ইংরেজি শব্দ “Map” এর বাংলা প্রতিশব্দ মানচিত্র। ল্যাটিন শব্দ “mappa” থেকে “map” শব্দটি এসেছে। ল্যাটিন ভাষায় কাপড়ের টুকরাকে ‘mappa’ বলে। আগেকার দিনে কাপড়ের উপরই map বা মানচিত্র আঁকা হতো। পৃথিবী বা কোন অঞ্চল বা এর অংশবিশেষকে কোন সমতল ক্ষেত্রে উপর অঙ্কন করাকে মানচিত্র বলে। মানচিত্র হল নির্দিষ্ট স্কেলে অক্ষরেখা বা দ্রাঘিমারেখাসহ কোন সমতল ক্ষেত্রের উপর পৃথিবী বা এর অংশবিশেষের অঙ্কিত প্রতিরুপ। এই সমতল ক্ষেত্র হতে পারে এক টুকরা কাপড় বা কাগজ।
মানচিত্রের প্রকারভেদ
মানচিত্র অনেক প্রকারের হতে পারে। সাধারণত মানচিত্রে ব্যবহৃত স্কেল এবং বিষয়বস্তু অনুসারে মানচিত্রগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। স্কেল অনুসারে মানচিত্র আবার দুই প্রকারের- (ক) বৃহৎ স্কেলের মানচিত্র এবং (খ) ক্ষুদ্র স্কেলের মানচিত্র। নৌচলাচল সংক্রান্ত নাবিকদের চার্ট, বিমান চলাচল সংক্রান্ত বৈমানিকদের চার্ট, মৌজা মানচিত্র প্রভৃতি বৃহৎ স্কেলের মানচিত্র। একটি ছোট এলাকা অনেক বড় করে দেখানো হয় বলে মানচিত্রের মধ্যে অনেক জায়গা থাকে এবং অনেক কিছু তথ্য এরূপ মানচিত্রে ভালোভাবে দেখানো যায়। ভূচিত্রাবলি মানচিত্র, দেয়াল মানচিত্র প্রভৃতি ক্ষুদ্র স্কেলের মানচিত্র। সমগ্র পৃথিবী বা মহাদেশ বা দেশের মতো বড় অঞ্চলকে একটি ছোট কাগজে দেখানো হয় বলে এ প্রকার মানচিত্রে বেশি জায়গা থাকে না। ফলে এ মানচিত্রে বেশি কিছু দেখানো যায় না।
উপস্থাপিত বিষয়বস্তু হিসেবেও মানচিত্রগুলো দুই প্রকারের- (ক) গুণগত মানচিত্র এবং (খ) পরিমাণগত মানচিত্র।
(ক) গুণগত মানচিত্রঃ ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র, ভূসংস্থানিক মানচিত্র, ভূমিরূপের মানচিত্র, মৃত্তিকা মানচিত্র, দেয়াল মানচিত্র, ভূচিত্রাবলি মানচিত্র, স্থানীয় বৈচিত্র্যসূচক মানচিত্র এবং মৌজা মানচিত্র গুণগত মানচিত্রের অন্তর্গত।
(খ) পরিমাণগত মানচিত্রঃ বায়ুর উত্তাপ, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, জনসংখ্যার বণ্টন, জনসংখ্যার ঘনত্ব, খনিজ উৎপাদন, বনজ উৎপাদন, শিল্পজ উৎপাদন প্রভৃতি পরিসংখ্যান তথ্য যেসব মানচিত্রে দেখানো হয় সেসব মানচিত্র পরিমাণগত মানচিত্রের অন্তর্গত।
কার্যের উপর ভিত্তি করে মানচিত্র আবার কয়েক প্রকারের।
১। ক্যাডাস্ট্রাল বা মৌজা মানচিত্রঃ ক্যাডাস্ট্রাল শব্দটি এসেছে ফ্রেঞ্চ শব্দ ক্যাডাস্ট্রে থেকে, যার অর্থ রেজিস্ট্রিকৃত নিজের সম্পত্তি। এই মানচিত্র তৈরি করা হয় সাধারণত কোন রেজিস্ট্রিকৃত ভূমি অথবা বিল্ডিং -এর মালিকানা সীমানা চিহ্নিত করার জন্য। আমাদের দেশে আমরা যে মৌজা মানচিত্রগুলো দেখতে পাই সেগুলো আসলে ক্যাডাস্ট্রাল মানচিত্র। এই মানচিত্রের মাধ্যমেই হিসাব করে সরকার ভূমির মালিক থেকে কর নিয়ে থাকে। এই মানচিত্রের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে আমাদের গ্রামের মানচিত্রগুলো।
