in

সংসার চালাতেই প্লে-ব্যাকে নাম লেখান লতা মঙ্গেশকর, জয় করেন কোটি হৃদয়

বাবার কাছেই সঙ্গীতের তালিম, ক্লাসিক্যাল ছেড়ে প্লে-ব্যাকেই রাজত্ব করেন লতা মঙ্গেশকর

লতা মঙ্গেশকর
লতা মঙ্গেশকর

বাঙালির সঙ্গীত প্রীতি নিয়ে আলোচনায় বসলে যে কয়টি নাম এড়িয়ে যাওয়া শুধু অসম্ভবই নয় ,মোটামুটি অপরাধের কাতারে পড়ে তাঁদের মধ্যে হেমন্ত, লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা, মান্না প্রমুখ অন্যতম। এককালে প্লে-ব্যাকে বলুন বা ক্যাসেটে, যাদের গান বিকোতো এলাহিভাবে সেই দুই নক্ষত্র আচমকাই পাড়ি জমালেন ওপারের মহাসমুদ্রে।

মাত্র নয় দিনের ব্যবধানে সন্ধ্যা-লতাকে হারিয়ে শোকে কাতর সঙ্গীত পিয়াসীরা। ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি ’, ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’, ‘আজ মন চেয়েছে’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায়’, ‘ও মোর ময়না গো’ প্রভৃতির মতো কাল জয়ী গান স্নাত হয়েছে লতা মঙ্গেশকরের সুরেলা গলায়।

কীভাবে শুরু হয়েছিল লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গীত জীবন? আরম্ভের পূর্বেও যে আরম্ভ সে প্রসঙ্গে আরেক কিংবদন্তী জাভেদ আখতারের মুখোমুখি হয়েছিলেন ২০০৯ সালে। তাঁদের সেই প্রাণবন্ত সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরছি এই লেখায়।

আরম্ভের পূর্বে

সিনেমায় গান করবেন আদরের কন্যা লতা, এমনটা কখনোই চান নি সঙ্গীতজ্ঞ, থিয়েটার অভিনেতা পিতা দীননাথ মঙ্গেশকর। বাড়িতে গানের জলসা চলতো নিয়মিত, কে এল সায়গলের গানে বুঁদ থাকতেন দিনভর। গানের গুরু হিসেবেও প্রসিদ্ধি ছিল। ক্ষুদে লতাকে গান শেখাবার কথা প্রথমে ভাবেন নি। তবে গান যার রক্তে বহমান, সে কি থেমে থাকে!

বাবার ছাত্রছাত্রীদের রেওয়াজ শুনতেন লুকিয়ে, ফাঁক তালে আওড়ে নিতেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অ আ ক খ। এভাবেই একদিন পিতার এক শিষ্যের ভুল ধরিয়ে গুরুর চোখে পড়েন। তালিম চলতে থাকে পুরোদমে। ফলে বাবার সাথে শাস্ত্রীয় ধারার অনুষ্ঠানে ডাক পড়তো তাঁরও। ১৯৪২ সালের মার্চে মারাঠি এক চলচ্চিত্রে প্রথম প্লে-ব্যাক করেন, যদিও কখনোই মুক্তি পায়নি ছবিটি। এর পরের মাসেই বাবাকে হারান লতা।

কিশোরী লতার যাত্রা

পিতার আকস্মিক অন্তর্ধানের পর বড় মেয়ে লতার কাঁধেই পড়ে গোটা পরিবারের ভার। দিশেহারা অবস্থাতে পাশে পান পিতার বহু শুভানুধ্যায়ীকে, মেধার জোরে এগুতে থাকেন আরও সামনে। মাস্টার বিনায়ক ফিল্মি দুনিয়ার সাথে লতা মঙ্গেশকরকে আরও সম্পৃক্ত করেন। প্রথম ফিল্মে প্লে-ব্যাক করে লতা পেয়েছিলেন ৩০০ রুপি।

১৯৪৭ সাল অব্দি লতা সেই মাস্টার বিনায়কের কোম্পানিতেই কাজ করেন। বিনায়কের মৃত্যুর পর ওস্তাদ গোলাম হায়দারের নজরে পড়েন এই সুমিষ্ট কণ্ঠি। প্রতিভা থাকলে কী হবে, সে কালের চাহিদাকেও মাথায় রাখতে হতো তৎকালীন পরিচালক- প্রযোজককে।

তানপুরায় চলতো প্রথম জীবনের তালিম; ছবিঃইনস্টাগ্রাম
তানপুরায় চলতো প্রথম জীবনের তালিম; ছবিঃইনস্টাগ্রাম

তাই প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায় ‘শহীদ’  ছবিতে লতাকে দিয়ে গান গাওয়াতে রাজি হননি প্রথমে। সংগীত পরিচালক গোলাম হায়দারকে তখন বলেও ছিলেন, ‘এই গায়িকার কণ্ঠ সিনেমায় খাপ খায়না। ভীষণ সরু ওটা।’

এতেই জেদ চেপে বসে ওস্তাদের। স্টেশনে বসেই তালিম দেন লতাকে। দুদিন রিহার্সালের পর শেষ হাসি হাসেন গোলাম-লতা গুরু-শিষ্য। পরের যাত্রাটা খুব যে সুমধুর ছিল তা নয়। তবে তাঁর হাত ধরেই বলিউডে প্রথম বড় ব্রেক পান লতা। মজবুর (১৯৪৮) ছবির ‘দিল মেরা তোড়া’ গানটি জনপ্রিয়তা পায় সে সময়।

