এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।
বাস্তবতার নিরিখে এই বাক্য খুব একটা ধোপে টেকে না। রূপকথার দিন ফুরিয়েছে, ভাগ্যবান কাঠুরের গল্পও এখন বড্ড অচল। সময়টা পরিশ্রমের, আত্মবিশ্বাসের, ভেঙে পড়লেও মাথা তুলে দাঁড়াবার।
‘নেপোটিজমে’র দায়ে অপরাধী বলিউডে রাজকুমার রাও ‘বহিরাগত’ই; তবে তাঁর উত্থানই বলে দেয় অধ্যবসায়ে প্রতিকূলতাও খড়কুটো।
২০০৮ সালে তাঁর মুম্বাই যাত্রা। তখন থেকেই হন্যে হয়ে অডিশনের পর অডিশনে দাঁড়িয়েছেন। মেক আপের নখরা জানতেন না একটুও, স্রেফ গোলাপ জল ছিটিয়েই দাঁড়াতেন অডিশনের লম্বা লাইনে।
২০১০ সালে দিবাকর ব্যানার্জির ‘Love Sex Aur Dhoka’ এর বদৌলতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখেন রাজকুমার রাও। তবে এর পেছনে সাহস আর শ্রমও ছিল নজরকাড়া।
‘১০০ কোটি কামানো প্রযোজকের লক্ষ্য হতে পারে,আমার নয়। ভারতের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অভিনেতার তালিকায় নাম ওঠানোতেই আমি মনোযোগি।‘
পুনের ফিল্ম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া থেকে হাতেকলমে অভিনয় শিখে আসা অভিনেতা রাজকুমার। নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরি ,ইরফান খান, শাবানা আজমির মতো রথি মহারথির নাম জড়িত এই প্রতিষ্ঠানের সাথে। থিয়েটারেও ছিলেন পরিচিত মুখ। তবে ফিল্মি দুনিয়ায় যে এ পরিচয়ে সুবিধে হয় না তা আত্মস্থ-কণ্ঠস্থ করে নিয়েছিলেন আগেভাগেই।
তখন শ্রী রাম সেন্টার থিয়েটারের ব্যস্ত কর্মী, দিল্লীর পথে পথে ঘুরতেন প্রচুর, লক্ষ্য করতেন প্রতিটি মানুষের হাঁটাচলার ভঙ্গিমা, তাদের আচরণ, ক্ষোভ- আশার বিবিধ। দিনশেষে নোটবুকে টুকে রাখতেন সব। পর্যবেক্ষক হিসেবে এই ‘ইনভেস্টমেন্ট’ই রাজকুমার রাওকে এগিয়ে রাখে সমসাময়িক অন্যান্য অভিনেতাদের থেকে।
অডিশনে বাদ পড়েছেন কত বার? প্রশ্নের জবাবে বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতেই উত্তর দেন, ‘অনেক অনেক বার। এমনকি অডিশনও দিতে পারিনি, এমনটাও হয়েছে। বহুবার সাইড রোল বা ছোট চরিত্রে কাজের পরামর্শও পেয়েছি। মুম্বাইয়ে এলেই কেউ আমাকে সাদরে টেনে নেবে না, সংগ্রাম করতে হবে- এটা জানতাম। তাই ভেঙে পড়িনি। দাঁত চেপে প্রত্যাখান সহ্য করেছি।‘
অডিশনের প্রসঙ্গে তেতো মিঠে কিছু অভিজ্ঞতাও উঠে আসে। মুম্বাইয়ে এক ফ্ল্যাটে তিন বন্ধু ভাগাভাগি করে থাকতেন। এমনও দিন গেছে যখন হাতে মাত্র ১৮ টাকা নিয়ে মাস চালাতে হয়েছে। দুঃসময়ে সহায় ছিল বন্ধুরাই। খাবার থেকে শুরু করে শার্ট অব্দি ভাগ করে চলতেন।
২০০৯ সালেই ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে। LSD এর জন্য নতুন মুখের সন্ধানে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন পরিচালক দিবাকর ব্যানার্জি। সেই বিজ্ঞাপন দেখেই ধর্না দিয়েছেন কাস্টিং ডিরেক্টর অতুল মঙ্গিয়ার কাছে। জোঁকের মত দিন রাত লেগে থেকেই শেষমেশ বগলদাবা করেন LSD এর আদর্শকে। মাত্র ১১ হাজার রুপি পারিশ্রমিকও তখন ছিল আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতো।
এর মাস কয় বাদেই ‘Ragini MMS’ (2011) এ কাজের সুযোগ মেলে। অনাকাঙ্ক্ষিত সাফল্যের পর রিমা কাগতি, অনুরাগ কাশ্যপের মত আর্ট ডিরেক্টরদের সুনজরে পড়ে যান। ‘Gangs of Wasseypur’ (2012) এ অভিনয় করবার সময়ই হানসাল মেহতার কাছে অনুরাগ নাম পাড়েন রাজকুমারের। ওতেই অনবদ্য এক জুটি সৃষ্টি!
Shahid (2012) দিয়ে হানসাল–রাজকুমার যুগলবন্দীর সূচনা। সেই সৃষ্টিসুখের উল্লাসে একে একে এলো Aligarh (2015), Omerta (2017), Citylights (2014) ইত্যাদির মত বাঘা বাঘা সব সিনেমা। জাতীয় পুরস্কারও ইতোমধ্যে শোকেসে শোভা পেয়ে গেল রাজের।