এই মানচিত্রে নিখুঁতভাবে সীমানা দেওয়া থাকে। এই মানচিত্রগুলো বৃহৎ স্কেলে অঙ্কন করা হয়, যা ১৬ ইঞ্চিতে ১ মাইল বা ৩২ ইঞ্চিতে ১ মাইল। এই ধরনের মানচিত্রের মধ্যে বিবিধ তথ্য প্রকাশ করা হয়। শহরের পরিকল্পনার মানচিত্রও এই মৌজ মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত।

২। ভূসংস্থানিক মানচিত্রঃ ভূসংস্থানিক- এর আরেক নাম হচ্ছে স্থানীয় বৈচিত্র্যসূচক মানচিত্র। এই মানচিত্রগুলো প্রকৃত জরিপকার্যের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়। সাধারণত এর মধ্যে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক দুই ধরনের উপাদান দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরনের মানচিত্রের স্কেল একেবারে ছোট না হলেও মৌজা মানচিত্রের মতো বৃহৎও নয়। এই মানচিত্রগুলোতে কিন্তু জমি সীমানা দেখানো হয় না। ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে পাহাড়, মালভূমি, সমভূমি, নদী, উপত্যকা, হ্রদ প্রভৃতি দেখানো হয়।
অন্যদিকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হিসেবে রেলপথ, হাটবাজার, পোস্ট অফিস, সরকারি অফিস, খেলার মাঠ, মসজিদ, মন্দির প্রভৃতি নিখুঁতভাবে দেখানো হয়। বর্তমান যুগে বিমান থেকে ছবি তোলার মাধ্যমে এই মানচিত্রের নবযুগের সূচনা হয় এই মানচিত্রের স্কেল ১ঃ২০,০০০ হলে ভালোভাবে বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পায়।
বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন স্কেলে এই মানচিত্র তৈরি করে। সবচেয়ে আদর্শ ও জনপ্রিয় হচ্ছে ব্রিটিশদের তৈরি করা মানচিত্র যার স্কেল ছিল ১ঃ২৫,০০০ থেকে ১ঃ১০০,০০০ এবং আমেরিকাতে এই মানচিত্রের স্কেল থাকে সাধারণত ১ঃ৬২,৫০০ এবং ১ঃ১২৫,০০০। বাংলাদেশ সাধারণত ব্রিটিশ স্কেলটি অনুসরণ করে।

৩। দেয়াল মানচিত্রঃ দেয়াল মানচিত্র তৈরি করা হয় সাধারণত শ্রেণীকক্ষে ব্যবহার করার জন্য। সারা বিশ্বকে অথবা কোন গোলার্ধকে এই মানচিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। দেয়াল মানচিত্রে আমাদের চাহিদা মতো একটি দেশ অথবা একেকটি মহাদেশকে আলাদাভাবে প্রকাশ করা হয় বড় অথবা ছোট স্কেলে। এই দেয়াল মানচিত্রের স্কেল ভূসংস্থানিক মানচিত্রের চেয়ে ছোট কিন্তু ভূচিত্রাবলি মানচিত্রের চেয়ে বড়।

৪। ভূচিত্রাবলি বা এটলাস মানচিত্রঃ মানচিত্রের সমষ্টিকে ভূচিত্রাবলি (এটলাস) বলে। এই মানচিত্রকে সাধারণত খুব ছোট স্কেলে করা হয়। এটি প্রাকৃতিক, জলবায়ুগত এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে তৈরি করা হয়। বেশিরভাগ ভূচিত্রাবলি মানচিত্রে স্থানের অভাবে রং দিয়ে বৈশিষ্ট্য বোঝানো হয়। শুধু পাহাড়ের চূড়া, গুরুত্বপূর্ণ নদী এবং রেলওয়ের প্রধান রাস্তা বোঝানোর জন্য প্রতীক দেয়া থাকে। কিছু কিছু ভূচিত্রাবলি করা হয় ১১০০০,০০০ স্কেলে। আমাদের দেশে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই মানচিত্র তৈরি করে থাকে। এই মানচিত্রে সমগ্র পৃথিবীকে একটি পৃষ্ঠার মধ্যে দেখিয়ে থাকে। এতে প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও কৃষিভিত্তিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মানচিত্র তৈরি করা হয়।
