আলো ও ক্লোরোফিল ছাড়াও সালোকসংশ্লেষণ আরও কতগুলো প্রভাবক দিয়ে প্রভাবিত হয়। প্রভাবকগুলো কিছু বাহ্যিক এবং কিছু অভ্যন্তরীণ। অন্যভাবে বলা যায়, সালোকসংশ্লেষণের প্রভাবক দুই ধরণের। বাহ্যিক প্রভাবক, অভ্যন্তরীণ প্রভাবক। প্রভাবকের উপস্থিতি, অনুপস্থিতি, পরিমাণের কম-বেশি সালোকসংশ্লেষণের পরিমাণও কম-বেশি করে থাকে। সালোকসংশ্লেষণের প্রভাবকগুলো নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হল।
সালোকসংশ্লেষণের প্রভাবক
সালোকসংশ্লেষণের বাহ্যিক প্রভাবক
আলোঃ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় আলোর গুরুত্ব অপরিসীম। পানি এবং C02 থেকে শর্করা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির উৎস আলো। সূর্যালোক ক্লোরোফিল সৃষ্টিতে অংশ গ্রহণ করে। সূর্যালোকের প্রভাবেই পত্ররন্ধ্র উন্মুক্ত হয়, C02 পাতার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে এবং খাদ্য প্রস্তুতকরণে অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু পাতায় যেটুকু আলো পড়ে, তার অতি সামান্য অংশই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। আবার আলোক বর্ণালির লাল, নীল, কমলা এবং বেগুনি অংশটুকুতেই সালোকসংশ্লেষণ ভালো হয়। সবুজ কিংবা হলুদ আলোতে সালোকসংশ্লেষণ ভালো হয় না। একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত আলোর পরিমাণ বাড়লে সালোকসংশ্লেষণের হারও বেড়ে যায়। কিন্তু আলোর পরিমাণ অত্যাধিক বেড়ে গেলে পাতার ভিতরকার এনজাইম নষ্ট হয়ে যায়, ক্লোরোফিল উৎপাদন কম হয়। ফলে সালোকসংশ্লেষণের হারও কমে যায়। সাধারণত 400 ন্যানোমিটার থেকে 480 ন্যানোমিটার এবং 680 ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট আলোতে সালোকসংশ্লেষণ সবচেয়ে ভালো হয়।
কার্বন ডাই-অক্সাইডঃ কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়া সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চলতে পারে না। এ প্রক্রিয়ায় যে খাদ্য প্রস্তুত হয় তা কার্বন ডাই-অক্সাইড বিজারণের ফলেই হয়ে থাকে। বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ০.০০৩ ভাগ, কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ শতকরা এক ভাগ পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করতে পারে। তাই বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সালোকসংশ্লেষণের পরিমাণও বেড়ে যায়। তবে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ খুব বেশি মাত্রায় বেড়ে গেলে পাতার মেসোফিল টিস্যুর কোষের অম্লত্বও বেড়ে যায় এবং পত্ররন্ধ্র বন্ধ হয়ে সালোকসংশ্লেষণের হার কমে যায়।
তাপমাত্রাঃ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় তাপমাত্রা বিশেষ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। সাধারণত অতি নিম্ন তাপমাত্রা (০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর কাছাকাছি) এবং অতি উচ্চ তাপমাত্রায় (৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে) এ প্রক্রিয়া চলতে পারে না। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার জন্য পরিমিত তাপমাত্রা হলো ২২ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত। তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের কম বা ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি হলে সালোকসংশ্লেষণের হার কমে যায়।
