ওয়ানডে বিশ্বকাপে ব্যাটসম্যানদের গড়া রেকর্ড বইয়ের নেতৃত্বে আছেন লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকার। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান টেন্ডুলকারের। ওয়ানডে বিশ্বকাপে ৫৬.৯৫ গড়ে শচীন করেছেন ২,২৭৮ রান। খুব সহসাই তার এই রেকর্ড কেউ ভাঙবে বলে মনে হয় না। এখনো ক্রিকেট খেলছেন এমন প্লেয়ারদের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশী অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান আছেন বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের সেরা দশের তালিকায়। কিন্তু টেন্ডুলকারের সাথে সাকিবের রানের ব্যবধান ১,১৩২!!!
শুধু সর্বোচ্চ রান নয়, বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি হাফ সেঞ্চুরি, সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি, বিশ্বকাপের এক আসরে সবচেয়ে বেশি রান- এই সবগুলো রেকর্ডেই লেখা আছে ব্যাটিং জিনিয়াস টেন্ডুলকারের নাম। তাই এই লেখা যদি পুরোটাই টেন্ডুলকারময় হয় তাতে আর দোষের কি?
চলুন ভূমিকা পর্ব আর না বাড়িয়ে রেকর্ড পাতায় কিছুক্ষণের জন্য ডুব দেই।
ওয়ানডে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রহ করা ১০ ব্যাটসম্যান
১. শচীন টেন্ডুলকার
[রান- ২,২৭৮, ইনিংস- ৪৪, গড়-৫৬.৯৫, স্ট্রাইক রেট-৮৮.৯৮, সেঞ্চুরি- ৬, ফিফটি- ১৫,সর্বোচ্চ-১৫২]

ওয়ানডে বিশ্বকাপের ইতিহাস লিখতে হলে টেন্ডুলকারকে নিয়ে আলাদা একটি অধ্যায়ই লিখতে হবে। তার মতো এমন ধারাবাহিকভাবে বিশ্বকাপে আর কোন ব্যাটসম্যানই রান করতে পারে নি।
টেন্ডুলকার খেলেছেন মোটে ৬টি বিশ্বকাপ (১৯৯২-২০১১)। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারত গ্রুপ পর্বেই বিদায় নিয়েছিল। এই একটি বিশ্বকাপ বাদে প্রতিটি বিশ্বকাপেই টেন্ডুলকারের ব্যাটে ছিল রানের ফোয়ারা। তিনি ৪৪ ম্যাচ খেলে ৫৬.৯৫ গড়ে করেছেন ২,২৭৮ রান।
বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ৬টি সেঞ্চুরির রেকর্ড যৌথভাবে রোহিত শর্মা ও টেন্ডুলকারের। ২০১৯ বিশ্বকাপে রোহিত ৫টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। এমন অতিমানবীয় পারফর্মেন্সের কারণেই টেন্ডুলকারকে ছুঁতে পেরেছেন রোহিত। তবে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ফিফটির রেকর্ডটি টেন্ডুলকারের একার দখলে। বিশ্বকাপে ১৫টি ফিফটি, ৬টি সেঞ্চুরি নিয়ে মিলিয়ে মোট ২১বার ৫০+ ইনিংস খেলেছেন শচীন।
এছাড়া বিশ্বকাপের এক আসরে সবচেয়ে বেশি রান করার রেকর্ডও শচীন টেন্ডুলারের। ২০০৩ বিশ্বকাপে ১১ ম্যাচ খেলে তিনি করেছিলেন ৬৭৩ রান। এরপরেই আছেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার ম্যাথু হেইডেন। ২০০৭ বিশ্বকাপে হেইডেন করেছিলেন ৬৫৯ রান।
২. রিকি পন্টিং
[রান- ১,৭৪৩, ইনিংস- ৪২, গড়- ৪৫.৮৬, স্ট্রাইক রেট- ৭৯.৯৫, সেঞ্চুরি- ৫, ফিফটি- ৬, সর্বোচ্চ-১৪০*]

