in

মুহম্মদ জাফর ইকবাল সব সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলেন কেন?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার নানা পরিচয়ে পরিচিত। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, কথা সাহিত্যিক, কলাম লেখক, হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই এমন নানা পরিচয়ে স্যারকে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়। নিয়মিত ছোটদের জন্য লেখার কারণে তিনি ছোটদের কাছে আলাদাভাবে ব্যাপক জনপ্রিয়। শিশু-কিশোরদের বিজ্ঞান ও গণিতে আগ্রহী করে তুলতে স্যারের যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা সেটিকেও ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। তবে এত সব পরিচয় ছাপিয়ে স্যারকে একদল লোক চেনে আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থক হিসেবে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাফর ইকবাল স্যারের লেখা কলাম শেয়ার হওয়ার সাথে সাথে কমেন্ট বক্সগুলো গালিগালাজ দিয়ে ভরে যায়। তবে এটা বলা বাহুল্য যে, এই সব কমেন্ট প্রদানকারী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্যারের লেখা না পড়েই কমেন্ট করেন।

জাফর ইকবাল স্যারের লেখার সাথে যারা দীর্ঘ দিন ধরে পরিচিত তারা অন্তত জানেন সজ্ঞানে অন্যায় মেনে নেয়ার মানুষ তিনি নন। কিন্তু দেশের সর্বশেষ দুই “আলোচিত” নির্বাচন, গণতন্ত্র, বিরামহীন দুর্নীতি নিয়ে স্যারকে তেমন লিখতে দেখা যায় না। তবে এটি ঠিক স্যার ফেরেশতা নন। সবার মন জুগিয়ে চলা সম্ভবও নয়। ভুল-ত্রুটি উনারও থাকবে। সমস্যা হলো স্যারের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বেশি। তারা নিজে যা ভাবেন, যা বলতে চান, সেটি তারা স্যারের মুখে শুনতে চান। ঝামেলাটা এখানেই।

সে যাইহোক, জাফর ইকবাল স্যার কেন সব সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলেন এটি নিয়ে অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও চৌকস উপস্থাপিকা নবনীতা চৌধুরীর রাজকাহন অনুষ্ঠানে জাফর ইকবাল স্যার এই ব্যাপারে বিস্তারিত বলেছেন। নবনীতা চৌধুরী অকপটে জাফর ইকবাল স্যারকে প্রশ্ন করেছেন। কোন রকম ভনিতা না করে জাফর ইকবাল স্যার সব প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন। আগ্রহী পাঠকদের জন্য সেই অনুষ্ঠানের চুম্বক অংশ তুলে ধরছি।

নবনীতা চৌধুরীঃ ধরুন, আপনি মুক্তিযুদ্ধের আলো প্রতীয়মান হয় তেমন রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আর আপনার এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে যদি একদল লোক ভাবে আপনি সরকারী দল কিংবা আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলটির একজন অন্ধ সমর্থক তবে তাদের উদ্দেশ্যে আপনি ঠিক কি বলবেন। তাছাড়া অনেকে মনে করেন আওয়ামীলীগ শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিটাই করছে।

জাফর ইকবালঃ আওয়ামী লীগ যে সবসময় মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি করছে তা না কিন্তু। আমাদের পাঠ্যবইগুলো হেফাজত ইসলামের দাবীর প্রেক্ষিতে পরিবর্তন করে দেওয়া হল। মানে তারা হেফাজত ইসলামের সাথে এক ধরনের আপোষে চলে গেল৷ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিন্তু তা না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ছিল সব ধর্মের মানুষ একসাথে থাকবে৷ কাজেই আওয়ামী লীগ যে সবসময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছে সেটা না। কিন্তু অন্য যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে তারা তো সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা দলগুলো নিয়ে কাজ করছে। কাজেই তাদের জন্য আমার মায়া কেন থাকবে আমি কি সেটা জিজ্ঞেস করতে পারি?

