in

কানে সাদ সংবাদ

রেহানা মরিয়ম নূর পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ
রেহানা মরিয়ম নূর পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ

প্রোটাগনিস্টের চোখে বিষবাষ্প, পচে গলা যাওয়া এক শহর, বিশ্বাস ভাঙতে ভাঙতে শেষ কোণে ঠেকে যাওয়া মানুষের বাস যেখানে। ওখানের লোকেরা জানে না কী করে পুনর্জন্ম নিতে হয়, জানে না অনাগত সন্তানকে পচা কুয়োর মতো শহরে জীবন দেয়া কি মৃত্যুসম কিনা। এই শহরের শেকলে জং, মানবতা-প্রত্যাশার নামে মরীচিকার আলোড়ন। ক্লস্ট্রোফোবিক ঢাকা থেকে মুক্তি চায় সাজ্জাদের মতো প্রতিটি নাগরিক।

রটারডামে কল্লোল তুলে সিংগাপুর ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে একবারে আদায় করেছিল সেরা পরিচালক আর অভিনেতার (মোস্তফা মনোয়ার) ঝকঝকে এওয়ার্ড। মাত্র ৮ লাখেই ঢাকার গলি-ঘুপচির বিবস্ত্র জীবনকে দেখিয়েছিলেন সাদ, সাদাকালোর বিবর্তনে।

‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’য় দর্শক পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় সাজ্জাদের গোটা আংগিককে দেখতে পায়, তার দ্বিধা-অপরাধবোধ-উদাসীনতা পরতে পরতে পরিচয় করিয়ে দেয় ঢাকা নামক মৃতবৎ শহরের সাথে। এটাই তো সত্য!

ব্যতিক্রমের আভাস এলো না ‘আ সার্তে রিঁগা’ য় ( ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে) নির্বাচিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ এর মূল আখ্যান ধারায়। স্পেডকে স্পেড বলবার স্পর্ধাই সাদের স্বাতন্ত্র্য। মি টু আন্দোলনের ছোঁয়া এই উপমহাদেশে প্রবলতর হয়নি, কিন্তু অস্বীকারও অসম্ভব। কেননা এই নিপীড়ন সার্বজনীন।

আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের কাজের সাথে যারা পরিচিত তারা জানেন, ফ্রেমিংকে ঠিক রেখে কালার-প্যালেটের প্রতিও তার অপরিসীম মনোযোগ। ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র সাদা-কালোর বিবর্ণ দেয়াল, ঢাকার ক্ষয়ে যাওয়া শুষ্ক জীবনের ইংগিত বহন করে, সেভাবেই ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ এ নীলাধিক্য আঁকড়ে রাখে বিষণ্নতার জমাট ক্ষোভকে। DW Bangla কে দেয়া সাক্ষাৎকারেও এই বর্ণ কেন্দ্রিক অবসেশনকে স্বীকার করেন তিনি।

অভিজ্ঞতা নাকি কল্পনা- কোনটার প্রাধান্য বেশি তাঁর ছবিতে? অভিজ্ঞতা। এক শব্দে উত্তর সাদের।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে আমি কিছুই লিখতে পারি না। সুতরাং যে চরিত্রই রূপায়ণ করি, কোনো না কোনোভাবে বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে কিংবা পর্যবেক্ষণ করেছি আমাদের দেশে। কিন্তু আমি অবশ্যই চেয়েছি শুধু আমার দেশের দৃষ্টিকোণে নয়, সবাই যেন এই চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে পারে।‘

‘আমার কোনো বন্ধু যখন বলে, এটা যেকোনো জায়গায় ঘটতে পারে, হোক ফ্রান্স কিংবা ইউরোপের কোথাও, আমার মনে হয়েছে, সম্ভবত আমি সঠিক জায়গাটা স্পর্শ করতে পেরেছি, যেখানে মনে হবে এই ঘটনা যেকোনো জায়গায়ই ঘটতে পারে।‘

এক ঘন্টা সাতচল্লিশ মিনিটের ছবির মূল ভূমিকায় আছেন আজমেরী হক বাঁধন। তিনিই এই রেহানা মরিয়ম নূর। যৌন হয়রানিকে কেন্দ্র করে সামাজিক সংস্কার, নারী-পুরুষ বৈষম্য, কর্মক্ষেত্র থেকে জীবনের প্রত্যেক ঘাতে অসাম্যের শিকার – এমন বৃহদাকার বিষয়কেই তুলে এনেছে ‘ভিন্ন দৃষ্টিকোণ’ এ মনোনীত ছবিটি। বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোতে ঠিক কবে মুক্তি মিলবে এর-তা এখনো জানায়নি দ্যুতি ছড়ানো ‘নূর’ টিম।