শচীন টেন্ডুলকারের পর বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ধারাবাহিকভাবে রান করা ব্যাটসম্যান রিকি পন্টিং। বিশ্বকাপে ৪২ ইনিংসে ৪৫.৮৬ গড়ে পন্টিং করেছেন ১,৭৪৩ রান। খেলেছেন ৫টি বিশ্বকাপ (১৯৯৬-২০১১), জিতেছেন ৩টি। ক্যাপ্টেন হিসেবে টানা দুটি বিশ্বকাপ (২০০৩,২০০৭) জিতে পন্টিং জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়।
৩. কুমার সাঙ্গাকারা
[রান- ১,৫৩২, ইনিংস- ৩৫, গড়- ৫৬.৭৪, স্ট্রাইক রেট- ৮৬.৫৫, সেঞ্চুরি- ৫, ফিফটি- ৭, সর্বোচ্চ-১২৪]

বিশ্বকাপে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক কুমার সাঙ্গাকারা। শ্রীলঙ্কান গ্রেট সাঙ্গা খেলেছেন ৪টি বিশ্বকাপ (২০০৩-২০১৫)। ব্যাট হাতে সবচেয়ে বেশি ভালো সময় কাটিয়েছেন ২০১৫ বিশ্বকাপে। এই বিশ্বকাপে ১০৮.২০ গড়ে সাঙ্গাকারা করেছিলেন ৫৪১ রান, গড়েছিলেন টানা ৪ সেঞ্চুরির অবিশ্বাস্য রেকর্ড।
২০১১ বিশ্বকাপে দলকে ফাইনালে তুলতে সাঙ্গা একটি শতক ও ৩টি অর্ধশতকে ৯৩.০০ গড়ে করেছিলেন ৪৬৫ রান। ২০০৭, ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেললেও বিশ্বকাপ ট্রফি ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য সাঙ্গাকারার হয় নি।
৪. ব্রায়ান লারা
[রান- ১,২২৫, ইনিংস- ৩৩, গড়- ৪২.২৪, স্ট্রাইক রেট- ৮৬.২৬, সেঞ্চুরি- ২, ফিফটি- ৭, সর্বোচ্চ- ১১৬]

ক্যারিবিয়ান প্রিন্স ব্রায়ান লারার উল্লেখ করার মতো কোন অর্জন বিশ্বকাপে নেই। ভঙ্গুর ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল নিয়ে বিশ্বকাপে নামমাত্রই অংশ নিয়েছিলেন। তবে ব্যক্তিগত অর্জন খুব একটা খারাপ নয়। ৫টি বিশ্বকাপ (১৯৯২-২০০৭) খেলে লারার সংগ্রহ ১,২২৫ রান ।
৫. এবি ডি ভিলিয়ার্স
[রান- ১,২০৭, ইনিংস- ২২, গড়- ৬৩.৫২, স্ট্রাইক রেট- ১১৭.২৯, সেঞ্চুরি-৪, ফিফটি-৬, সর্বোচ্চ- ১৬২*]

এবি ডি ভিলিয়ার্স খেলেছেন মাত্র ৩টি বিশ্বকাপ (২০০৭-২০১৫)। কিন্তু এতেই তিনি ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লেখাতে পেরেছেন। বিশ্বকাপে কমপক্ষে এক হাজার রান করেছে এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ভিলিয়ার্সের মতো গড় ও স্ট্রাইক রেট আর কারো নেই! গড় ৬৩.৫২, স্ট্রাইক রেট ১১৭.২৯ !!! ২০১৫ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ভিলিয়ার্সের ৬৬ বলে ১৬২ রানের ঝোড়ো ইনিংস এখনো নিশ্চয়ই অনেক ক্রিকেট ভক্তদের চোখে লেগে আছে।
৬. ক্রিস গেইল
[রান- ১,১৮৬, ইনিংস- ৩৪, গড়- ৩৫.৯৩, স্ট্রাইক রেট-৯০.৫৩, সেঞ্চুরি-২, ফিফটি-৬, সর্বোচ্চ- ২১৫]

“ইউনিভার্স বস” ক্রিস গেইল ১,১৮৬ রান নিয়ে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় ছয় নম্বর অবস্থানে আছেন। দলগত কোন অর্জন না থাকলে ব্যক্তিগত অর্জন কেমন জানি ফিকে হয়ে যায়। বিশ্বকাপে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করার রেকর্ডটি ক্রিস গেইলের। ২০১৫ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৪৭ বলে ২১৫ রানের একটি বিধ্বংসী ইনিংস খেলেছিলেন গেইল ।
৭. সনাৎ জয়াসুরিয়া
[রান- ১,১৬৫, ইনিংস- ৩৭, গড়- ৩৪.২৬, স্ট্রাইক রেট-৯০.৬৬, সেঞ্চুরি-৩, ফিফটি-৬, সর্বোচ্চ- ১২০]

