এই লেখায় যে সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে মানব বসতি কাকে বলে? বসতি স্থাপনের নিয়ামক কয়টি? মানব বসতি স্থাপনের নিয়ামকগুলো কি কি? বসতির শ্রেণী বিভাগ- গ্রামীণ বসতি, নগর বসতি।
মানব বসতি
কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে মানুষ একত্রিত হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করলে তাকে মানব বসতি বলে। প্রকৃতির সাথে নিজেকে উপযোগী করে চলার এটাই প্রথম অবস্থা। পরিবেশের সঙ্গে মানুষের অভিযোজনের প্রথম পরক্ষেপ হলো বসতি স্থাপন। মানুষ প্রাকৃতিক অনুকূল অবস্থাকে কাজে লাগাতে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানব বসতি গড়ে তোলে।
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিক ভিন্নতার জন্য বিভিন্ন ধরণের মানব বসতি গড়ে উঠেছে। যেমন- মেরু দেশীয় জলবায়ু অঞ্চলের মানুষদের বরফের ঘরে এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামীণ বসতিতে দোচালা ও চৌচালা ধরণের ধরে বসবাস করতে দেখা যায়। আর বিশ্বের বিভিন্ন শহরের বসতিতে আধুনিক নকশা ও নির্মাণসামগ্রী প্রয়োগ করে উচ্চ অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ ও শহর উভয় স্থানে মানব বসতি বৃদ্ধির হার বেড়েই চলছে। বিশেষভাবে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে পরিবেশ দূষণ ব্যাপকভাবে হচ্ছে।
বসতি স্থাপনের নিয়ামকগুলো কি কি?
মানুষের বসবাসের জন্য সর্বপ্রথম যেটি দরকার সেটি হচ্ছে নিরাপদ আবাস্থল। আর এই আবাসস্থলকে বলা হয় বসতি৷ নিম্নে বসতি স্থাপনের নিয়ামকগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
ভূপ্রকৃতিঃ যেকোন দেশে মানব বসতি স্থাপনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে সে দেশের ভূপ্রকৃতি। একটু, লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শীতপ্রধান দেশের যে অঞ্চলগুলো সারাবছর বরফে ঢাকা থাকে সে অঞ্চলগুলোতে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কম বসতি স্থাপিত হয়৷ আমাদের দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বসতি সমতল ভূমির তুলনায় কম। কারণ, সমতল ভূমিতে সহজে কৃষিকাজ করা গেলেও পাহাড়ি এলাকায় সেটি সম্ভব হয় না। ফলে, যাতায়াতের সুবিধার জন্য কৃষিজমির নিকট জনবসতি তৈরি হয়।
পানীয় জলের সহজলভ্যতাঃ কথায় আছে পানির অপর নাম জীবন। জীবন ধারণের জন্য বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন আবশ্যক। মানুষ এমন জায়গায় বসতি স্থাপন করতে চায় যে স্থানে বিশুদ্ধ জল সহজলভ্য। পানির প্রাপ্যতার উপর গড়ে ওঠা বসতিকে বলা হয় আর্দ্র অঞ্চলের বসতি। মরুময় এবং উপমরুময় অঞ্চলে ঝর্ণা বা প্রাকৃতিক কূপের চারিপাশে মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে বসতি স্থাপন করে৷
মাটিঃ মাটির উর্বরতা বসতি স্থাপনের নিয়ামক গুলো মধ্যে একটি। কোন অঞ্চল বা দেশের মাটি যদি উর্বর হয় সে অঞ্চলে পুঞ্জীভূত জনবসতি গড়ে ওঠে। আর অনুর্বর হলে বিক্ষিপ্ত বসতি গড়ে ওঠে। জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, পোল্যান্ডসহ প্রভৃতি দেশে বিক্ষিপ্ত জনবসতির সৃষ্টি হয়েছে। এটি শুধুমাত্র মাটির উর্বরতা ও অনুর্বরতাজনিত পার্থ্যক্যের কারণে।
প্রতিরক্ষাঃ প্রাচীনকালে সর্বপ্রথম মানুষ গুহায় বসবাস শুরু করলেও পরবর্তীতে হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার জন্য তারা সংঘবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করে। প্রাচীনকালে আত্মরক্ষার জন্য আধুনিক কোন অস্ত্র ছিলনা। তাই মানুষ বহিরাগত শত্রু ও হিংস্রপ্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পুঞ্জিভূত বসতি স্থাপন শুরু করে৷
