in

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র এক দিনে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। বহু ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও সত্য কথা বলতে প্রকৃত গণতন্ত্র এখনো অধরাই থেকে গেছে। ক্ষমতায় আসলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুদলই নিজেদের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়।

নিম্নে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস তুলে ধরা হলো-

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তানে পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা গৃহীত হয়। বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের অংশ ছিল। পাকিস্তান গণপরিষদে দেশের সংবিধান প্রণয়ন করতে ৯ বছর সময় লাগে। এ সময় পার্লামেন্টারি শাসনের নামে বস্তুত গভর্নর জেনারেল এবং আমলারাই দেশ শাসন করত। প্রধানমন্ত্রী অথবা আইনসভার মতামতের তোয়াক্কা না করে গভর্নর জেনারেল নিজের পছন্দ অনুযায়ী মন্ত্রিসভা গঠন করতেন। সংবিধান প্রণয়নের আড়াই বছরের মাথায় জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করেন। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটে।

কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি সোচ্চার হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে এবং সেটিই ছিল তৎকালীন পাকিস্তানে শেষ নির্বাচন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটে নির্বাচিত নেতা হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ২৬শে মার্চ ১৯৭১। এর চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

স্বাধীনতা- পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে তিনটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে। এগুলো হলোঃ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। এর মধ্যে উল্লখযোগ্য একটি সময় কেটেছে অগণতান্ত্রিক সেনা শাসনের অধীনে। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রথম সরকার গঠন করে। পাকিস্তানি অপশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিরা তাদের দীর্ঘ সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই গণতন্ত্র লাভ করেছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন, অবকাঠামো নির্মাণ, দেশের বিভিন্ন শিল্পের পুনরুজ্জীবিতকরণ এবং জাতীয়করণ, প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে আওয়ামী লীগ সরকার।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এসবের মধ্যে রয়েছে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন, স্বাধীনতার দশ মাসের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণয়ন (১৯৭২), নতুন রাষ্ট্র হিসেবে ১৪০টি দেশের স্বীকৃতি লাভ, জাতিসংঘ ও ওআইসিসিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনের সদস্যপদ প্রাপ্তি এবং নতুন সংবিধান অনুসারে ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান ইত্যাদি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি স্বাধীনতা বিরোধীচক্রের ষড়যন্ত্রে একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য শাহাদাত বরণ করেন। একই সালের ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। শুরু হয় বাংলাদেশের উল্টোপথে যাত্রা, যা নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ৭৫ পরবর্তী পনেরো বছর দেশ ছিল সেনা শাসনের অধীনে। এ সময় জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়। বিভিন্ন দল ভেঙ্গে বা নেতাদের ভাগিয়ে এনে সেনা- সমর্থক দল গঠন করা হয়। নির্বাচনের নামে ক্ষমতাসীনদের কর্তৃক ভোটকেন্দ্র দখল ও আসন ভাগাভাগি হয়। নির্বাচন কমিশন বলতে গেলে অকার্যকর ও অসহায় হয়ে পড়ে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান, বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহামদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও ২৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৯১ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তন ও গণতন্ত্র পুন্রুদ্ধারে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের সূচনা করে।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার গঠন করে। নির্বাচনের পর পর জাতীয় সংসদে সকল দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হয়। অবশ্য সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে এরূপ পারস্পরিক সমঝোতা দীর্ঘ হয়নি। জাতীয় সংসদের ঢাকার মিরপুর (১৯৯৩) এবং মাগুরার (১৯৯৪) প্রহসনমূলক উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপিকে কেন্দ্র করে অচিরেই তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।

জাতীয়ভাবে এক ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয় যে, দলীয় সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনই অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। অতএব আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিএনপি সরকারের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাতে থাকে। এ দাবিতে একপর্যায়ে ১৪৭ জন সদস্য জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য রাজপথে আন্দোলন শুধু করে। বিএনপি সরকার এই দাবি উপেক্ষা করেই ১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬ জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে। তবে আওয়ামী লীগ ও অন্য দলগুলো এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে। প্রায় ভোটারবিহীন পরিবেশে তথাকথিত এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করায় এ নির্বাচন গুরুত্ব ও বৈধতা হারায়। চার দিন স্থায়ী ষষ্ট জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল গৃহীত হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক ব্যবস্থা করা হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এসবের মধ্যে বিভিন্ন সংসদীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংসদকে শক্তিশালী করা, সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব প্রবর্তন, পার্বত্য চত্তগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদন, ইউনিয়ন পরিষদ এবং অন্যান্য স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে নারীদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পথ উন্মোচন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

২০০১ সালের ১লা অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে। এ সময় দলীয় স্বার্থে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ২ বছর বাড়িয়ে ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করে পছন্দের লোককে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের নীল নকশা প্রণীত হয়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দেশের চরম সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে।

২০০৭ সালে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের নেতৃত্বে রাজনীতিতে পরোক্ষভাবে সেনা হস্তক্ষেপ ঘটে। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সেনা- সমর্থিত সরকার দুই বছর ক্ষমতাসীন থাকে। এ সময়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেত্রীদ্বয়ের গ্রেফতার, তাদের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তথাকথিত সংস্কার আনয়নের উদ্যোগ, একের পর এক অধ্যাদেশ জারি ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা স্থায়ীকরণের অপপ্রয়াস চলে। দুই বছর পর এ সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।

২৯ নভেম্বর ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল বিজয় অর্জন করে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করে। যদিও আওয়ামী লীগ নিজেরাই এক সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করেছিল।

আরও পড়ুন- রাষ্ট্র কাকে বলে? রাষ্ট্রের উপাদান কয়টি?

আরও পড়ুন- গণতন্ত্র কাকে বলে? গণতন্ত্রের প্রকারভেদ