চ্যালেঞ্জ সামলেছেন নবোদ্যমে

নিয়মিত প্লে-ব্যাকের কাজ করতে থাকলেও তরুণী লতার জন্য কন্টকাবৃতই ছিল পথটা। ফিল্ম স্টুডিওর হকিকত সম্পর্কে থোড়াই জানতেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি খালি পেটে, কখনো এক গ্লাস জল খেয়েই কাজ করতেন। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘স্টুডিওর ওখানে যে ক্যান্টিন ছিল তাও আমি জানতাম না। সারাদিন রেকর্ডিং এর ঘরে পড়ে থাকতাম। ফেরার সময় জমানো টাকা দিয়ে সবজি কিনে ফিরতাম বাসায়। চেষ্টা করতাম ঘরের কেউ যেন তকলিফে না থাকে।‘

ভাই বোনের সাথে লতা; Photo: Starunfolded
ভাই বোনের সাথে লতা; Photo: Starunfolded

লতার সুদিন ফেরে অল্প দিনেই,  কিন্তু নিজেকে খুঁজে ফেরার অন্ত ছিল না। প্রথম দিকে নুরজাহানের সাথে তাঁর গায়কীর তুলনা করা হতো। লতাও অকপটে স্বীকার করেছেন তাঁর প্রভাব। তবে দিলিপ কুমারই তাঁকে সঠিক দিশায় চলতে তাগাদা দেন প্রথম।

সিনেমার কাজেই গুরগাঁও যাচ্ছিলেন লোকাল রেলে। পরিচয় পর্ব সারতেই দিলিপ কুমার মন্তব্য করেন ‘মারাঠি লোকেদের কথায় ডাল-ভাতের ঘ্রাণটা মেলে, তন্দুরি চিকেনের স্বাদ আসে না।‘  এতেই টনক নড়ে যুবা লতার। ঘরে ফিরেই সিদ্ধান্ত নেন উর্দু শিখবেন। মওলানা মাহবুবের কাছেই চলে বহু মাসের কঠিন সাধনা, নিজেকে আরও পূর্ণ হিসেবে আবিষ্কার করেন এই অসামান্য গুণী।

‘ওস্তাদ গোলাম হায়দার সব সময় বলতেন, লতা গানের বোল বোঝার চেষ্টা করো। এজন্য প্রয়োজনে উর্দু, হিন্দি শিখে নাও। কল্পনা করো, গানের দুঃখ- সুখ তোমার ব্যক্তিগত। হিরোইনের কথা ভেবো না।‘  অনিল বিশ্বাসের কাছে শিখেছেন শ্বাসের কৌশল। তবে ভয় পেতেন আরেক মহারথী সাজ্জাদ হোসেনের কম্পোজিশনকে। এর কারণ হিসেবে বলেন, ‘সাজ্জাদ সাহেবের মাথায় আরবীয় সঙ্গীত ঘুরতো, সেগুলো ভীষণ জটিল। তবে তিনি খুব সূক্ষ্মতার সাথে কাজ করতেন।‘

স্কাই ইজ দ্য লিমিট

লতা মঙ্গেশকর ৩৫টিরও বেশি ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছিলেন। তাঁর রেকর্ডিং সংখ্যা ২৫হাজারেরও বেশি। এ কারণে গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ডস রেকর্ডের মালিকও তিনি। তবে যে তথ্যটা অনেকেই জানেন না, গানের বাইরে অভিনয়েও ছিল তাঁর পদচারণ। মঙ্গলাগৌর (১৯৪২), সুভদ্রা (১৯৪৬) এবং মন্দির (১৯৪৮) প্রভৃতিতে ছোট চরিত্রে দেখা যায় তাঁকে।

তাঁর ভক্তের তালিকায় ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীও
তাঁর ভক্তের তালিকায় ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীও

আশা, মীনা, উষা ও ভাই হৃদয় নাথ এবং মাকে নিয়েই ছিল তাঁর ভরা সংসার। প্রেম-বিয়ে নিয়ে কখনোই মেতে ওঠেন নি। পরিবার আর সঙ্গীতের প্রতি নিবেদিত ছিল ৯২ বছরের জীবন।

‘রঙ্গিলারে’, ’লাগ যা গালে’, ‘ তুঝসে নারাজ নাহি হ্যায় জিন্দেগি’, ‘এক পেয়ার কা নাগমা হ্যায়’,’ তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোয়ি’,’ ‘আজিব দাস্তান হ্যায়ইয়ে’র মতো বিপুল শ্রেষ্ঠ গান জন্ম নিয়েছে তাঁর কণ্ঠে, ভালোবাসতে শিখিয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরকে।

পুনর্জন্মে বিশ্বাসী হলেও জীবনের পুনরাবৃত্তি চান নি, আফসোস ছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে নিয়মিত হতে না পারার। বারবারই বলেছেন, একটি জীবনই আমার জন্য যথেষ্ট। লতা মঙ্গেশকরের কাহিনী যুগে যুগেই উদ্দীপনা যোগায়, জানায় জীবনের সমাপ্তি-আরম্ভ পুরোটাই প্রকৃতির লীলা খেলা। এ যেন তাঁর গানের মতোই-

‘আজিব দাস্তান হ্যায়, কাহাঁ শুরু কাহাঁ খাতাম’

আরও পড়ুন- ফিরিয়ে দিয়েছেন রং ফর্সাকারী ক্রিমের ২ কোটির প্রস্তাব, প্রচলিত সৌন্দর্য ধারণার বিপরীতে সাই পল্লবী

সাক্ষাৎকারটি দেখতে ক্লিক করুন নিচের লিংকে-