পানিঃ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শর্করা তৈরির উদ্দেশ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে বিজারণের জন্য প্রয়োজনীয় হাইড্রোজেন আয়ন পানি থেকে আসে। পানির ঘাটতি হলে পত্ররন্ধ্রের রক্ষীকোষেও স্ফীতি হারিয়ে রন্ধ্র বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইডের অনুপ্রবেশ বাধাগ্রস্থ হয়। অতিরিক্ত পানি ঘাটতির ফলে এনজাইমের সক্রিয়তা বিনষ্ট হয়ে সালোকসংশ্লেষণ বাধাগ্রস্থ হতে পারে।
অক্সিজেনঃ বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্ব বেড়ে গেলে সালোকসংশ্লেষণের হার কমে যায় আর অক্সিজেনের ঘনত্ব কমে গেলে সালোকসংশ্লেষণের হার বেড়ে যায়। তবে অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে সালোকসংশ্লেষণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকে।
খনিজ পদার্থঃ ক্লোরোফিলের প্রধান উপকরণ হচ্ছে নাইট্রোজেন এবং ম্যাগনেসিয়াম। লোহার অনুপস্থিতিতে পাতা ক্লোরোফিল সংশ্লেষ করতে পারে না। ফলে পাতা হলুদ হয়ে যায়। কাজেই মাটিতে এসব খনিজের অভাব হলে সালোকসংশ্লেষণের হার কমে যায়।
রাসায়নিক পদার্থঃ বাতাসে ক্লোরোফরম, হাইড্রোজেন সালফাইড, মিথেন বা কোনো বিষাক্ত গ্যাস থাকলে সালোকসংশ্লেষণের ব্যাঘাত ঘটে বা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।
সালোকসংশ্লেষণের অভ্যন্তরীণ প্রভাবক
ক্লোরোফিলঃ পাতার ক্লোরোফিলের পরিমাণের সাথে সালোকসংশ্লেষণের হারের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। কারণ একমাত্র ক্লোরোফিলই আলোকশক্তি গ্রহণ করতে পারে। পুরাতন ক্লোরোপ্লাস্ট নষ্ট হয়ে যায় এবং তখন নতুন ক্লোরোপ্লাস্ট সংশ্লেষিত হয়। নতুন ক্লোরোপ্লাস্ট এবং ক্লোরোপ্লাস্টের উপাদান সৃষ্টির হারের উপর সালোকসংশ্লেষণের হার নির্ভরশীল। সালোকসংশ্লেষণ ক্ষমতা রক্ষা করার জন্য ক্লোরোপ্লাস্টের বিভিন্ন উপাদান দ্রুত এবং প্রচুর পরিমাণে পুনর্গঠিত হওয়া প্রয়োজন। তবে কোষে খুব বেশি পরিমাণ ক্লোরোফিল থাকলে এনজাইমের অভাব দেখা দেয় এবং সালোকসংশ্লেষণ কমে যায়।
পাতার বয়স ও সংখ্যাঃ একেবারে কচি পাতা এবং একেবারে বয়স্ক পাতায় ক্লোরোফিলের পরিমাণ কম থাকে বলে সালোকসংশ্লেষণ কম হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্লোরোপ্লাস্টের সংখ্যাও বেশি হয়। মধ্যবয়সী পাতায় সবচেয়ে বেশি সালোকসংশ্লেষণ ঘটে। পাতার সংখ্যা বেশি হলে সালোকসংশ্লেষণ বেশি হয়।
শর্করার পরিমাণঃ সালোকসংশ্লেষণ চলাকালীন শর্করার পরিবহণ কম হলে তা সেখানে জমা হয়ে থাকে। বিকেলে পাতায় বেশি শর্করা জমা হয় বলে সালোকসংশ্লেষণের গতি মন্থর হয়।
পটাশিয়ামঃ পটাশিয়ামের অভাবে সালোকসংশ্লেষণের পরিমাণ বেশ কমে যেতে দেখা যায়। কারণ সম্ভবত সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় পটাশিয়াম অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
এনজাইমঃ সালোকসংশ্লেষণের জন্য বিভিন্ন ধরণের এনজাইমের প্রয়োজন হয়।
সালোকসংশ্লেষণের প্রভাবকগুলোর উপর নির্ভর সালোকসংশ্লেষণের পরিমাণ।
আরও পড়ুন- সালোকসংশ্লেষণ কি? সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার গুরুত্ব
আরও পড়ুন- সালোকসংশ্লেষণে ক্লোরোফিলের ভূমিকা ব্যাখা কর | সালোকসংশ্লেষণে আলোর ভূমিকা কি?