যা যা শিখবো- সমুদ্রস্রোত কাকে বলে? সমুদ্রস্রোতের কারণ ও ফলাফল। সমুদ্রস্রোতের প্রধান কারণ কি? সমুদ্রস্রোত কয়ভাগে বিভক্ত। সমুদ্রস্রোতের প্রভাব
সমুদ্রস্রোত কাকে বলে?
সমুদ্রস্রোতের প্রধান কারণ বায়ুপ্রবাহ। বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রের উপরিভাগের পানির সঙ্গে ঘর্ষণ তৈরি করে এবং ঘর্ষণের জন্য পানিতে ঘূর্ণন তৈরি হয়। সমুদ্রের পানি একটি নির্দিষ্ট গতিপথ অনুসরণ করে চলাচল করে, একে সমুদেস্রোত বলে৷
উষ্ণতার ভারসাম্য অনুসারে সমুদেস্রোতকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ
১. উষ্ণ স্রোত ও
২. শীতল স্রোত।
উষ্ণ স্রোতঃ নিরক্ষীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় জলরাশি হালকা হয় ও হালকা জলরাশি সমুদ্রের উপরিভাগ দিয়ে পৃষ্ঠ প্রবাহরূপে শীতল মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। এরূপ স্রোতকে উষ্ণ স্রোত বলে।
শীতল স্রোতঃ মেরু অঞ্চলের শীতল ও ভারী জলরাশি জলের নিচের অংশ দিয়ে অন্তঃপ্রবাহরূপে নিরক্ষীয় উষ্ণমন্ডলের দিকে প্রবাহিত হয়। এরূপ স্রোতকে শীতল স্রোত বলে৷
সমুদ্রস্রোতের কারণ
সমুদ্রস্রোতের কারণ সমূহ নিম্নে উপস্থাপন করা হলোঃ
নিয়ত বায়ুপ্রবাহঃ নিয়ত বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির প্রধান কারণ। এসব বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রস্রোতের দিক ও গতি নিয়ন্ত্রণ করে। অয়ন বায়ু, পশ্চিমা বায়ু ও মেরু বায়ুর প্রবাহ অনুযায়ী প্রধান সমুদ্রস্রোতগুলোর সৃষ্টি হয়৷
আহ্নিক গতিঃ পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে ফেরেলের সূত্র অনুসারে বায়ুপ্রবাহের মত সমুদ্রজল ও উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায়। ফলে, সমুদ্র স্রোতের সৃষ্টি হয়।
সমুদ্রজলের তাপমাত্রার পার্থক্যঃ নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণমন্ডলের সমুদ্রের জল বেশি উষ্ণ বলে তা জলের উপরের অংশ দিয়ে পৃষ্ঠপ্রবাহ বা বহিঃস্রোতরূপে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে মেরু অঞ্চল থেকে শীতল ও ভারী জলরাশি জলের নিচের অংশ দিয়ে অন্তঃপ্রবাহ বা অন্তঃস্রোতরূপে নিরক্ষীয় উষ্ণমন্ডলের দিকে প্রবাহিত হয়। এভাবে উষ্ণ ও শীতল সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়।
মেরু অঞ্চলের সমুদ্রের বরফের গলনঃ মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে বরফ কিছু পরিমাণ গলে গেলে জলরাশি স্ফীত হয় ও সমুদ্রজলের লবণাক্ততা হ্রাস পায়৷ এর ফলে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়৷
সমুদ্রের গভীরতার তারতম্যঃ সমুদ্রের গভীরতার তারতম্য অনুসারে তাপমাত্রার পার্থক্য হয়। অগভীর সমুদ্রের জল দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উপরে উঠে। তখন গভীরততর অংশে শীতল জল নিচে নেমে আসে। এজন্য উর্ধ্ধগামী ও নিম্নগামী সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়। সমুদ্রের পৃষ্ঠের গতি সবচেয়ে বেশি। সমুদ্রের ১০০ মিটার নিচ থেকে গতি কমতে থাকে৷
সমুদ্রজলের লবণাক্ততার পার্থক্যঃ সমুদ্রজলে লবণের পরিমাণ সর্বত্র সমান নয়। অধিক লবণাক্ত জল বেশি ভারি বলে তার ঘনত্বও বেশি হয়ব। বেশি ঘনত্বের জল কম ঘনত্বের দিকে নিম্ন প্রবাহরূপে প্রবাহিত হয় ও সমুদ্রস্রোতের স্রোতের সৃষ্টি করে৷
ভূখণ্ডের অবস্থানঃ সমুদ্রস্রোতের প্রবাহপথে কোন মহাদেশ, দ্বীপ প্রভৃতি ভূখণ্ড অবস্থান করলে সমুদ্রস্রোত তাতে বাধা পেয়ে দিক ও গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। অনেক সময় এর প্রভাবে সমুদ্রস্রোত একাধিক শাখায় বিভক্ত হয়।
সমুদ্রস্রোতের প্রভাবঃ নানাবিধ কারণে সমুদ্রস্রোতের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে এলাকার উপর দিয়ে সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয় সেখানে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার জলবায়ু ও বাণিজ্যের উপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব অত্যধিক।
উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের প্রভাবঃ উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে কোন অঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়৷ তাই শীতল অঞ্চলের উপর দিয়ে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হলে শীতকালেও বরফ জমতে পারেনা৷ বন্দরগুলো সারাবছর ব্যবহার করা যায়। যেমনঃ উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের প্রভাবে নরওয়ে ও ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম উপকূল শীতকালে বরফমুক্ত থাকে, কিন্তু একই অক্ষাংশে অবস্থিত কানাডার পূর্ব উপকূলে বরফাচ্ছন্ন দেখা যায়।
