প্রকৃতিতে মাত্র চার রকমের মৌলিক বল বিদ্যমান। এই সব বল সম্পর্কে জানার আগে বল কাকে বলে ও মৌলিক বল কাকে বলে সেটি জেনে নেয়া প্রয়োজন।
আমরা নিউটনের প্রথম সূত্রে “বল” শব্দটির প্রয়োগ দেখতে পাই। নিউটনের প্রথম সূত্রটি এমন, “বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থির থাকবে এবং সমবেগে চলতে থাকা বস্তু সমবেগে চলতে থাকবে।”
নিউটনের এই প্রথম সূত্রটাই হতে পারে বল ও জড়তার সংজ্ঞা।
বলঃ যে কারণে স্থির বস্তু চলতে শুরু করে আর সমবেগে চলতে থাকা বস্তুর বেগের পরিবর্তন হয় সেটাই হচ্ছে বল।
বলের একক- বলের এফ.পি.এস একক পাউন্ডাল এবং এস.আই একক নিউটন।
বলের মাত্রা, [F] = MLT-2
জড়তাঃ বল প্রয়োগ না করা পর্যন্ত স্থির বস্তুর স্থির থাকার যে প্রবণতা কিংবা গতিশীল বস্তুর গতিশীল থাকার যে প্রবণতা তাকে জড়তা বলে।
মৌলিক বল
পৃথিবীতে অসংখ্য ধরণের বল আছে। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এই সব বলই ঘুরে ফিরে চারটি মৌলিক বলের অন্তর্ভুক্ত। এই চারটি মৌলিক বল হল- মহাকর্ষ বল, তড়িৎ চৌম্বক বল বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল, দূর্বল নিউক্লীয় বল, সবল নিউক্লীয় বল।
মৌলিক বলের সংজ্ঞা আমরা এভাবে বলতে পারি, “যে সব বল অন্য কোন বল থেকে সৃষ্টি হয় না বরং অন্যান্য বল এই সকল বল থেকে সৃষ্টি হয়, তাদেরকে মৌলিক বল বলে।”
১। মহাকর্ষ বল (Gravitation)
এই সৃষ্টিজগতের সকল বস্তু তাদের ভরের কারণে একে অপরকে যে বল দিয়ে আকর্ষণ করে সেটাই হচ্ছে মহাকর্ষ বল। এই মহাকর্ষ বলের কারণে আমাদের পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরে, চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে। পৃথিবীর মহাকর্ষ বল যখন আমাদের ওপর কাজ করে আমরা তখন সেটাকে মাধ্যাকর্ষণ বলি। এই মাধ্যাকর্ষণ বল আমাদেরকে নিচের দিকে টেনে রেখেছে এবং এই কারণেই আমরা নিজেদের ওজনের অনুভূতি পাই।
২। তড়িৎ চৌম্বক বল বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল (Electro Magnetic Force)
তড়িৎ বা বিদ্যুৎ এবং চুম্বকের বলকে আলাদা ধরণের বলে মনে হলেও এই দুটি আসলে একই বল। শুধুমাত্র দুইভাবে এদের দেখা যায়। চারটি মৌলিক বলের মধ্যে শুধুমাত্র এই বলটি আকর্ষণ ও বিকর্ষণ দুটিই করতে পারে। অন্যান্য মৌলিক বলগুলো শুধু আকর্ষণ করতে পারে, কিন্তু বিকর্ষণ করতে পারে না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তুলনায় তড়িৎ চৌম্বক বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল 1036 গুণ বেশি শক্তিশালী। আমরা অনেকেই চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে সেটা দিয়ে কাগজের টুকরোকে আকর্ষণ করা বা একটি চুম্বক দিয়ে অন্য চুম্বককে আকর্ষণ-বিকর্ষণ করার কাজটি করেছি। যখন চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে একটা কাগজ আকর্ষণ করা হয় তখন কিন্তু সেই কাগজটাকে পুরো পৃথিবী তার সমস্ত ভর দিয়ে তৈরি মাধ্যাকর্ষণ বল দিয়ে টেনে রাখার চেষ্টা করে। চিরুনির অল্প একটু বিদ্যুৎ সেই বিশাল পৃথিবীর পুরো মাধ্যাকর্ষণ বলকে হারিয়ে দেয়।
৩। দূর্বল নিউক্লীয় বল (Weak Nuclear Force)
এই বলকে দূর্বল বলা হয় কারণ এটা তড়িৎ চৌম্বক বল থেকে প্রায় ট্রলিওন গুণ দূর্বল, কিন্তু মহাকর্ষ বলের মতো এত দূর্বল নয়। মহাকর্ষ এবং তড়িৎ চৌম্বক বল যে কোনো দূরত্ব থেকে কাজ করতে পারে কিন্তু এই বলটা খুবই অল্প দূরত্বে (10-18m) কাজ করে। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে যে বেটা ( β) রশ্মি বা ইলেকট্রন বের হয় সেটার কারণ এই দূর্বল নিউক্লীয় বল।
৪। সবল নিউক্লীয় বল (Strong Nuclear Force)
সবল নিউক্লীয় বল হচ্ছে সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী বল। সবল নিউক্লীয় বল তড়িৎ চৌম্বক বল থেকে একশগুণ বেশি শক্তিশালী। কিন্তু এই বলটিও খুবই অল্প দূরত্বে (10-15m) কাজ করে। পরমাণুর কেন্দ্রে যে নিউক্লিয়াস রয়েছে তার ভেতরকার প্রোটন এবং নিউট্রনের মাঝে এই প্রচণ্ড শক্তিশালী বল কাজ করে নিজেদের আটকে রাখে। প্রচন্ড বলে আটকে থাকার কারণে এর মাঝে অনেক শক্তি জমা থাকে তাই বড় নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে কিংবা ছোট নিউক্লিয়াসকে জোড়া দিয়ে অনেক শক্তি তৈরি করা সম্ভব। নিউক্লিয়ার বোমা ঠিক এ কারণেই এত শক্তিশালী। সূর্য থেকে আলো তাপও এই বল থেকে তৈরি হয়।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে এই চার ধরণের মৌলিক বল আসলে একই সূত্রে গাঁথা। তাই তারা সবগুলো মৌলিক বলকে এক সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে তড়িৎ চৌম্বক এবং দূর্বল নিউক্লিয়ার বলকে একই সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে। অন্যান্যগুলোকে এক সূত্রে গাঁথার জন্য এখনো বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন- প্লুটো কেন গ্রহ নয়?