২০০১ সালে নির্বাচন হল সেখানে জামাত ইসলামি ক্ষমতায় চলে আসলো। মতিউর রহমান নিজামী, মোজাহিদ তারা মন্ত্রী হয়ে গেল। দেশের পতাকা লাগিয়ে তারা গাড়িতে করে ঘুরে বেরালো। আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের যারা জবাই করেছে, তারা দেশের মন্ত্রী হয়ে গেল সেটা কি আমাকে সহ্য করতে হবে? সে রাজনৈতিক দলগুলোকে লেভেল ফিল্ড বলে আমাকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে যেন দুজনকে সমানভাবে দেখতে হবে, কেন? আমি সেটা তো বুঝতে পারিনা। নির্বাচনের সময় আমি বলি যে সবাই সমানভাবে থাকবে। কিন্তু কারা নির্বাচন করছে আমি সেদিকে তাকাতে পারবোনা, তার আগের স্টেজে যেতে পারবো না? তুমি কেন নির্বাচন করছো? তোমারতো নির্বাচন করার কথা না। তোমারতো জেলখানায় থাকার কথা। পৃথিবীর কোন দেশে যারা স্বাধীনতা বিরোধী তারা তো রাজনীতি করে না। তুমি কেন রাজনীতি করতে এসেছ এখানে?  সেখানে কি আমি আপত্তি করতে পারিনা?

জাফর ইকবাল স্যারের এই অসাধারণ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন নবনীতা চৌধুরী।

নবনীতা চৌধুরীঃ এই যে জামাত ইসলামের রাজনীতি টিকিয়ে রাখা, জামাত ইসলামকে এখনো নিষিদ্ধ না করা, এর মধ্যে আপনি কোন রাজনীতি দেখেন কিনা।

জাফর ইকবালঃ থাকতে পারে। আমি আসলে রাজনীতি সেভাবে বুঝিনা, তাই আমি সেটা বিশ্বাসও করতে পারবো না। আমি সাদা চোখে দেখি। এই একটা রাজনৈতিক দল, তারা এদেরকে নিয়ে রাজনীতি করছে। কাজেই এটি আমি কোনভাবে সমর্থন করতে পারবো না। আমি তাদেরকে বলবো, তোমরা এদেরকে ছেড়ে দাও, তোমরা আলাদাভাবে রাজনীতি কর, তখন আমি তোমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবো, তার আগে না।

নবনীতা চৌধুরীঃ আপনার এক বক্তব্যকে সমালোচনা করে গত বছর প্রখ্যাত এক সাংবাদিকের একটি লেখা পড়ছিলাম। তিনি বলছিলেন, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এভাবে সে দলে পড়ে গেছেন যে (দল ভাবে) আওয়ামী লীগ গেলেই বিএনপি জামাত ক্ষমতায় চলে আসবে। কাজেই আওয়ামী লীগকে যে কোন কিছু করতে দেওয়া বা আসকারা দেওয়া (যায়)। এই অভিযোগটা বাংলাদেশের প্রগতিশীল লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী আমরা যাদেরকে বলে এসেছি তাদের বিরুদ্ধে আছে অর্থাৎ সুশীল সমাজের একটা কথা অংশের বিরুদ্ধে আছে। আওয়ামী লীগ গেলেই জামাত শিবির আসবে সে আতংকে আওয়ামী লীগকে সব কিছুতে এক ধরনের বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। এটা আপনি আওয়ামী লীগের জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে এক ধরনের সমস্যা বলে মনে করেন কিনা?

জাফর ইকবালঃ মানে, আমি তো সেভাবে বিশ্বাস করতে পারবো না৷ কাজেই আমি মনে করি যে জামাত বিএনপি বলছি আমরা। কিন্তু বিএনপি নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। জামাত কেন ক্ষমতায় আসবে? কাজেই জামাত যদি ক্ষমতায় আসে, যে রাজনীতিতে জামাত ক্ষমতায় আসতে পারে সে রাজনীতিতে আমার কোন আগ্রহ নেই। জামাতকে সরিয়ে দাও। আমরা কেন এই জিনিসটা বোঝাতে পারিনা৷