ড্যানিয়েল ডে লুইসের পাঁড় ভক্ত রাজকুমার রাও। পেশাগত জীবনেও তাঁকেই অনুসরণ করেন। রাজকুমারের মতে, একমাত্র পর্যবেক্ষণেই পরিণত হন একজন অভিনেতা।
তবে এতদূর আসার পেছনে শাহরুখ খানকে অনুপ্রেরণা মানেন। মান্নাতের দরজায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন অগুনতি দিন। শাহরুখের অধ্যবসায়ী যাত্রাতেই আশা খুঁজে পেতেন মার্শাল আর্ট আর নাচে পারদর্শী এই অভিনেতা।
‘শহীদ’, ‘নিউটন’, ‘সিটিলাইটস’, ‘ট্র্যাপড’ প্রভৃতির মত জলদ গম্ভীর ছবিতে যেমন মেধার ছাপ রেখেছেন তেমনি ‘বারেলি কি বারফি’, ‘লুডো’, ‘মেড ইন চায়না’, ‘ডলি কি ডোলি’, ‘স্ত্রী’, ‘রুহি’র মত ছবির কমেডিক রোলেও উজাড় করে দিয়েছেন নিজেকে। তাইতো চলচ্চিত্রবোদ্ধা থেকে স্রেফ বিনোদনপ্রেমির ‘ফেভারিট লিস্টে’ এক ও অদ্বিতীয় রাজকুমার।
তবে প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা হবার পরও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। বড় বাজেটের ছবিতে চুক্তিবদ্ধ করবার পরেও তাঁকে বাদ দেয়ার অভিযোগ আছে। নানান সূত্রমতে, আনুশকা শর্মার হস্তক্ষেপেই নাকি NH10 থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল এই শিল্পীকে।
সিক্স- এইট প্যাকের ঝকমারি নেই, নেই নামের শেষে খান-কাপুর-বচ্চনদের মত পদবী। তাহলে এই সদর্পে রাজ্য জাঁকিয়ে বসবার সূত্র কী? এক শব্দেই উত্তর আসে- সততা। হ্যাঁ, সততাই! ক্যামেরার সামনে সৎ থাকেন বলেই দর্শকের চোখে এতটা আপন তিনি।
সবিস্তারে বলেন, ’জনতার সাথে যোগসূত্র স্থাপন করাই মূল কথা। যে চরিত্রেই কাজ করি না কেন, আমার লক্ষ্য থাকে ক্যামেরার সামনে সত্যটাকে তুলে ধরা। চরিত্রের ভাষা, উচ্চারণ, জীবন যাপনের ধরণ, দর্শন সবকিছুই নখদর্পণে রাখি। শুটিংয়ের সময় তাই খেয়ালই থাকে না অভিনয় করছি। নিমগ্ন হয়ে শুধু সেই মানুষটার জীবনটাকে ফুটিয়ে তুলি।‘
আপাতদৃষ্টে বেশ সহজই মনে হয় রাজকুমারের দর্শনকে। তবে দুমুখো তলোয়ারের মত ভালোমন্দ উভয় দিকই আছে এর। উদাহরণ দিলেন নিজেই।
‘Omerta এর জন্য আহমেদ ওমর সাঈদ শেখের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি, জীবন দর্শনকে বোঝার চেষ্টা করেছি। প্রচুর জিহাদি বই পড়েছি, ভিডিও দেখেছি। এর ফলাফল আমার ব্যক্তি জীবনেও পড়েছিল। প্যারিস এটাক (২০১৫ সালে ফ্রান্সে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা) এর সংবাদ যখন টেলিভিশনে দেখি, আমার প্রাথমিক অনুভূতি ছিল ‘সাবাশ’!’

আজীবন নিরামিষাশী হলেও ‘Trapped’ (2016) এর জন্য পোড়া কবুতর খেয়েছিলেন প্রজন্মের সেরা এই অভিনেতা। অন্যদিকে শহীদ আজমির আত্মস্থ করতে উলঙ্গ হয়েও দাঁড়িয়েছিলেন ক্যামেরার সামনে। ভেবে দেখুন, কতটা নিবেদিত হলে ক্যারিয়ারের কুঁড়িতেই এতটা সাহস দেখানো সম্ভব!
কমেডি ড্রামা ফিল্ম ‘বাধাই হো’ (২০১৮) এর সিকুয়েল ‘বাধাই দো’ তে রাজকুমার রাও জুটি বেঁধেছেন ভূমি পেদনেকারের সাথে। তারই প্রস্তুতি চলছে বর্তমানে। পাশাপাশি ২০২০ সালের তেলেগু ছবি ‘হিট’–এর বলিউড রিমেকেও থাকছেন।
‘আজকের দিনে অলৌকিক কিছু হয় না। আমাদের মত সাধারণ মানুষের বেলাতে তো আরও না। তাই আমার পরামর্শ , নিজেকে ক্রমাগত ঝালাই করে নিন। সাফল্যের উচ্চ শিখরে যদি আমি আসতে পারি, আপনিও পারবেন।‘

গুরগাঁও এর মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই দেখেছিলেন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। দশম শ্রেণি পড়ুয়া রাজকুমার যাদব তখনই এঁকে নিয়েছিলেন জীবনের ছক। নিষ্ঠার প্রতিফলনে তো আজ গোটা ভারত সাক্ষী। সাফল্যের ইঁদুরদৌড়ে পর্দার সুভাষ বোস কি কখনো হতাশ হন নি?
রাজকুমার রাও একগাল হেসে বলেন, ‘না। কেন হবো? আমার ফিলোসফি যে রক্তের গ্রুপের মতোই- বি পজিটিভ!’
আরও জানতে দেখুন রাজকুমার রাওয়ের সাক্ষাৎকার। ক্লিক করুন নিচের লিংকে-
আরও পড়ুন-
আয়নাবাজি থেকে প্রযোজকের আয় মাত্র ১২ লাখ টাকা!!!
দাঙ্গালের ৬০০ কোটির ব্যবসা, ১৭৫ কোটিই নেন আমির