পশুচারণঃ যে সকল এলাকার মানুষের জীবিকার সাথে পশুচারণের সম্পর্ক থাকে সে সমস্ত এলাকায় সাধারণত বিক্ষিপ্তভাবে বসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়। কারণ পশুচারণের জন্য বড় এলাকার প্রয়োজন হয়। ফলে এ সমস্ত এলাকার বসতি হয় ছড়ানো।
যোগাযোগঃ যোগাযোগ ব্যবস্থা বসতি স্থাপনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ প্রাচীনকাল থেকেই মানব বসতি গড়ে ওঠার পেছনে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। নদী তীরবর্তী স্থান ও সমতল ভূমি যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা রয়েছে সে সমস্ত স্থানে ধীরে ধীরে পুঞ্জিভূত মানব বসতি গড়ে উঠেছে৷ মিশরের নীল নদের তীরবর্তী আলেকজান্দ্রিয়া, তাজিকিস্তানের সমতলভূমিতে সমরকন্দ নগরের উৎপত্তি হয়েছে৷
বসতির শ্রেণীবিভাগ
বসতির ধরণ অনুসারে বসতিকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। গ্রামীণ বসতি ও নগর বসতি।
গ্রামীণ বসতি
যে বসতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী জীবিকা অর্জনের জন্য প্রথম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বিশেষত কৃষির উপর নির্ভরশীল সেই বসতিকে সাধারণভাবে গ্রামীণ বসতি বলে। গ্রামীণ বসতি বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত ও গোষ্ঠীবদ্ধ এর যে কোনটি হতে পারে। এর কারণ হলো গ্রামে প্রচুর জমি থাকে। স্বভাবতই, গ্রামবাসীরা খোলামেলা জায়গায় বাড়ি তৈরি করতে পারেন। ঘরবাড়ির কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য, নির্মাণ উপকরণ, বাড়ির নকশা ইত্যাদির বিচারে গ্রামীণ বসতি সহজেই চিনে নেয়া যায়। শহরের ইট-সিমেন্টের নির্মাণ স্থাপনা থেকে গ্রামের মাটির, কাঠের, পাথরের বাড়িকে সহজেই আলাদা করা যায়।
কৃষি প্রধান গ্রামে গোলাবাড়ি, গোয়ালঘর, বাড়ির ভিতরে উঠান এসবই এক অতি পরিচিত দৃশ্য। গ্রামে উঠানের চারপাশ ঘিরে শোবার ঘর, রান্নাঘর, গোয়ালঘর তৈরি করা হয়। উঠানে গৃহস্থরা ধান সেদ্ধ করা, শুকানো এবং ধান ভাঙ্গা ছাড়াও নানান কাজ করে থাকে। গ্রামে শোবার ঘর, রান্নাঘর, গোয়ালঘর যেমন আলাদাভাবে গড়ে উঠে যা শহরে হয় না। বসতবাড়িতে অবস্থান আরামদায়ক হওয়ার জন্য এবং প্রাকৃতিক বায়ুপ্রবাহের সহজ প্রবেশেই আলাদাভাবে বসতি গড়ে ওঠার প্রধান কারণ।
গ্রামীণ বসতিতে পথঘাটের প্রাধান্য থাকে খুব কম। কারণ গ্রাম প্রধানত খাদ্য উৎপাদক অঞ্চল। কৃশিকাজের বিভিন্ন অবস্থায় অর্থাৎ বীজতলা তৈরি, চারা রোপন, ফসল কাঁটা ও গোলাজাত করা ইত্যাদি ব্যাপারে পরস্পরের সহযোগিতার প্রয়োজন হয় বলে গ্রামবাসীদের মধ্যে একটা সহজ ও সরল আন্তরিকতা দেখা যায়। গ্রামীণ বসতি প্রাথমিক উৎপাদন অর্থাৎ কৃষির উপর নির্ভরশীল। জীবিকার প্রধান উৎস অনুসারে আবার আলাদা রকম বসতি গড়ে উঠে। যেমন- জেলে গ্রাম, মৃৎশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত কুমারপাড়া, লোহাজাত দ্রব্য তৈরিতে সম্পৃক্ত কামারপাড়া ইত্যাদি। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় এ ধরণের অনেক গ্রাম রয়েছে।
নগর বসতি
যে বসতি অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসী প্রত্যক্ষ ভূমি ব্যবহার ব্যতীত অন্যান্য অকৃষিকার্য যেমন- গ্রামীণ অধিবাসীদের উৎপাদিত দ্রব্যাদির শিল্পজাতকরণ, পরিবহণ, ক্রয়-বিক্রয়, প্রশাসন, শিক্ষা সংক্রান্ত কার্য প্রভৃতি পেশায় নিয়োজিত থাকে থাকে নগর বসতি বলে।
বাহ্যিক দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, শহরে অনেক রাস্তাঘাট ও কোন কোন ক্ষেত্রে বিশাল বিশাল আকাশচুম্বী অট্টালিকা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, নার্সিংহোম, আমোদ-প্রমোদের জন্য বহুপ্রকার সংস্থা, পার্ক ইত্যাদি থাকে। বড় বড় শহরের বিভিন্ন অংশে নানা ধরণের কর্মকাণ্ড চলে।
আরও পড়ুন- নগরায়ন কাকে বলে? নগরায়নের প্রভাব ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে সৃষ্ট সমস্যা
আরও পড়ুন- ভূগোল কি? ভূগোল কাকে বলে? ভূগোল শব্দের অর্থ কি?