in

রাষ্ট্র কাকে বলে? রাষ্ট্রের উপাদান কয়টি?

রাষ্ট্র কাকে বলে? রাষ্ট্রের উপাদান কয়টি?
রাষ্ট্র কাকে বলে? রাষ্ট্রের উপাদান কয়টি?

রাষ্ট্র হচ্ছে সামাজিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সমাজে বসবাসরত সকল মানুষকে একটি ঐক্য সূত্রে বাঁধা এবং তাদের কল্যাণ ও সমস্যা সমাধানের জন্যই রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। সমাজ বিকাশের একটি স্তরে সমাজের মধ্য থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাষ্ট্রকে মনে করা হতো ঈশ্বরের সৃষ্টি করা একটি প্রতিষ্ঠান। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রকে ‘সর্বজনীন কল্যাণ সাধনকারী’ এবং ‘মানুষের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য’ প্রতিষ্ঠান বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

রাষ্ট্র হলো নাগরিকদের জন্য। নাগরিকদের সুখ ও শান্তি বিধান করার জন্য রাষ্ট্রকে অনেক কাজ করতে হয়। রাষ্ট্রের এই কাজ কতগুলো অপরিহার্য এবং কতগুলো ঐচ্ছিক। আবার রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদেরও বেশ কিছু দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করতে হয়। অন্যদিকে নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা বিধান এবং সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলো প্রতিরোধ ও প্রতিকারে আইনের বিধিবিধান আবশ্যক।

নিম্নে রাষ্ট্র কাকে বলে ও রাষ্ট্রের উপাদান কয়টি সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

রাষ্ট্রের ধারণা

প্রত্যেক মানুষ কোন না কোন রাষ্ট্রে বসবাস করে। হঠাৎ করে কোন রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়নি। আদিম মানুষ প্রথমে গোত্রভিত্তিক বসবাস করত। সময়ের পরিবর্তনে একসময় রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। মানুষই রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রত্যেক নাগরিকেরই রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগণকে ঐ রাষ্ট্রের নাগরিক বলা হয়। নাগরিকদের সুন্দর সুষ্ঠুভাবে বাঁচার জন্য রাষ্ট্র অনেক কাজ করে থাকে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক তত্ত্ববিদরা রাষ্ট্রকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনের জন্য কতিপয় পরিবার ও গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠনই ‘রাষ্ট্র’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর. এম. ম্যাকাইভারের মতে, ‘রাষ্ট্র হচ্ছে সরকার কর্তৃক প্রণীত আইন দ্বারা পরিচালিত একটি সংগঠন, যার কর্তৃত্বমূলক ক্ষমতা রয়েছে এবং যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসরত অধিবাসীদের ওপর বলবৎ হয়’। অধ্যাপক গার্নার রাষ্ট্রের সবচেয়ে সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র হলো বহুসংখ্যক ব্যক্তি নিয়ে গঠিত এমন এক জনসমাজ, যারা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যা বহির্শক্তির নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত এবং যাদের একটি সুসংগঠিত সরকার আছে, যে সরকারের প্রতি ঐ জনসমাজ স্বভাবতই অনুগত’

সুতরাং, আমরা বলতে পারি, রাষ্ট্র হলো একটি ভূখণ্ডভিত্তিক সমাজ বিশেষ, যার সংগঠিত সরকার ও জনসমষ্টি রয়েছে এবং যার নিজস্ব ভৌগলিক এলাকার মধ্যে অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত আছে।

রাষ্ট্রের উপাদান

রাষ্ট্রের ধারণা ব্যাখ্যা করলে আমরা রাষ্ট্রের চারটি উপাদান দেখতে পাই, যথা: জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। প্রত্যেক রাষ্ট্রই এ চারটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত।

জনসমষ্টি: রাষ্ট্রের প্রাথমিক উপাদান হচ্ছে জনসমষ্টি। জনসমষ্টি বলতে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনগণকে বোঝায়। রাষ্ট্র গঠনের জন্য জনসমষ্টি একান্ত অপরিহার্য। জনসমষ্টির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক হতে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। তবে রাষ্ট্র গঠনের জন্য জনসংখ্যা কত হতে হবে তার কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রের জনসংখ্যা কয়েক কোটি হতে পারে। আবার কয়েক হাজারও হতে পারে। গণচীন ও ভারতে জনসংখ্যা একশ’ কোটির উপরে। অন্যদিকে স্যানম্যারিনো ও মোনাকোর এ দুটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জনসংখ্যা যথাক্রমে ৩৩,২২৫ ও ৩৮ হাজার (২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী)।