৫। প্রাকৃতিক মানচিত্রঃ যে মানচিত্রে কোন দেশ বা অঞ্চলের বিভিন্ন প্রাকৃতিক ভূমিরূপ যেমন- পর্বত, মালভূমি, মরুভূমি, নদী, হ্রদ ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য থাকে তাঁকে প্রাকৃতিক মানচিত্র বলে।
৬। ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রঃ ভূত্বক গঠনকারী শিলাসমূহের অবস্থান ও গঠনের উপর ভিত্তি করে এই ধরনের মানচিত্র তৈরি করা হয়।
৭। জলবায়ুগত মানচিত্রঃ বায়ুর তাপ, বায়ুর চাপ, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাঁকে জলবায়ুগত মানচিত্র বলে।
৮। উদ্ভিজ্জ বিষয়ক মানচিত্রঃ বিশ্বের কোথায় কোন ধরনের প্রাকৃতিক উদ্ভিজ্জ আছে তার উপর ভিত্তি করে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে উদ্ভিজ্জ মানচিত্র বলে।
৯। মৃত্তিকা বিষয়ক মানচিত্রঃ বিশ্বের কোথায় কোন ধরনের মাটি পাওয়া যায় তার উপর ভিত্তি করে এই মানচিত্র তৈরি করা হয়। সাধারণত মাটির গুনাগুণের উপর ভিত্তি করেই বিশ্বের কোথায় কোন ধরনের ফসলের চাষাবাদ করা যাবে সেজন্য কৃষিবিদরা এই ধরনের মানচিত্র বেশি ব্যবহার করে থাকেন।
১০। সাংস্কৃতিক মানচিত্রঃ বিভিন্ন স্থানের অর্থনৈতিক অবস্থা, বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রের সীমা, ঐতিহাসিক কোন স্থান বা স্থাপত্য, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে সাংস্কৃতিক মানচিত্র বলে।
আবার সাংস্কৃতিক মানচিত্রকেও কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
(ক) রাজনৈতিক মানচিত্রঃ বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রের সীমা দেখিয়ে এই মানচিত্র তৈরি করা হয়। এর মধ্যে কোন দেশ বা রাষ্ট্রের রাজধানী ও গুরুত্বপূর্ণ শহরও দেখানো হয়।
(খ) বণ্টন মানচিত্রঃ যেসব মানচিত্রে জনসংখ্যা, শস্য, জীবজন্তু, শিল্প ইত্যাদির বন্টন কোন একটি অঞ্চল বা দেশে দেখানো হয় তাকে বণ্টন মানচিত্র বলে।
(গ) ঐতিহাসিক মানচিত্রঃ ঐতিহাসিক কোন স্থান বা স্থাপত্যকে নিয়ে যেসব মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে ঐতিহাসিক মানচিত্র বলে।
(ঘ) সামাজিক মানচিত্রঃ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে সামাজিক মানচিত্র তৈরি করা হয়। বিশেষ করে যারা সামাজিক প্রথা ও বৈষম্য, জনসংখ্যা এসব নিয়ে গবেষণা করেন তারা এ মানচিত্র ব্যবহার করেন।
(ঙ) ভূমি ব্যবহার মানচিত্রঃ কোন ভূমি কী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বা কোন ভূমি কোন কাজে ব্যবহার করলে সবচেয়ে বেশি উপযোগী তার উপর ভিত্তি করে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে ভূমি ব্যবহার মানচিত্র বলে।
আরও পড়ুন- ভূগোলের প্রধান শাখা কয়টি? ভূগোলের শাখা সমূহ বর্ণনা কর
আরও পড়ুন- ভূগোল ও পরিবেশ পাঠের গুরুত্ব
আরও পড়ুন- মায়া সভ্যতা বা মায়ান সাম্রাজ্যের ইতিহাস