in

মুন্সিগিরিঃ আয়নাবাজি ম্যাজিক নাকি নিষ্প্রভ থ্রিলার?

অমিতাভ-চঞ্চল জুটির কারিশমায় কতটা মুগ্ধ দর্শক?

মুন্সিগিরিঃ আয়নাবাজি ম্যাজিক নাকি নিষ্প্রভ থ্রিলার?
মুন্সিগিরিঃ আয়নাবাজি ম্যাজিক নাকি নিষ্প্রভ থ্রিলার?

‘মৃত্যু চিহ্নিত এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই বুঝে ওঠা যায় না। কোন কিছু বুঝে উঠতে গেলে শিল্পের আশ্রয় নিতে হয়।‘

সেই শিল্পেরই এক অতি প্রিয় মাধ্যম চলচ্চিত্র। ২০১৬ সালে ‘আয়নাবাজি’ এক রকম দেশি সিনেমা শিল্পকে বাঁচিয়েই দিয়েছিল বলা যায়। অন্তত দর্শককে হলমুখী করবার একটা দশাসই প্ররোচনা দেখা গিয়েছিল তখন। সময় গড়িয়েছে, দেশের হল সংখ্যা নেমেছে ১৪০- এ, যার ভেতর সচল সাকুল্যে ৬২টি,  করোনা মহামারিতে রদবদল ঘটেছে বিনোদন মাধ্যমেও।

তবে পাঁচ বছর আগে সেই অমিতাভ-চঞ্চল জুটির চাঞ্চল্য জেলি ফিশের মতো ভুলে যায়নি দর্শক। তাই নয়া প্ল্যাটফর্ম চরকি’তে ৩০ সেপ্টেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মুন্সিগিরি’ ঝড় তুলেছে ঠিকই।

ঝানু অভিনেতার সন্নিবেশ, রোমাঞ্চকর গল্প থাকলেই কি সফল বলা যায় নতুন এই ওয়েব-ফিল্মটিকে? চলুন হালকা আলাপচারিতা হোক শহরের এনালগ গোয়েন্দা মাসুদ মুন্সিকে নিয়ে।

মুন্সিগিরি কাহিনি সংক্ষেপ

তেজগাঁও রেললাইনে মেলে তিতাস গ্যাসের এক কর্মকর্তার লাশ। রেলের তলে ফেলে লাশটিকে একেবারে লাপাত্তা করাই ছিল খুনির উদ্দেশ্য। কিন্তু কেন এই খুন? ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব না রাজনৈতিক প্রতিহিংসা?

ঘটনার চার মাস বাদে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে হস্তান্তরিত হয় মামলাটি। ডিজিটাল কর্মকর্তাদের এড়িয়ে স্রেফ মামলার এজাহার দেবার তাগিদটাই পড়ে গোয়েন্দা মাসুদ মুন্সির ঘাড়ে। সন্দেহের তীর প্রখ্যাত লেখক ইশতিয়াক মির্জার দিকে। কেননা, খুনের সমস্ত মোটিভ, আলামত, প্রক্রিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত আছে তারই লেখা ‘বাদল বক্স’ বইয়ে। আর খুন হওয়া কর্মকর্তার গোপন নামও সেই বাদল বক্স।

রহস্য ঘনীভূত হবার আগেই কাজে নেমে পড়েন পর্যবেক্ষণ পিয়াসি মাসুদ মুন্সি। ঢেলে সাজান সমস্ত ক্লু,  যোগাযোগ করেন নিহত কর্মকর্তার স্ত্রী সুরাইয়ার সাথে। তবে তোপসের ভূমিকায় পাশে পান স্ত্রী পারভিনকে। স্বল্প সময়েই টুকরো টুকরো ক্লুর সাহায্যে আবিষ্কার করেন সুদীর্ঘ আর্তনাদ ও প্রতিশোধের নেপথ্য সত্য।

ছবির মহরতে অমিতাজ রেজা চৌধুরীর সাথে মূল দুই কুশীলব; Photo: প্রথম আলো
ছবির মহরতে অমিতাজ রেজা চৌধুরীর সাথে মূল দুই কুশীলব; Photo: প্রথম আলো