‘রেহানা মরিয়ম নূরে’র একটি দৃশ্য; Photo: Roger Ebert website

শিল্প, শিল্পের কুশীলব আর ভোক্তা প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রাখেননি কখনো, সাদের বিবেচনায় এটা তাঁর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র‍্যের বিরোধী, একটা গল্পকে পার্সোনাল প্রসেসের মধ্য দিয়েই হাড়-মাংস লাগান তিনি। নানা মুনির নানা মত নিতে গেলে সিনেমাই তৈরি সম্ভব নয়। তিনি বলেন,

 ‘মানুষ কোন স্টোরিতে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে- এভাবে চিন্তা করে আমার পক্ষে চলচ্চিত্র বানানো সম্ভব নয়। আমি কোন ছবি বানাতে চাই, সেটা বুঝতে ‍দুই-আড়াই বছর চিন্তাই করতে হয়েছে। একের পর এক খসড়ার পর, ছবিতে যুক্তর পর বাঁধনের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। ছবির গল্প ডেভলপ করতে করতে অবশেষে মনে হয়েছে, এই ছবিটা আমি বানাতে চাই। এখানে বাইরের প্রভাব কিংবা অন্য কোনো চেষ্টা করতে গল্পটা বলতে চাইনি।’

আমার কেন্দ্রীয় অভিনেত্রী মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছেন, যা আমরা চেয়েছি, তাই তিনি দিয়েছেন। এর প্রতিদান আমি দিতে পারিনি। আমার চিত্রগ্রাহক এক বছরের বেশি সময় ধরে জিমে গিয়েছিলেন। কারণ, তাঁকে বলেছিলাম, এই ছবির জন্য তাঁকে ফিট হতে হবে। কারণ, এই ছবিতে প্রচুর দীর্ঘ শট ক্যামেরা হাতে শট আছে। পুরো দল আমাকে কীভাবে সহযোগিতা করেছে, এটা তার ছোট্ট কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।‘

পূর্বতন ছবির মতো এতেও কাজ করেছেন চিত্রগ্রাহক তুহিন তামিজুল, প্রডাকশন ডিজাইনার আলী আফজাল উজ্জ্বল, কালারিস্ট চিন্ময় রায় ও শব্দ প্রকৌশলী শৈব তালুকদার । এতে আরও অভিনয় করেছেন আফিয়া জাহিন জাইমা, কাজী সামি হাসান, তাবাসসুম বর্ণ, ইয়াছির আল হক, সাবেরী আলম প্রমুখ।

পোটোকল ও মেট্রো ভিডিওর ব্যানারে সিনেমাটি প্রযোজনায়  ছিলেন সিঙ্গাপুরের প্রযোজক জেরেমী চুয়া, নির্বাহী প্রযোজক এহসানুল হক বাবু ও সহ-প্রযোজনায় রয়েছেন রাজীব মহাজন, আদনান হাবিব, সাঈদুল হক খন্দকার।

আঁ সার্তে রিগায় মনোনয়ন, বাংলা সিনেমা শিল্পের অনন্য প্রাপ্তি; Photo: প্রথম আলো

ডিটেইলিং বা খুঁটিনাটি নিয়ে ভীষণ খুঁতখুঁতে এই নবীন নির্মাতা। আগের ছবির সাজ্জাদের কথা ভাবুন,অথবা সেই রেহানার ভাবনাকে একটু তলিয়ে দেখুন- উত্তর মিলবে। শেয়ারবাজারের ধস, রেহানার আত্মসংস্থানের যুদ্ধ কিংবা আড়ংয়ের ব্যাগে জোর করে জাতে ওঠার প্রচেষ্টা – সবকিছুই এক বিকলাঙ্গ সমাজের চিত্র তুলে আনে।

আমি আমার জীবনে যেভাবে রেহানা দেখেছি সেভাবেই তুলে এনেছি। কীভাবে তুলে আনলে দর্শকদের মাঝে প্রভাব তৈরি করতো সেই হিসাব করে গল্পটা আসলে লেখা হয়নি। ওভাবে আমি আমার ক্যারেক্টারকে আপ্রোচ করি না। আমি ছোটবেলা থেকেই ‍স্কার্ফ পড়তে দেখেছি, আজান দিলে আপুদের মাথায় কাপড় দিতে দেখেছি-এসব ছোটখাট ডিটেলস জীবন থেকেই নেওয়া।‘