শীতল সমুদ্রস্রোতের প্রভাব
শীতল সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে কোন অঞ্চলের শীতলতা বৃদ্ধি পায়। যেমনঃ শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের প্রভাবে কানাডার পূর্ব উপকূলে ল্যাব্রাডর দ্বীপপুঞ্জের নিকটবর্তী অঞ্চল সারাবছর বরফাচ্ছন্ন থাকে। একই কারণে শীতল কামচাটকা স্রোতের প্রভাবে এশিয়ায় পূর্ব উপকূলে কামচাটকা উপকূলের শীতলতা বৃদ্ধি পায়।
পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর প্রভাবঃ সমুদ্রস্রোতের অনুকূলে নৌক্স, জাহাজ প্রভৃতি চলাচলের সুবিধা হয়। তবে শীতল সমুদ্রস্রোত অপেক্ষা উষ্ণ সমুদ্রস্রোতে জাহাজ ও নৌচলাচলের সুবিধা বেশি। উত্তর আটলান্টিক সমুদ্রস্রোতের অনুকূলে পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক জাহাজ যাতায়াত করে। শীতল স্রোতের গতিপথে তীব্র শীত ও হিমশৈলের জন্য জাহাজ চলাচলের অসুবিধা দেখা যায়।
আবহাওয়ার উপর প্রভাবঃ উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে বায়ুপ্রবাহ প্রচুর পরিমানে জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করে। এই উষ্ণ বায়ুর প্রভাবে উপকূল অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। যেমনঃ উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম উপকূলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। অপরদিকে, শীতল সমুদ্রস্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু শুষ্ক বলে বৃষ্টিপাত ঘটায়না। যেমনঃ কখনো শীতল মরুভূমির সৃষ্টি করে৷ দক্ষিণ আমেরিকার আতাকামা মরুভূমি শীতল পেরু স্রোতের দ্বারা প্রবাহিত হয়।
কুয়াশা ও ঝড়-ঝঞ্ঝা সৃষ্টিঃ উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলন অঞ্চলে অল্প স্থানব্যাপী উষ্ণতার ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। এই অঞ্চলে ঘন কুয়াশা ও ঘূর্ণিবাতের সৃষ্টির ফলে প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝার সৃষ্টি হয়। জাহাজ ও বিমান চলাচলের অসুবিধা দেখা দেয়। যেমনঃ উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে শীতল ল্যাব্রাডর স্রোত ও উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের মিলনের ফলে এবং এশিয়ার উপকূলে শীতল কামচাটকা স্রোত ও বেরিং স্রোত এবং উষ্ণ জাপান স্রোতের মিলনের ফলে এরূপ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়।
সমুদ্রে অগভীর মগ্নচড়ার সৃষ্টিঃ উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলন স্থলে শীতল স্রোতের সঙ্গে বাহিত বড় বড় হিমশৈল উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে গলে যায়। ফলে হিমশৈলের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি সমুদ্রতলে সঞ্চিত হয় এবং একসময় মগ্নচড়ার সৃষ্টি করে। নিউফাউল্যান্ডের উপকুলে গ্র্যান্ড ব্যাঙ্ক, সেবল ব্যাঙ্ক, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপকূলে ডর্গাস ব্যাঙ্ক এগুলো মগ্নচড়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
মৎস্য ব্যবসার সুবিধাঃ অগভীর মগ্নচড়াগুলোতে প্রচুর পরিমানে প্ল্যাংটন (একপ্রকার অতিক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণী) জন্মায় ও বংশবৃদ্ধি করে। এই প্ল্যাংটন মাছের অতি প্রিয় খাদ্য। এই মগ্নচড়া গুলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মাছ আহরণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নিউফাউল্যান্ডের উপকূল ও জাপান উপকূলে পৃথিবীর অধিকাংশ মাছ ধরা হয়৷
হিমশৈলের আঘাতে বিপদঃ শীতল সমুদ্রস্রোতের সঙ্গে যেসকল হিমশৈল ভেসে আসে সেগুলোর কারণে জাহাজ চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় হিমশৈলের সাথে ধাক্কা লেগে জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে। যেমনঃ যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজ ১৯১২ সালে প্রথম যাত্রাতেই হিমশৈলের সাথে ধাক্কা লেগে সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন- জলবায়ুর নিয়ামক কাকে বলে? জলবায়ুর নিয়ামকগুলো কি কি?
আরও পড়ুন- নগরায়ন কাকে বলে? নগরায়নের প্রভাব ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে সৃষ্ট সমস্যা