যা কিছু ভালো

বিশ্ব এখন উন্মুক্ত। বিনোদনের পাখা এখন নেচে বেড়াচ্ছে উত্তর থেকে পশ্চিমে, পূর্ব থেকে দক্ষিণ দিগন্তে। নেটফ্লিক্স, এমাজন, হটস্টার, এপল টিভি, হইচই এত এত নামের ভিড়ে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠাটা মুশকিল। তবুও বাংলাদেশি বিনোদন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রত্যাশার আবাহন নিয়েই যাত্রা ‘চরকি’র।

তথাকথিত ইউটিউব নাটকের ফর্মুলা থেকে দর্শককে মান সম্পন্ন, চিন্তাশীল কন্টেন্ট প্রদানের প্রতিশ্রুতি নিয়েই রেদোয়ান রনির নেতৃত্বে হাঁটি হাঁটি পা করে এগুচ্ছে এটি।

ক্রমশ জটিলতার বলয়ে আষ্ঠে পৃষ্ঠে যাচ্ছে জীবন, সে নগরই হোক বা গ্রাম। সারল্যের অভাব যখন পদে পদে, তখন অমিতাভ রেজা লিনিয়ার ছন্দেই মুন্সিগিরিতে বলতে চেয়েছেন মাসুদ মুন্সির মুনশিয়ানা। রহস্যের জট খুলেছেন সাবধানে, সব শ্রেণির দর্শকের কথা মাথায় রেখে। বাড়াবাড়ির ছাঁচে না ফেলে স্বভাবগত গতিতেই এগুতে দিয়েছেন গল্প।

মাসুদ মুন্সি মানুষটাও আপাদমস্তক সাধারণ। নির্মাতা আর লেখক কেউই এই পুলিশ চরিত্রকে অতি মানবীয় পর্যায়ে ফেলেন নি। ফেলু মিত্তির, ব্যোমকেশ,  শার্লক কোন আকারে না টেনে ছাপোষা চাকরিজীবী হিসেবেই তাকে পর্দায় এনেছেন। এত এত রেফারেন্স এড়িয়ে মানবীয় চরিত্র নির্মাণ প্রশংসার যোগ্য।

স্বল্প সময়েই নজর কেড়েছেন শহিদুজ্জামান সেলিম; Photo: Chorki
স্বল্প সময়েই নজর কেড়েছেন শহিদুজ্জামান সেলিম; Photo: Chorki

অমিতাভম্যাজিক উধাও?

‘পরিচালক যদি সচেতন শিল্পী হন, তবে তাঁর রচনার দোষ গুণ তাঁর নিজের কাছে অজানা থাকে না। দোষের জন্য নিন্দা এবং গুণের জন্য প্রশংসা তাঁর ন্যায্য প্রাপ্য। কিন্তু সমালোচকের নিন্দা বা প্রশংসার পেছনে যদি যথার্থতার সিলমোহর না থাকে, তবে তা পরিচালকের বিরক্তি উৎপাদন ছাড়া আর কোন কাজে আসে না।‘  সত্যজিৎ রায় সেই বছর ষাট আগে এই অমোঘ সত্য বলে গেছেন।

বলা বাহুল্য অমিতাভ রেজা স্ব-কাজ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎকারে সময় স্বল্পতার কথা জানিয়েছেন এই নন্দিত নির্মাতা। তবে ছবির প্রথম ভাগে খাপ ছাড়া সিকোয়েন্স পরিবর্তন,  এলেবেলে এক্সট্রা কাস্ট আর অপরিণত সংলাপ বিরক্তির উদ্রেক করে। আয়নাবাজিতে যেই যত্নের ছাপ পরিলক্ষিত হয়েছিল এতে তারই অভাব বারবার দেখা গেছে।

