বাংলাদেশে বর্তমানে যেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু আছে, এটি একদিনে শুরু হয় নি। গত দুশো- তিনশো বছরে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিবর্তিত হতে হতে আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। নিম্নে বাংলাদেশে প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
বাংলাদেশে প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
প্রাচীন বাংলায় এবং মুসলিম ও ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশে প্রধানত সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এ ব্যবস্থা ছিল ভূস্বামীকেন্দ্রিক। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূমির মালিককে ভূস্বামী বলা হতো। অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। একজন ভূস্বামী ছিলেন অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার নিয়ন্ত্রণে সকল বৃত্তি ও পেশার লোকজন, যেমন- কৃষক, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে, ছুতার, স্বর্ণকার, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চিকিৎসক প্রভৃতি থাকতেন। এমনকি তার সম্পদ বা সম্পত্তির নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব প্রজাকুল বা লাঠিয়াল বাহিনী থাকত। ব্রিটিশ শাসনামলে এই ভূস্বামীদের বলা হতো জমিদার।
পাকিস্তান আমলে জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হয়ে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা স্থান করে নেয়। তবে বেশ কিছুকাল যাবৎ জমিদারি প্রথার প্রভাবও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পাশাপাশি চালু ছিল। পাকিস্তান আমলের শেষদিকে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাধান্য লাভ করে। দেশের জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশের হাতে দেশের অধিকাংশ মূলধন ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়।
১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ এ প্রণীত সংবিধানের ভিত্তিতে দেশে সমাজতন্ত্র অভিমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বড় বড় কলকারখানা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বিমা কোম্পানি, পরিবহন, প্রধান প্রধান শিল্প প্রতিষ্ঠান, প্রাথমিক শিক্ষা, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়।
পাকিস্তান আমলে কলকারখানা, ব্যবসা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অধিকাংশই অবাঙালি মালিকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই অবাঙালি মালিকেরা স্বাধীনতার পর দেশ ত্যাগ করলে এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়। আবার সদ্য স্বাধীন দেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, অবকাঠামো ও বিপর্যস্ত সমাজের সমস্যা ও সংকট মোকাবিলায় সরকারকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে দক্ষ প্রশাসক, ব্যবস্থাপক, উদ্যোক্তাসহ মানবসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ফলে উক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় নি। এতে রাস্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানা ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান লোকসানের সম্মুখীন হয়। ফলে বেসরকারি খাত ও ব্যক্তি উদ্যোগকে সম্প্রসারণ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বেসরকারি খাত ও ব্যক্তি উদ্যোগ সম্প্রসারণের এই ধারা বর্তমান সময় পর্যন্ত চালু আছে। এই ধারায় স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে রাষ্ট্রীয়করণকৃত কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করা শুরু হয়। বর্তমান বিশ্বে বিরাজমান অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সমানতালে চলার লক্ষ্যে মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অর্থনীতিকে পরিচালনা করা হচ্ছে। বর্তমানে অর্থনীতির কিছু খাতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালনার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও নানা রকম সংস্কার ও পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলছে। বর্তমানে দেশে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রাধান্যসহ মিশ্র অর্থনৈতিক অবস্থা বিদ্যমান। প্রধান প্রধান শিল্প, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের অন্তর্ভুক্ত। তবে অর্থনীতির প্রায় সব খাত ক্রমশ বেসরকারি উদ্যোগের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আর একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগ সম্প্রসারণের সাথে সাথে বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। দ্রব্যের চাহিদা ও যোগানের পারস্পরিক ক্রিয়ায় দ্রব্যের দাম নির্ধারিত হয়। এই দামই আবার উৎপাদনের প্রকৃতি ও পরিমাণ এবং ক্রেতার ভোগকে প্রভাবিত করে।
দেশে উৎপাদনের জন্য যে মূলধন বা পুঁজি প্রয়োজন, তা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেই বেশিরভাগ সংগৃহীত হয়। তবে বৈদেশিক ঋণ, সাহায্য, অনুদান এবং ব্যক্তিগত পুঁজিও এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দেশে উৎপাদন ও বণ্টন প্রক্রিয়ায় সরকারি ও বেসরকারি খাতের সহাবস্থান রয়েছে। বেসরকারি খাত ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলে উদ্যোক্তা ও ভোগকারীর স্বাধীনতা আছে। যে কোন উদ্যোক্তা বা উৎপাদনকারী যে কোন দ্রব্য যে কোন পরিমাণ উৎপাদন করতে পারে। এই উৎপাদন কার্য অবশ্য সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের বণ্টন পরিস্থিতি
উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে প্রধানত ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। তবে অর্থনীতির কিছু খাতে বিশেষত সেবা খাতে সরকারি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
আমরা জানি ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠন উৎপাদনের চারটি উপাদান। ভূমির আয়কে খাজনা আর শ্রমের আয়কে বলে মজুরি। মূলধনের আয় হলো সুদ এবং সংগঠন বা উদ্যোক্তার আয় হচ্ছে মুনাফা। এ চারটির সমষ্টিই জাতীয় আয়।
উৎপাদনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূলধনের মালিক বা পুঁজিপতি এবং সংগঠক একই ব্যক্তি। কারণ মূলধন ছাড়া উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় না। বাংলাদেশের জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশ পুঁজিপতি ও উদ্যোক্তা। বৃহত্তর অংশই শ্রমিক বা মজুর।
ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য পুঁজিপতির দ্বারা শ্রমিকের শোষণ। শ্রমিককে তার প্রাপ্য ও ন্যায্য মজুরি দেওয়া হয় না। তার প্রাপ্য মজুরির একটি বড় অংশ পুঁজিপতিদের কাছে সুদ ও মুনাফা হিসেবে সঞ্চিত হয়। অর্থাৎ জাতীয় আয়ের বৃহত্তর অংশ অল্পসংখ্যক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ভোগ করে আর ক্ষুদ্রতর অংশ বন্টিত হয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে।
বাংলাদেশে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রায় সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। আয় বণ্টনের ক্ষেত্রে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মতো বাংলাদেশেও শ্রমিকদের মজুরির নিম্নহার এবং উদ্যোক্তাদের মুনাফার উচ্চহার লক্ষণীয়। সুদ এবং খাজনা উচ্চহারে পরিশোধ করা হয়। সরকারি খাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকায় শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি তুলনামূলকভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। তবে অর্থনীতির খাতসমূহের অধিকাংশই বেসরকারি নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকায় বাংলাদেশে আয় বৈষম্য রয়েছে। ফলে শ্রমিক শ্রেণীর জীবনযাত্রার মান নিম্ন।
আরও পড়ুন- সম্পদ কাকে বলে? সম্পদের শ্রেণিবিভাগ ও জাতীয় সম্পদের উৎস কয়টি?
আরও পড়ুন- ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কাকে বলে? ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
আরও পড়ুন- সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কাকে বলে? সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ
আরও পড়ুন- মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কাকে বলে? মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য