ূন আহমেদঃ শ্যামল ছায়া ছবিটিতে আমি আমার একজন খুব পছন্দের ক্যামেরাম্যান ফ্রান্স থেকে নিয়ে এসেছিলাম। উনাকে দিয়ে কাজ করিয়েছি, আনোয়ার হোসেন। পুরো ছবিটি একটি নৌকার উপর। সমস্যা হয়ে গেছে কি, গরমের সময় নৌকার উপর নদী থেকে যে গরম ভাবটা বেরিয়ে আসে এটি যারা অভিনয় করেছে তাদের প্রত্যেককে, আমাকে সহ এমন ব্যতিব্যস্ত করে রাখে যে, কোন ডিটেলের দিকে যে মনোযোগটা দেয়া উচিৎ ছিল সেটা আসলে সেভাবে দেয়া হয় নি।

টেকনিক্যাল সাপোর্ট যেটি এই ছবির জন্য দরকার ছিল, যে অর্থনৈতিক সাপোর্ট এই ছবির জন্য দরকার ছিল সেটি সেভাবে পাই নাই। এটি চ্যানেল আই-এর ছবি। চ্যানেল আই এই ছবিটির দিকে তত মমতার সঙ্গে টাকায় নাই। তারা ধরেই নিয়েছিল যে মুক্তিযুদ্ধে ছবি লোকজন দেখবে টেখবে না হয়তোবা। এই ছবিটি আমি যদি দ্বিতীয়বার বানাই অনেক অনেক ভালো ছবি বানাবো। এই ছবিটি ফরেন ফিল্ম শাখায় অস্কারে গেছে, কোন পুরস্কার পায় নাই। কিন্তু আমি নিশ্চিত এই ছবিটি যদি আমি আবার এখন বানাই তাহলে এটি পুরস্কার পাবে।

আরও পড়ুন– ১০ লক্ষ টাকায় শুরু হুমায়ূন আহমেদ অন্যপ্রকাশের পথ চলা

দূরত্ব (২০০৪)

এই ছবিটি পরিচালনা করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। এই ছবি প্রসঙ্গে… 

হুমায়ূন আহমেদঃ আমি যেহেতু একজন ঔপন্যাসিক, গল্পগুলো আমার লেখা। আমি একভাবে কল্পনা করে রাখি। আমি যখন ছবিটা বানাই কোন উপন্যাস দিয়ে তখন কিন্তু আমি আমার কল্পনার কাছাকাছি থাকি। অন্য কেউ যখন বানান তারা তো আমার কল্পনার কাছাকাছি নাই। কাজেই তারা যতই ভালো বানান, আমার কাছে ভালো লাগে না। মোরশেদুল ইসলাম খুবই ভালো পরিচালক। তিনি খুবই যত্নের সঙ্গে ছবিটি বানিয়েছেন। এই সমস্যাটি আমার সব ক্ষেত্রেই হয়। সেজন্য ঠিক করেছি বাইরে আর কাউকে ছবি বানাতে দিবো না। যদি দেইও চিত্রনাট্য আমি নিজে করে দেবো। যেমন নন্দিত নরকে যখন করা হয়েছে সেই চিত্রনাট্য আমি নিজে করে দিয়েছি। দারুচিনি দ্বীপের চিত্রনাট্যও আমি করে দিয়েছি।

নন্দিত নরকে (২০০৬)

এই ছবিটি পরিচালনা করেছেন বেলাল আহমেদ। এই ছবি প্রসঙ্গে

হুমায়ূন আহমেদঃ বেলাল কিন্তু এই ছবির পিছনে দীর্ঘ দিন লেগে ছিল। যখন এই উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে নিতে চেয়েছিলেন আমাদের পরিচালক আমজাদ হোসেন তখন থেকে কিন্তু বেলাল তার সঙ্গে যুক্ত। সে একদিন এসে আমাকে তার অন্তরের গভীর আবেগের কথা জানালো। দীর্ঘ দিন থেকে আমি তো লালন করেছি ছবিটা আমি বানাবো। কিন্তু তার আবেগটি আমার কাছে শুদ্ধ মনে হয়েছে। এবং এই ছবি সঙ্গে যুক্ত মাহফুজুর রহমান খান, তাকে আমি খুবই পছন্দ করি। এই দুটি মিলিয়ে ঠিক করলাম তাদেরকে দিবো। চিত্রনাট্য আমি তৈরি করে দিয়েছি এবং তারা চিত্রনাট্যটি নিয়ে খুবই meticulously ফলো করেছে বলে আমার ধারণা। চিত্রনাট্যের বাইরে তারা যায় নি।

নিরন্তর (২০০৬)