নির্দিষ্ট ভূখণ্ড: নির্দিষ্ট ভূখণ্ড হচ্ছে রাষ্ট্রের অপরিহার্য দ্বিতীয় উপাদান। প্রত্যেক রাষ্ট্রই একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমারেখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। ভূখণ্ড বলতে স্থলভাগ, সমুদ্রসীমা, আকাশসীমাও বোঝায়। রাষ্ট্রের জনগণের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। জনসমষ্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধের মাধ্যমে অথবা সাংবিধানিকভাবে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিটি রাষ্ট্রই ভূখণ্ডের সীমানাকেন্দ্রিক নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে তোলে। ভূখণ্ড বড় বা ছোট হতে পারে, যেমন- রাশিয়ার আয়তন অনেক বড় আর ছোট আয়তনের রাষ্ট্র হলো- দারুস সালাম, সুইজারল্যান্ড, ব্রুনাই ইত্যাদি। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভূখণ্ডটি পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্থান পায়। অনেক সময় রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বেশ কয়েকটি দ্বীপের সমষ্টিও হতে পারে, যেমন- জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি।

সরকার: রাষ্ট্রের অপরিহার্য তৃতীয় উপাদানটি হলো সরকার। সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন আংশিকভাবে সম্পন্ন হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিনটি বিভাগ থাকে- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। এ তিন বিভাগের সমন্বয়ে সরকার গঠিত হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের সরকার গঠন করে। সরকার পদ্ধতি বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন হতে পারে। সরকার বলতে ব্যাপক অর্থে শাসকগোষ্ঠীর সকলকে বোঝায়, যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ক্ষমতা সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়। অধ্যাপক গার্নারের মতে, ‘রাষ্ট্র যদি হয় জীবদেহ তবে সরকার হলো এর মস্তিস্কস্বরূপ।”

সার্বভৌমত্ব: রাষ্ট্র গঠনের মুখ্য উপাদান সার্বভৌমত্ব বা সার্বভৌমিকতা। সার্বভৌম শব্দ দ্বারা চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতাকে বোঝায়। সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রের গঠন পূর্ণতা পায়। এ ক্ষমতা রাষ্ট্রকে অন্যান্য সংস্থা থেকে পৃথক করে। সার্বভৌমত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের ঐ বৈশিষ্ট্য যার ফলে নিজের ইচ্ছা ছাড়া অন্য কোন প্রকার ইচ্ছার দ্বারা রাষ্ট্র আইনসঙ্গতভাবে আবদ্ধ নয়। প্রত্যেক সমাজ ব্যবস্থায় চূড়ান্ত ক্ষমতা কার্যকর করার জন্যে একটি মাত্র কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ থাকবে। আর এ ক্ষমতাই হলো সার্বভৌম ক্ষমতা। সার্বভৌমের আদর্শই হলো আইন। আভ্যন্তরীণ ক্ষমতা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মধ্যকার সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। এই সার্বভৌম ক্ষমতার উর্ধেব কোন কর্তৃপক্ষ নেই। বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের অর্থ হলো রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহির্শক্তির নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে। কেবল জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সরকার থাকা সত্ত্বেও একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষমতা না থাকলে তা রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হবে না। যতদিন রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব বিদ্যমান থাকে ততদিন সার্বভৌমত্বের স্থায়িত্ব থাকবে। সরকারের পরিবর্তন সার্বভৌমত্বের স্থায়িত্বকে নষ্ট করে না।

সুতরাং, জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার এবং সার্বভৌমত্ব এ চারটি উপাদান নিয়েই রাষ্ট্র গঠিত হয়। এর যে কোন একটি উপাদান না হলে রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না।

আরও পড়ুন- জাতিসংঘ কেন গঠিত হয়েছিল? জাতিসংঘের উদ্দেশ্য কি?