আওয়ামীলীগ একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। ছাত্রলীগ যে পরিমাণ উৎপাত করে, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনগুলো অন্য জায়গায় হয়, ডাকসু নির্বাচন যদি অন্য জায়গায় হয় কোন জায়গাতে কিন্তু ছাত্রলীগ জেতার কথা না। আমি সাধারণ ছাত্রদের কথা বলি তো। কিন্তু, আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে তো প্রচুর মানুষজন আছে নানান ধরনের কাজকর্মের জন্য। ব্যাংকগুলো ঠিক মত পরিচালনা করতে পারছেনা। দেশের অসংখ্য টাকা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

গ্রাউন্ড লেভেলে যেসব মানুষজন কাজ করে তাদেরকে নানাভাবে উৎপাত করা হচ্ছে। সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনা না করার জন্য যাদের মধ্যে এক ধরনের বিরোধিতা আছে তারাও তো নির্বাচনের সময় আওয়ামী বিরোধিতা করে নাই। কি কারণে? একটা যদি সুষ্ঠ রাজনৈতিক দল থাকতো যেখানে জামাত নাই, যেখানে স্বাধীনতা বিরোধী নাই। সেখানে কি অসংখ্য মানুষ যেত না? একটা পরিষ্কার, সুষ্ঠ রাজনীতি কি হতে পারতো না? এই মূহুর্তে আমি বলতে চাই, আমি এমন একটি রাজনীতি চাই যেখানে সরকারি বিরোধী উভয় দলই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করবে৷

সমস্যাটা কি আমি ঠিক বুঝিনা। জামাত ইসলামকে সাথে রাখতে হবে কি জন্য? আমি যখন প্রথম দেশে এসেছি, ১৯৯৪ সালে। আমি যখন শাহাজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে  গেলাম তখন ছাত্রদল সংসদের দায়িত্বে ছিল৷

নবনীতা চৌধুরীঃ স্যার আপনার ইউনিভার্সিটি মানে শাহাজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে  কি এখন ছাত্রদল আছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েতো বছর দশেক ধরে নাই।”

জাফর ইকবালঃ প্রকাশ্যে নাই তারা৷ সেখানে (১৯৯৪ সালে) তারা স্পিচের আয়োজন করেছিল রাজাকারদের উপর। রাজাকাররা কত খারাপ তার উপর। যে ছেলেটা বক্তব্য রেখেছে শিবিরের এক ছেলে তাকে ছুরিঘাত করে। আমি সে ঘটনার তদন্ত করলাম। শিবিরের সে ছেলেটি দোষী সাব্যস্ত হলো তাকে শাস্তি দেওয়া হলো এবং ছাত্রদলের সে ছেলেটি প্রাণে রক্ষা পেল। ঘটনাটি ছিল এমন।

তারপর বিএনপি ও জামাত একত্রিত হয়ে গেল। যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি তখন দেখি সে ছেলেটি যে শিবিরের হাতে চাকু খেয়েছে, সে এবং শিবিরের ছেলেটি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। এখন আমার দুঃখটা হচ্ছে সেখানে। একটা দল ছিল তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল ছিল। যখন নাকি জামাতের সাথে বিএনপি একত্র হলো তখন সে ছাত্রগুলো আমার কাছে এসে চোখের জল ফেলছিল। বলেছিল স্যার এটা কি হলো৷ কেমন করে শিবিরের সাথে আমরা একত্রে থাকবো। সে দলটাকে নষ্ট করা হল।

আমি জানি অনেকে আছে যারা নাকি একদমই বিএনপিকে সহ্য করতে পারেনা, তারা বলেন বিএনপি আর জামাত নাকি একই ব্যাপার। আমি কিন্তু এত খারাপভাবে দেখিনা। কারণ আমি দেখিছি ঐ ছেলেগুলোকে যারা শিবিরের বিরুদ্ধে রাজনীতি করেছে৷ আমি কল্পনা করি বাংলাদেশের একটি বিরোধী দল যেখানে জামাত থাকবেনা।