এই ছবিটি পরিচালনা করেছেন আবু সাইয়ীদ। এই ছবি প্রসঙ্গে

হুমায়ূন আহমেদঃ নিরন্তর হচ্ছে আমার যেকয়টি পছন্দের উপন্যাস আছে তার মধ্যে একটি। উপন্যাসটির নাম হচ্ছে ‘জনম জনম’। চিত্রনাট্য উনার (আবু সাইয়ীদ)। হয়েছে কি আমার ছবিটি দেখার পর মনে হলো উনি আমার কাহিনীটা ধরতে পারেন নি। জনম জনমে মধ্যবিত্ত ঘরের একটি মেয়ে তার নিজের জীবন ধারণের জন্য, তার পরিবারকে রক্ষা করার জন্য নিশিকন্যা হিসেবে বাইরে যাওয়া শুরু করে। এই বইয়ে মেয়েটির ট্রাজেডি যেটা আছে, ফিল্ম দেখতে দিয়ে দেখি যে সেই ট্রাজেডিটা নাই। মনে হচ্ছে এই মেয়ে তার কাজটাকে খুবই আগ্রহের সাথে উপভোগ করছে। মানে আনন্দ পাচ্ছে কাজটি করে। এটি আমার জন্য খুবই শকিং একটি ব্যাপার ছিল।

নয় নম্বর বিপদ সংকেত (২০০৭)

একটি অর্থহীন ছবি“… 

হুমায়ূন আহমেদঃ এটা একধরণের রসিকতা বলা যেতে পারে। আমি এটা যেহেতু হাসির ছবি বানিয়েছি আমি মনে করেছি আমাদের যে সমস্ত অর্থপূর্ণ কর্মকান্ড আছে সেগুলতে আনন্দ নাই। সে সমস্ত কাজেই আমরা আনন্দ পাই, যেগুলো কাজে অর্থ কম। সে হিসেবে একটি আনন্দময় কাজকে আমি একটি অর্থহীন ছবি বলেছি।

নাম নিয়ে মাঝে মাঝে আমি কিছু experiment করি। একবার একটা সিরিয়ালের নাম দিয়েছিলাম বহুব্রীহি। কোন অর্থই খুঁজে পাচ্ছিল না লোকজন। কাজেই এ সকল ছোটখাটো রসিকতা আমি করে থাকি। এটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার কোনই কারণ নাই।

এই ছবির বৈশিষ্ট্য

হুমায়ূন আহমেদঃ এই পুরো ছবিটা আমি নুহাশ পল্লীতে করেছি। আমি আসলে দেখাতে চেয়েছি যে আমরা ছবির শুটিং এর জন্য চমৎকার চমৎকার জায়গায় যাই। আমরা সুইজারল্যান্ডে যাই, আমরা জার্জিলিং যাই। এত দূরে যাওয়ার তো দরকার নাই। সৌন্দর্য তো আমাদের চারপাশেই আছে। ওইটা দেখানোর জন্যই আমি মূলত পুরো ছবিটি নুহাশ পল্লীতে নেয়ার একটা চেষ্টা চালিয়েছি এবং চেষ্টাটা সফলও হয়েছে।

এই ছবির অভিনেতাঅভিনেত্রীদের প্রসঙ্গে… 

হুমায়ূন আহমেদঃ আমি কেন, সব পরিচালকই যখন একটা OK শট নেন, সেই শটটা হচ্ছে বেস্ট পসিবল শট। যে দূর্বল অভিনেতা, তার কোন দূর্বল অভিনয় কিন্তু আমাদের ছবিতে আমরা রাখি না কখনো। কাজেই এখানে আলাদা করে বলা যে, ওমুক খুব ভালো করেছে, কাছাকাছি গিয়েছে (আমার কল্পনার), সে ভালো করতে পারে নাই, বেশি কাছাকাছি যেতে পারে নাই- এটা ঠিক হবে না। আমার ধারণা সবাই অসম্ভব ভালো অভিনয় করেছে।

নতুন মুখ নিয়ে কাজ করার রিস্ক প্রসঙ্গে

হুমায়ূন আহমেদঃ না, এটা আমার কাছে রিস্কি মনে হয়নি, কেননা আমার কাছে মনে হয়েছে যে, একজন পরিচালক যদি যেকোন মানুষের থেকে অভিনয় আদায় করতে না পারেন তাহলে তার পরিচালনায় দক্ষতাটা কোথায়?

যখন এমন সমস্ত শিল্পীদের নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, যারা জীবনের প্রথম বারের মতো স্ক্রীণে আসছে, যারা জীবনে প্রথমবারের মতো অভিনয় করছে, তখন চ্যালেঞ্জের একটা আনন্দ থাকে না? ওই আনন্দটিও কাজ করেছে। আর আমার কাছে সব সময়ই মনে হয়েছে যেকোন মানুষকে দিয়ে অভিনয় আদায় করে নেয়া সম্ভব, আমাকে বাদ দিয়ে। আমাকে দিয়ে অভিনয় আদায় করা সম্ভব না।

নয় নম্বর বিপদ সংকেতের পর হুমায়ূন আহমেদ আরও দুটি ছবি পরিচালনা করেন। আমার আছে জল (২০০৮) এবং ঘেটু পুত্র কমলা (২০১২)। ঘেটু পুত্র কমলা হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত শেষ ছবি।