পরিপক্ব অভিনয়ের রসায়ন

সাব প্লটে পরকীয়া, অবাধ যৌনাচারের ইঙ্গিত ছিল, তবে নির্মাতার গুণেই চটকদার বিষয়গুলো অতিরঞ্জনের দিকে এগোয়নি। পূর্ণিমার চরিত্রের গুরুত্ব ছিল আকাশচুম্বী, সে তুলনায় স্ক্রিন টাইম কম হলেও দ্যুতি ছড়িয়েছেন পুরোদমে। তবে চিত্রনাট্যের দুর্বলতায় তাঁর প্রতি প্রয়োজনীয় সহমর্মিতা, রহস্য বা শ্রদ্ধা কোনটাই ঘনীভূত হয়নি। তবে মাসুদ মুন্সির ভাষ্য অনুসারে তাঁর প্রতি অমোঘ আকর্ষণটাই টেনেছে দারুণ।

পূর্ণিমা তাঁর সহজাত শিল্পি সত্তাকেই ঢেলে দিয়েছেন ছবিতে। জনপ্রিয় নায়িকা নয় বরং গল্পের নির্যাতিতা কিন্তু বিদ্রোহী সুরাইয়া হিসেবেই তাঁকে আবিষ্কার করেছেন দর্শক। চিত্রনাট্যে ভারসাম্যগত ত্রুটি থাকলেও পারফরম্যান্সে বুঝতে দেন নি।

ইমতিয়াজ বর্ষণের সাথে তাঁর স্ক্রিনটাইম অল্প হলেও প্রতিশ্রুত রসায়নের ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। একারণে এই দুই গুণী শিল্পীকে কুর্নিশ। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে শহিদুজ্জামান সেলিমের পারফরম্যান্স ছিল উপযুক্ত এবং বাস্তবিক। অল্প উপস্থিতিতেই মুগ্ধকর সক্ষমতা বরাবরই দেখিয়ে চলেছেন এই অভিজ্ঞ অভিনেতা। ইশতিয়াক মির্জা চরিত্রে গাজী রাকায়েতের বিকল্প হিসেবে আর কাউকে ভাবাটা কঠিনই।

‘দেবী’র স্নিগ্ধ নীলুকে ফের সিনেমায় দেখে হতাশ হতে হয়নি। পারভিন চরিত্রে সহজাত ভাবেই মিশে গেছেন শবনম ফারিয়া। স্বামী-স্ত্রীর খিটিমিটি থেকে অভ্যস্ত কথোপকথন- কোথাও জড়তা ছিল না। চঞ্চল- ফারিয়ার সাবলীল রসায়নকে বেশ চমৎকারভাবেই উপস্থাপন করেছেন পরিচালক।

তবে চিরাচরিত দাম্পত্য ও প্রেমের উপস্থাপনকে এড়িয়ে বাস্তব ও অধুনা প্রেক্ষাপট বেশ চোখে পড়েছে। যেমন ধরুন, পারভিনের প্রতি মাসুদের অনিচ্ছুক উদাসীনতাকে বৃহৎ কোন ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করা হয় নি। পরবর্তীতে অনুতাপ থেকে স্ত্রীকে উপহার দিলেও যৌক্তিক কারণেই তা প্রত্যাখাত হয়। সামান্য হলেও বোঝা যায়, পারভিনের রুচির প্রতি মাসুদের মনোযোগ একেবারেই কম। তবে পারভিনের এই খণ্ড বিখন্ড পর্যবেক্ষণের প্রভাবই পড়তে থাকে মুন্সির কাজে। সূক্ষ্ম সুতোয় সমান তালে এগিয়ে চলা দাম্পত্যের এই চিত্রায়ন বেশ পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর দিক এই ফিল্মের।

গত সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখ মুন্সিগিরির পোস্টার প্রকাশিত হয়। তখন থেকেই আলোচনার মধ্যমণি ছিল এটি। জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক শিবব্রত বর্মনের ‘মৃতেরাও কথা বলে’  উপন্যাস অবলম্বনে এই ওয়েব ফিল্মের চিত্রনাট্য লিখেছেন নাসিফ আমিন।

মুক্তির আগে অল্প কয়েক সাক্ষাতকারই দিয়েছিলেন পরিচালক অমিতাভ। সে সময় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এটি মূলত বাংলাদেশের পুলিশের জীবনের গল্প। একজন সৎ ডিবি অফিসার মাসুদ মুন্সি। তারও সংসার আছে, পরিবার আছে। আবার ডিউটিও আছে। কিন্তু এটি থ্রিলার ধরনের কোনো গল্প নয়। ডিবি পুলিশের গল্প। খুনের রহস্য আছে, রহস্য উদঘাটনের কথা আছে। জীবনের কথাও আছে।‘