চট্টগ্রামের যুবক সাদ কী রাজনীতি সচেতন? না সুবিধাবাদী? না নিরপেক্ষ? সরাসরি দুটি প্রশ্নে উত্তর জানান এভাবে,

পলেটিক্যাল স্টেটমেন্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য থেকে ছবিটি লিখি নাই কিংবা বানাইনি। আমি রেহানাকে অনুসরণ করছিলাম। ওকে বিভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি করতে গিয়ে যে প্রশ্নগুলো তুলে আনা উচিত সেটাই করেছি। আমার মনে হয় ছবিটি তখনই সফল হবে যখন এটি কাউকে চিন্তা করতে সহায়তা করবে। ছবিটি কোনো উত্তর দিয়ে নয়, প্রশ্ন দিয়ে শেষ হয়।‘

সংবাদ সম্মেলনে টিম ‘রেহানা মরিয়ম নূর’; Photo: DW Bangla

বর্ণিল ঝাড়বাতির সামনে নয়, প্রদীপের পেছনেই থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য সাদের। অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য নিয়মিত প্রশ্নের সম্মুখীনও হচ্ছেন । তবে সকল কৌতূহল এড়িয়ে নিরন্তর কাজ করাতেই আনন্দ পান ছত্রিশে পা ফেলা এই তরুণ নির্মাতা। কর্মে নিবেদনেই নিজের সার্থকতা, তাই ব্যক্তিগত স্বভাবটা তুলে ধরেন অকপটেই,

আমি খুবই অস্বস্তিবোধ করি। মনোযোগ সামলানো আমার জন্য খুব কঠিন। আমি মনে করি, আমার পুরো টিমের মনোযোগ পাওয়া উচিত। পুরো টিম অনেক কষ্ট করেছে। ছবিটা মনোযোগ পেলে আমার ভালো লাগে। আমার অগোচরে থাকতে ভালো লাগে।‘

স্বাধীনতার ৫০ বছরে এই প্রাপ্তি অসামান্য। ১৯৯৪ এ সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্যের ‘উত্তরণ’ প্রদর্শিত হয়েছিল কানে,একই বিভাগ থেকে। সাতাশ বছর বাদে বাংলাদেশের হয়ে সেই সম্মান এনে দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রাক্তনী সাদ।

ভদ্রস্থ স্ক্রিনিং হলেই বর্তে যেতেন, তাই ৭ জুলাই কানে সকাল ১১ টা ১৫ মিনিটে সহকর্মী দলের সাথে যোগ দেন এই অপ্রকাশ্য-প্রেমী যুবা।

বাঁধনের অভিনয়ে মুগ্ধ কাশ্যপ; Photo: Dhaka Tribune

ইতোমধ্যেই প্রশংসার বন্যায় ভেসেছে ছবির কলাকুশলীরা, নন্দিত হয়েছে তাদের উপস্থাপনও। বিশেষত বাঁধনের বন্ধনহীন উচ্ছ্বাস আর পদচারণা চমকে দিয়েছে নিন্দুকদের। অনেকের মতে, তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রামের ছাপ পড়েছে অভিনয়েও।

অনুরাগ কাশ্যপ একে ‘উপমহাদেশীয় সিনেমা ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। রজার এবার্টের সাইটেও এর রিভিউ পাওয়া যাচ্ছে। এতে বলা হয়,

‘Saad also brilliantly locks us into the POV of his title character, not only placing her in every scene, but never leaving the offices, classrooms, and corridors of the hospital. The setting adds to the claustrophobia, enhanced even further by a striking blue color palette.’

কানের প্রাঙগণে প্রলয় তুলুক না তুলুক, বাংলাদেশি পরিচালকদের স্বপ্ন-আশায় ঘর বাঁধতে ঠিকই প্রেরণা  দিলেন নীরব-নির্মাতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ।

লিখেছেন- সারাহ তামান্না 

আরও পড়ুন –

টাকা পয়সাটা লিমিটেড, কিন্তু কাজের তৃপ্তিটাই আনলিমিটেডঃ মোশারফ করিম

“কেয়ামত থেকে কেয়ামত” ছবিটি যে কারণে ছেড়েছিলেন তৌকির আহমেদ