টি-২০ যুগের আগেই যেই ব্যাটসম্যান টি-২০ মুডে ব্যাট চালাতেন, তিনি সনাৎ জয়সুরিয়া। শ্রীলঙ্কার ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য জয়সুরিয়া মোট ৫টি বিশ্বকাপ (১৯৯২-২০০৭) খেলেছেন। ২০০৭ বিশ্বকাপে দলকে ফাইনালে উঠাতে ব্যাট হাতে দারুণ অবদান রেখেছিলেন তিনি। ২০০৭ বিশ্বকাপে ২টি সেঞ্চুরি ও ২টি ফিফটিসহ করেছিলেন ৪৬৭ রান।
৮. জ্যাক ক্যালিস
[রান- ১,১৪৮, ইনিংস- ৩২, গড়- ৪৫.৯২, স্ট্রাইক রেট-৭৪.৪, সেঞ্চুরি-১, ফিফটি-৯, সর্বোচ্চ- ১২৮*]

ওয়ানডে হোক কিংবা টেস্ট, দুই ফরম্যাটেই সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের তালিকায় উপরের দিকেই থাকবেন জ্যাক ক্যালিস। দলগতভাবে ক্যালিস তেমন কিছুই অর্জন করতে পারেন নি। কিন্তু বিশ্বকাপে নিজের নামের মান ঠিকই রেখেছিলেন।
৫টি বিশ্বকাপ (১৯৯৬- ২০১১) খেলে ক্যালিস ৪৫.৯২ গড়ে করেছিলেন ১,১৪৮ রান। বল হাতে নিয়েছিলেন ২১টি উইকেট।
৯. সাকিব আল হাসান
[রান- ১,১৪৬, ইনিংস- ২৯, গড়- ৪৫.৮৪, স্ট্রাইক রেট-৮২.২৬, সেঞ্চুরি-২, ফিফটি-১০, সর্বোচ্চ- ১২৪*]

এখনো ক্রিকেট খেলছেন এমন প্লেয়ারদের মধ্যে একমাত্র সাকিব আল হাসান আছেন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের সেরা দশের তালিকায়। ওয়ানডে বিশ্বকাপে সাকিবের মোট রান ১,১৪৬। অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, আর মাত্র ৮০ রান করলেই বাঘা বাঘা সব ব্যাটসম্যানদের পিছনে ফেলে সাকিব বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় ৪ নম্বরে উঠে যাবেন।
২০০৭, ২০১১, ২০১৫ বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে তেমন কিছু করতে পারেন নি সাকিব। তিন বিশ্বকাপ মিলিয়ে সাকিবের ফিফটি ছিল ৫টি। কিন্তু ২০১৫ বিশ্বকাপে সাকিবের অতিমানবীয় পারফর্মেন্স সব হিসেব নিকেশ পাল্টে দিয়েছে। ২০১৫ বিশ্বকাপে সাকিব করেছেন ৬০৬ রান, সেঞ্চুরি ২টি, ফিফটি ৫টি! সেই সাথে বল হাতে নিয়েছিলেন ১১ উইকেট!
আরেকটি রেকর্ডের কথা উল্লেখ না করলেই না। টেন্ডুলকারের পরে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ৫০+ রানের রেকর্ড যৌথভাবে সাঙ্গাকারা ও সাকিবের দখলে। সাকিব মোট ১২বার ৫০+ ইনিংস খেলেছেন।
১০. তিলাকারত্নে দিলশান
[রান- ১,১৪৬, ইনিংস- ২৯, গড়- ৪৫.৮৪, স্ট্রাইক রেট-৮২.২৬, সেঞ্চুরি-২, ফিফটি-১০, সর্বোচ্চ- ১২৪*]

২০১১ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কাকে ফাইনালে তুলতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন দিলশান। ২০১১ বিশ্বকাপে ৫০০ রান নিয়ে সেই আসরের সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যান ছিলেন দিলশান।
আরও পড়ুন- T20 বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান কার?