ভাবসম্প্রসারণ: সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই
মূলভাবঃ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। – কবি চণ্ডীদাসের লেখা এই লাইনটি মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী। এ পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা কত রকমের প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু কথায় আছে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আমাদের একটাই পরিচয় আমরা সকলে মানুষ। মানুষের মাঝে থাকবে না কোন ভেদাভেদ, থাকবে না কোন বৈষম্য।
সম্প্রসারিত ভাবঃ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছে ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা দিয়ে। মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি তাকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে প্রতীয়মান করেছে৷ মানুষের মাঝে সৃষ্টিকর্তা কোন ভেদাভেদ না রাখলেও কিছু মানুষ তাদের মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিয়ে বারংবার জড়িয়েছে সংঘাতে। নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করেছে বৈষম্য, ভেদাভেদ, ঘৃণা। তারা নিজের অহংকারের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ভালো-মন্দ বিচারের বোধ বুদ্ধিকে আবদ্ধ করে রাখে অজানা কোন অন্ধকার কারাগারে। তারা এটা ভুলে যায় সংঘাত কখনো সুফল বয়ে আনতে পারেনা। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যে বিষাক্ত ধোঁয়ার ছাপ আমাদের মনে রেখে যায় সে ছাপ ক্ষত হয়ে দীর্ঘদিন আমাদের হিংসার অনলে পোড়ায়৷
এই সংঘাতের মাঝেও একদল শান্তিপ্রিয় মানুষ আবার পৃথিবীকে মনে করিয়ে দেয় সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। মানুষের সৃষ্টি পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, সংঘাত সৃষ্টির জন্য নয়। তারা তাদের সুচিন্তা ভাবনার মাধ্যমে পৃথিবীকে জানান দেয় শান্তির বার্তা। সৃষ্টিকর্তা হাজারো রকম সম্পদে প্রকৃতিকে পরিপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছে। আর মানুষ তার মেধা ও সৃষ্টিশীলতার সাহায্যে সে সম্পদ প্রকৃতি থেকে আহরণ করে ব্যবহার করছে পৃথিবীকে ও নিজেদের জীবনকে সুন্দর করে সাজানোর তরে৷ প্রাচীনকালের গুহা খনন থেকে শুরু করে বর্তমানের অট্টালিকা, অন্ধকার যুগ থেকে আজকের সভ্য সমাজ সবই সম্ভব হয়েছে মানুষের মেধা-মননের কারণে। সাগর থেকে শুরু করে মহাকাশ -সবকিছুতেই মানুষ এঁকেছে তার সাফল্যের পদচিহ্ন। কিন্ত, পৃথিবীতে তখনই অন্ধকার নেমে আসে যখন মানুষ ভুলে যায় ভালো থাকার মানে শুধু নিজেকে ভালো রাখা নয়, ভালো থাকার মানে সকলের বিপদে নিজের সাধ্যমতো সাহায্য করা।
যদি প্রতিবেশীর হাঁড়ি দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা আছে জেনেও তুমি গ্রোগাসে হরেক রকম পদ দিয়ে নিজের ক্ষুধা নিবারন করতে ব্যস্ত থাকো, যদি ক্ষণিকের জন্য হলেও সে ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর জন্য তোমার প্রাণ কেঁদে না উঠে তবে তুমি দেখতেই কেবল মানুষের মতো, সৃষ্টির সেরা জীবের সংজ্ঞা তোমার জন্য প্রযোজ্য নয়৷ কথায় আছে, “সকলের তবে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে”। যে মানুষ অন্যের বিপদে এগিয়ে আসে, অন্যের দুঃখে যার প্রাণ কেঁদে উঠে সে হচ্ছে সত্যিকারের শেষ্ঠ জীব৷
এখনো দেশে দেশে সংঘাত বিদ্যমান। আবার এই সংঘাত নিরসনে এগিয়ে আসে বহুরাষ্ট্র। আর এ এগিয়ে আসা মনে করিয়ে দেয় আমরা যে রাষ্ট্রের, যে বর্ণেরই হই না কেন আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা মানুষ। এডওয়ার্ড জন বলেছেন, “মৃত্যুর পরে যার জন্য মানুষ মানুষের হৃদয়ে অম্লান হয়ে থাকে সে হচ্ছে তার ব্যবহার “। মানুষ হচ্ছে আয়না আর তার ব্যবহার হচ্ছে তার নিজের প্রতিবিম্ব। একজন মানুষের ব্যবহার দেখে বোঝা যায় তার মনুষ্যত্ব কতখানি। মানুষের চিন্ত-ভাবনা, মেধা মননের পরিচয় পাওয়া যায় তার ব্যবহারের মাধ্যমে৷
কোন মানুষ পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকেনা কিন্তু তার সুন্দর ব্যবহারের কারণে সে জায়গা করে নেয় সকলের অন্তরে। মানুষ হিসেবে আমাদের সকলেরই সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি কিছু দায়িত্ব থাকে। স্ব স্ব জায়গা থেকে মনুষ্যত্বকে সাথে নিয়ে আমাদের সে দায়িত্ব পালন করতে হবে। বর্তমানে, যে বৈষম্য সমাজে সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয় সেটি হচ্ছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য। আমরা নিজেরাই ধন-সম্পদের দোহাই দিয়ে মানুষের মাঝে উঁচু-নিচু শ্রেণীভেদ তৈরী করেছি। কিন্তু, আমাদের মনে রাখা উচিত এই পৃথিবীর সমস্ত কিছুর মালিক সৃষ্টিকর্তা। তার হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়েনা৷ মানুষকে তিনি পাথর থেকে অট্টালিকা তৈরীর মেধা দিয়েছেন। কিন্তু কেউ হলফ করে বলতে পারে না যে এই অট্টালিকা ভূমিকম্পে মুহূর্তের মধ্যে ধসে পড়বে না। এই ক্ষমতা শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার। আমাদের উচিত হিংসা, অহংকার ত্যাগ করে সৎ নীতিতে জীবন ধারণ করা এবং সব সময় একথাটি নিজেকে মনে করিয়ে দেয়া “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”।
মন্তব্যঃ যেদিন মানুষ তার সব অহংকার ত্যাগ করে, সংঘাত ভুলে সৎ নীতিতে সকল মানুষকে আপন করে নেবে সেদিন জয় হবে মনুষ্যত্বের, জয় হবে মানবিকতার। এই পৃথিবী আমাদের সকলের।
আরও ভাবসম্প্রসারণ পড়তে ক্লিক করুন এখানে- গুরুত্বপূর্ণ ভাবসম্প্রসারণ