আধুনিক রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার বলতে দলীয় সরকারকেই বোঝায়। রাজনৈতিক দল ব্যতীত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করা যায় না। রাজনৈতিক দলকে কেন্দ্র করেই জনমত গঠন, দলীয় আদর্শের প্রচার, সমর্থকগোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক সচেতন নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠে।
রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা
সাধারণ ভাষায়, রাজনৈতিক দল বলতে একটি সংগঠিত নাগরিক সমষ্টিকে বোঝায়, যারা দলীয় আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে জনমত গঠনের মধ্য দিয়ে বৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে।
অধ্যাপক গেটেল রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “রাজনৈতিক দল বলতে কমবেশি সংগঠিত একদল লোককে বোঝায়, যারা রাজনৈতিক এককরূপে কাজ করে এবং ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে চায়। সংগঠন, কর্মসূচি প্রদান ও ক্ষমতা অর্জন রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য।”
রাজনৈতিক দল সাধারণত একক কিংবা একদল বিশিষ্ট বা সৃজনশীল নেতৃত্বের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। সুতরাং এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, রাজনৈতিক নেতৃবর্গের মাধ্যমে নাগরিক সমস্যাকে চিহ্নিত করে, সেই সমস্যাগুলো সমাধানে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থায় জনমত গঠন এবং বৈধ উপায়ে সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত সংঘবদ্ধ একটি জনসমষ্টি হলো রাজনৈতিক দল। জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ ও উন্নতির পাশাপাশি সাংগঠনিক দৃঢ়তা এবং দলীয় সদস্যদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে রাজনৈতিক দল তৎপরতা প্রদর্শন করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার রাজনৈতিক দল সম্পর্কে বলেছেন, “যারা কতকগুলো সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সাংবিধানিক উপায়ে সরকার গঠন করতে চেষ্টা করে, সেই জনসমষ্টিকে রাজনৈতিক দল বলা হয়।”
সুতরাং, রাজনৈতিক দল এমন একটি জনসংগঠন যার সদস্যগণ রাষ্ট্রের সমস্যা সম্পর্কে ঐকমত্য পোষণ করে এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে গৃহীত কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হয়।
রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য
রাজনৈতিক দলের প্রধান উদ্দেশ্য হলো-
১। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে আদর্শগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কর্মসূচি ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা।
২। রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক কিছু নীতিমালা ও পরিকল্পনা জনগণের নিকট পেশ করে জনসমর্থনের সৃষ্টি করা।
৩। দলীয় নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করা এবং জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখা।
৪। বৈধ ও নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা
শক্তিশালী ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্যের প্রধান শর্ত। অধ্যাপক ফাইনার বলেছেন, “আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন কার্যত রাজনৈতিক দলের শাসন।” একটি রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক যে ধরনের সরকার ব্যবস্থাই বিদ্যমান থাকুক না কেন, সব ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব স্বীকৃত। বস্তুত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সর্বাধিক। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে তার আলোকে প্রতিটি রাজনৈতিক সংগঠন দলীয় নীতিমালা ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই নীতিমালা ও কর্মসূচি সাধারণত রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে উল্লেখ থাকে।
দলের নীতি ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জনগণকে জানানোর জন্য রাজনৈতিক দল সভা-সমিতি, টকশো আয়োজনসহ পত্র-পত্রিকায় মতামত ব্যক্ত করে তাদের নীতি ও কর্মসূচি প্রচার করে এবং জনসমর্থন সৃষ্টি করে।
দেশের জাতীয় নির্বাচনে দলের প্রার্থী মনোনয়ন এবং তার পক্ষে দলীয় প্রচারকার্য চালানো রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মনোনীত প্রার্থীদেরকে নির্বাচিত করার জন্য রাজনৈতিক দল তাদের সমর্থনে ব্যাপক নির্বাচনি প্রচারণা চালায়।
রাজনৈতিক দলের অন্যতম কাজ হচ্ছে নির্বাচনে জয়লাভের পর সরকার গঠন করা। সাধারণত নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, তারাই সরকার গঠন করে থাকে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে রাজনৈতিক দল তাঁর দলীয় নীতিমালা ও কর্মসূচির ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করে। নাগরিকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে যে সকল দল বা দলসমূহ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না তারাই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। বিরোধী দল পার্লামেন্টে বিতর্ক, সরকারের নীতির সমালোচনা, মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন এবং বিভিন্ন বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করে সংসদকে কার্যকর রাখে। সংসদের বাইরেও বক্তব্য, বিবৃতি ও সমালোচনার মাধ্যমে বিরোধী দল সরকারকে আইনের শাসণ অনুশীলনে সহায়তা করে। এছাড়া বিরোধী দল জনগণের সামনে সরকারের পাশাপাশি বিকল্প কর্মসূচি তুলে ধরে। তাই গঠনমূলক সমালোচনা এবং কার্যকর ভূমিকা রাখা বিরোধী দলের অন্যতম দায়িত্ব।
রাজনৈতিক দলের সদস্যরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় জনগণের মাঝে মিশে থাকে। সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তসমূহ মানুষের কাছে তুলে ধরে। জনগণ তাদের মতামত ও অভিযোগ রাজনৈতিক দলের সদস্যবৃন্দের মাধ্যমে সরকারের নিকট উত্থাপন করে এবং সরকারের করণীয় দাবি করে। মূলত রাজনৈতিক দল সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বা সেতুবন্ধন রচনা করে।
রাজনৈতিক দল যে কোন স্বাধীন দেশের নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলে। পরাধীনতা থেকে মুক্তি এবং স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক দল গণআন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করে। যেমন- বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে আওয়ামী লীগ আন্দোলন- সংগ্রাম পরিচালনা করেছে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অপরিহার্য। জনগণের অভাব, অভিযোগ, দুঃখ-দুর্দশাকে চিহ্নিত করে তারা সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে কর্মসূচি প্রণয়ন করে। এছাড়া সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দল হলো বিকল্প সরকার। সরকার সমর্থন হারালে বা কোন কারণে পতন হলে বিরোধী দলের ক্ষমতা লাভ বা সরকার গঠনের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুন- প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি
আরও পড়ুন- রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলি, রাষ্ট্রপতির জরুরি ক্ষমতা
আরও পড়ুন- জাতীয় সংসদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি