১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন/ ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। SSC, HSC পরীক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে ভাষা আন্দোলন রচনাটি নিম্নে তুলে ধরা হলো।
ভাষা আন্দোলন রচনা
ভূমিকা:
নিজেদের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। প্রত্যেক জাতির একটি নির্দিষ্ট ভাষা আছে, যার মাধ্যমে ওই জাতি নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। তেমনি বাঙালিদের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে বাংলা ভাষা। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনই ভাষা আন্দোলন, যা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে থাকে ১৯৫২ সালে। যদিও এ আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল আরও আগে,অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী।
ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমি:
বাঙালী জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনার বীজ রোপিত হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে যখন নিখিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার মাত্র ১৭ দিনের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ১ সেপ্টেম্বর ৩ সদস্যবিশিষ্ট তমদ্দুন মজলিস গঠিত হয়। এ সংগঠনের সহযোগী সদস্য ছিলে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অধ্যাপক এ এস এম নূরুল হক ভূঁইয়া, শাহেদ আলী, আবদুল গফুর, বদরুদ্দীন ওমর প্রমুখ।
জন্মলগ্ন থেকেই সংগঠনটি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করে আসছিল। কিন্তু এ দাবি পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ কিছুতেই মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ভাষা সম্পর্কে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একতরফা সিদ্ধান্ত এবং উক্ত সিদ্ধান্তকে জোরপূর্বক বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দেয়ার ইচ্ছা এবং তৎপরতার মধ্য দিয়ে।
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা:
১৯৪৭ সালে একটি জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের অনুষ্ঠানে করাচীতে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হিসেবে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব করা হয়। সাথে সাথেই সম্মেলনে উপস্থিত বাঙালিরা প্রতিবাদ জানায়। তবে এই প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে পাকিস্তান সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে থাকে যা বাংলা ভাষাপ্রেমীরা মেনে নিতে পারেনি এবং বাঙ্গালীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
নানান দেশে নানান ভাষা,,,
বিনে স্বদেশীয় ভাষা পূরে কি আশা?
কত নদী সরোবর, কি বা ফল চাতকীর,,,
ধরাজল বিনে কভু ঘুচে কি তৃষা?
– রামনিধি গুপ্ত
বাংলা বর্ণমালা মুছে ফেলার প্রয়াস:
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পর পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলা ভাষাকে তাদের অনুমোদিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিষয় তালিকা থেকে বাদ দেয়। পাকিস্তান পার্লামেন্টের সাংবিধানিক কাগজপত্র, মুদ্রা, ডাকটিকেট, গণমাধ্যম থেকে বাংলা অক্ষর বাতিল করা হয়। এর ফলে বাংলা শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রভাব পড়ে এবং বাঙালি জাতি ক্রমে ভাষা আন্দোলনের দিকে ধাবিত হতে থাকে এবং ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ জনতা বিক্ষোভের আগুনের জ্বলে উঠে।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়:
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের শুরু হয়। পাকিস্তানের অংশ দুটি- পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলােমিটার দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশ। এদের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগােলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক পার্থক্য ছিল। সেই সময় পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৯০ লাখ। এর মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী হলেও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল মাত্র ২ কোটি ৫০ লাখ নাগরিকের পশ্চিম পাকিস্তানেই। তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে সরকারি সুযোগ সুবিধা, উন্নয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থা, ক্ষমতা প্রদান ইত্যাদি সব কিছু থেকেই বঞ্চিত রাখা হয়।
যদিও পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে এক কেন্দ্রীয় পর্যায়ের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষ প্রতিবাদ শুরু করে। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সর্বপ্রথম ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়,এবং কতিপয় দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নীতি গৃহীত হয়।
ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়:
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্থানীয় গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্যগণ বিশেষত কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি জানান ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাও ব্যবহার করার জন্য।গণপরিষদের কংগ্রেস সদস্যগণও বাংলা ও উর্দুর সমান মর্যাদা দাবি করেন। পরবর্তীতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগের মধ্যে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এ আলোচনা মোটেই ফলপ্রসু হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের ২৭ শে জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। এর ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২৯শে জানুয়ারি সিদ্ধান্ত হয়, ঢাকা শহরে প্রতিবাদে মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে সমগ্র পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদ কর্মসূচি ও ধর্মঘটের আহ্বান করে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে। ফলে এই দিনটিতে ঢাকা শহরের সকল প্রকার মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কিন্তু এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বহুসংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি:
১৯৫২ সালের ৩০শে জানুয়ারি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনকে আরো তীব্র করার লক্ষ্যে এক জনসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটিতে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ থেকে দুইজন, খিলাফতই রব্বানী থেকে দুইজন, ছাত্রলীগ থেকে দুইজন, বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি থেকে দুইজন, আওয়ামী লীগ থেকে দুইজন সদস্য গৃহীত হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন গোলাম মাহবুব।
ঐতিহাসিক মিছিল এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ:
একুশে ফেব্রুয়ারির উক্ত কর্মসূচিকে বন্ধ করার জন্য তৎকালীন গভর্নর নুরুল আমিন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেন। কিন্তু পূর্ব বাংলার ছাত্র জনতা এতে দমে যায়নি। তারা সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করে। তারা সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন প্রাদেশিক ভবনে গিয়ে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করবেন। নির্ধারিত সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবনের সামনে থেকে মিছিল শুরু হয় এবং কিছুদূর যাওয়ার পরে মিছিল যখন ঢাকা মেডিকেলের সামনে আসে ঠিক তখনই পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এর ফলে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয় এবং কয়েকজন ছাত্র ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন। রফিক, বরকত, সালাম, জব্বারসহ আরও নাম না জানা অনেক ছাত্র মৃত্যুবরণ করেন। এতে করে ছাত্র জনতা সহ সাধারণ অনেক জনগণও প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে ওঠে এবং কঠোর মিছিলে যোগদান করেন।
চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩–৫৬):
কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ ২১শে ফেব্রুয়ারি স্মরণে শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও দিবসটি পালনে সম্মত হন। ১৯৫৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনের উদ্দেশ্যে প্রশাসনের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভাষা আন্দোলনের এক বছর পূর্তিতে সারা দেশব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ দিবস পালিত হয়। অধিকাংশ অফিস, ব্যাংক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষ প্রভাতফেরীতে যোগ দেন। হাজার হাজার মানুষ শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আসে এবং মিছিল করে প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে।
এই দিন সহিংসতা রোধের জন্য স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়। প্রায় লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে আরমানিটোলায় বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে ভাষার দাবির পাশাপাশি মাওলানা ভাসানীসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি উত্থাপন করা হয়। রেলওয়ের কর্মচারীরা ছাত্রদের দাবির সাথে একমত হয়ে ধর্মঘট পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসের ছাত্ররা শহীদদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ফজলুর রহমান বলেন যে, বাংলাকে যারা রাষ্ট্রভাষা করতে চায় তারা দেশদ্রোহী।
২১শে ফেব্রুয়ারী:
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে সরকারি আদেশ উপেক্ষা করে ঢাকা শহরের স্কুল কলেজের হাজার হাজার ছাত্র সমবেত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য পুরাতন কলা ভবনের সামনে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা ছোট ছোট দলে হয়ে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” স্লোগান দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন শুরু করে। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভার স্থলের চারদিক ঘিরে রাখে। বেলা সোয়া ১১টার দিকে ছাত্ররা একত্র হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়। এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দাবিতে কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ ছাত্ররা মিছিলে বের হয়। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেলের সামনে এলে ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এতে অনেক ছাত্র শহীদ হয় । এ ঘটনার জন্য পূর্ব বাংলার সমগ্রতে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পরে।
“মনে পড়ে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারী,
লাখো বাঙালির কাতর চিত্তে করুন আহাজারি
একুশ তুমি বাংলার মানুষের হৃদয় ভরা আশা,
তোমার কারণে পেয়েছি আজ কাঙ্খিত মাতৃভাষা.
রক্ত ঝরালো সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বার, বায়ান্নর সেই করুন কাহিনী মনে পড়ে বারবার
স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে সেই বিষন্ন দিনের কথা,
যত ভাবি ততই যেন মনে পাই বড় ব্যথা।”
২১শে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন:
১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ দিন প্রত্যুষে সর্বস্তরের মানুষ খালি পায়ে প্রভাতফেরীতে অংশগ্রহণ করে এবং শহীদ মিনারে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। সারাদিন মানুষ শোকের চিহ্নস্বরূপ কালো ব্যাজ ধারণ করে। এছাড়া আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি তর্পণ করা হয় এবং ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দিনটি কখনো জাতীয় শোক দিবস, কখনোবা জাতীয় শহীদ দিবস হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস:
২০০১ সাল থেকে শহীদ দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে। বাংলাদেশে এদিনে সরকারি ছুটি। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়। দৈনিক সংবাদপত্রসমূহে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয় পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। বাংলাদেশ সরকার বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একুশে পদক প্রদান করে।
একুশের গান:
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ………” ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ‘একুশে’ নিয়ে প্রথম গান। আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা এই গানটিতে প্রথমে সুরারোপ করেন আব্দুল লতিফ। পরে করাচী থেকে ঢাকা ফিরে ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ আবার নতুন করে সুরারোপ করেন।সেই থেকে ওটা হয়ে গেল একুশের প্রভাত ফেরীর গান। বর্তমানে আলতাফ মাহমুদের সুর করা গানটিই গাওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হয় গানটি। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে। জহির রায়হান তার “জীবন থেকে নেয়া” ছবিতে এ গানটি ব্যবহার করার পর এর জনপ্রিয়তা ব্যাপকতা লাভ করে। ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই গানটির সুনাম আরো বাড়তে শুরু করে। ইতোমধ্যে গানটি সুইডিশ ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।।…” ( আবদুল গাফফার চৌধুরী)
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি:
১৯৫৪ সালের ৭ মে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়:
214.(1) The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali.
[২১৪. (১) উর্দু এবং বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।]
যদিও আইয়ুব খানের প্রতিষ্ঠিত সামরিক সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিল। ১৯৫৯ সালের ৬ জানুয়ারি সামরিক শাসকগোষ্ঠী এক সরকারি বিবৃতি জারি করে এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উল্লেখিত দুই রাষ্ট্র ভাষার উপর সরকারি অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে।
ভাষা আন্দোলন অর্জন:
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন ভাষা কেন্দ্রিক হলেও এ আন্দোলন সম্পূর্ণ বাঙালি জাতিকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে। এর ফল হিসেবে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত করে। ক্রমবর্ধমান গণ আন্দোলনের মুখে ১৯৫৪ সালের ৭ ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার জন্য ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের বিজয় বাঙালী জাতিকে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক সাহিত্য:
ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অনেক সাহিত্য রচিত হয়। ভাষা আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এক নতুন রূপ লাভ করে। ফলে রচিত হয় ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রিক অনেক গল্প, কবিতা, উপন্যাস, রচনা।হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় একুশের প্রথম সাহিত্য “একুশে ফেব্রুয়ারি” প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। এ সালেই কারাগারে বসে মুনির চৌধুরী রচনা করেন “কবর” নাটক। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি রচনা করেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। জহির রায়হান একুশকে নিয়ে রচনা করেন “আরেক ফাল্গুন” উপন্যাস। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রচনা করেন “মাগো, ওরা বলে” কবিতা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাংলা সাহিত্য চর্চার অন্যতম অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে আজীবন।
উপসংহার:
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় নির্দেশ করে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বীরের ভাষা শহীদদের অবদান জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে,তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে আজীবন। ভাষা আন্দোলনের সময়কার আত্মদান তখনই সার্থক হবে যখন বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন প্রথম সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্র, স্থান, ব্যক্তি অর্থাৎ প্রত্যেক বাঙালি একটি দায়িত্ব রয়েছে।বাংলা ভাষাকে সম্মান করা সর্বত্র এর প্রভাব বিস্তার করা, বাংলা ভাষা সাহিত্য চর্চা করা ও এর যথাযথ ব্যবহার করা প্রত্যেক বাঙালির কর্তব্য।”লক্ষ্য শহীদের বিনিময়ে পেয়েছি আমার এই বাংলা ভাষা আর পেয়েছি এই বিজয়ের নিশান।”
“ভাষা আমাদের সব ক্ষেত্রে আলো, সংস্কৃতির মাঝে এই অমূল্য রত্ন।”
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রচনা (২০ পয়েন্ট)
আরও পড়ুন- চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান / চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তাঁর প্রতিকার
আরও পড়ুন- রচনাঃ কৃষি কাজে বিজ্ঞান
আরও পড়ুন- শ্রমের মর্যাদা রচনা (১৮ পয়েন্ট)
আরও পড়ুন- রচনাঃ একটি শীতের সকাল