উপন্যাসের নামে কেন ছবির নাম নয়? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘শিবব্রত বর্মণের উপন্যাস থেকে ফিল্মটি করেছি। একটি চরিত্র নিয়ে আরও পর্ব করা হবে, সে কারণেই চরিত্রকে প্রাধান্য দিয়েই নাম রাখা।‘

আয়নাবাজির পর অমিতাভের সাথে ফের আরেক ছবি। পুরাতনের প্রভাব কতটুকু নতুনে? এ প্রসঙ্গে চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘আয়নাবাজি আর মুন্সিগিরি দুটি দুই জিনিস। তবে নতুন কিছু এতে পাবেন দর্শকরা, এটুকু বলতে পারি। পরিচালক আমার প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন। আমিও সেই বিশ্বাস থেকেই প্রথমবার ডিবি পুলিশের চরিত্রে কাজ করেছি।’

শিবব্রত বর্মণের ‘মৃতেরাও কথা বলে’ উপন্যাস থেকে নির্মিত হয়েছে ‘মুন্সিগিরি’; Photo: The Daily Star
শিবব্রত বর্মণের ‘মৃতেরাও কথা বলে’ উপন্যাস থেকে নির্মিত হয়েছে ‘মুন্সিগিরি’; Photo: The Daily Star

পূর্ণিমাকে নির্বাচন করা প্রসঙ্গে অমিতাভ রেজা বলেন, ‘পূর্ণিমা সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই।তিনি আমার দেখা দেশের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী। যে কোনো চরিত্রের সঙ্গেই তিনি মানিয়ে নিতে পারার ক্ষমতা রাখেন।‘

চঞ্চল, শবনম ফারিয়া, পূর্ণিমা, রাকায়েত বাদেও ৮৫ মিনিটের এই ওয়েব ফিল্মে অভিনয় করেছেন খন্দকার লেনিন, আনিসুল হক বরুণ, মাসুম আজিজ, অশোক ব্যাপারি সহ অনেকেই।

সিনেমাটোগ্রাফিতেও বিশেষত্ব চোখে পড়েনি। তবে লোকেশনের অতিনাটকীয়তা না এনে চিরাচরিত তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার, সরকারি অফিস দেখিয়ে সততার পরিচয়ই দিয়েছেন। তবে ক্লাইম্যাক্সের বেলায় অগোছালো ও খাপছাড়া লেগেছে গল্প বলবার ভঙ্গিমা। এতে উত্তেজনার স্বাদও মেলেনি আবার করুণ রসের অভাবও ছিল ভীষণ।

রহস্য, রোমাঞ্চের সমস্ত উপাদান থাকার পরেও নির্মাণে ত্রুটি, অনুপযুক্ত সুর প্রক্ষেপণ, চরিত্র ডেভেলপমেন্টে অগভীরতা এবং অপরিণত চিত্রনাট্যের কারণে সম্ভাবনাময় এক ওয়েব ফিল্ম উদ্দীপ্ত করতে পারেনি। বিজিএমও প্রোডাক্ট প্লেসমেন্টের প্রচুর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ব্যবহার করতে পারেনি নির্মাতা দল। সিরিজ হিসেবে দাঁড় করবার পরিকল্পনা যেহেতু তাদের আছে, অতএব প্রথম কিস্তিতে অযত্নটা যথাসম্ভব কম হলেই চমৎকার হতো। দর্শকের রুচির ঘোড় দৌড়ে নামবার পূর্বে আরেকটু নিখুঁত গবেষণা বেশ দরকার এই দলের।

তবে এও মাথায় রাখা উচিত, সীমিত পরিসর, কড়াকড়ি, স্বল্প বাজেট ,সৃজনশীলতার স্বাধীনতার পরিধি বিবেচনায় ‘মুন্সিগিরি’ বেশ আশাব্যঞ্জক।

লিখেছেন- সারাহ তামান্না 

আরও পড়ুন- চলচ্চিত্র নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার