বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ
ভূমিকাঃ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শব্দ দুটি একই মালায় গাঁথা। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন হলো স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যাঁর অবদান অপরিসীম তিনি হলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার ব্যক্তিত্ব, কর্মকীর্তি তাঁকে দিয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের মতো কিছু যোগ্য নেতাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গুণে বাংলাদেশ পাকিস্তানি শাসকদের হাত মুক্তি পেয়েছিল। তাই বলা হয়ে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়ঃ ১৭ই মার্চ ১৯২০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুতফুর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘরে জন্ম নেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান।
শিক্ষাজীবনঃ ১৯২৭ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের স্থানীয় গিমাডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯২৯ সালে ৯ বছর বয়সে তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। পিতার সরকারি চাকরির বদলির কারণে আবার তিনি ১৯৩১ সালে মাদারীপুর ইসলামিয়া স্কুলে ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। কিন্তু ১৯৩৪ সালে তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। এই রোগের কারণে প্রায় ৪ বছর তাঁর পড়ালেখা বন্ধ থাকে। অতঃপর ১৯৩৭ সালে তিনি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকেই তিনি ১৯৪২ সালে এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন।
প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং বেকার হোস্টেলে বসবাস শুরু করেন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে তিনি ১৯৪৪ সালে আই এ এবং ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন ও নেতৃত্বদানকে কেন্দ্র করে বৈরী অবস্থার সৃষ্টি হলে আইন বিভাগে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই তাঁর ছাত্রজীবনের সমাপ্তি ঘটে।
রাজনৈতিক জীবন ও বিভিন্ন সময়ে তাঁর অবদানঃ অল্প বয়স থেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে থাকে। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৪৩ সালে এই সংগঠন ছেড়ে বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দেন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় ১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলেজ ছাত্র সাংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এখানেই তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন।
এ সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হন। ফলে সে বছরই প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষণশীল নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কর্তৃত্ব খর্ব করতে তিনি ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ যা পরবর্তীকালে ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ‘ নাম ধারণ করে।
ভাষা আন্দোলনঃ ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আইন পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে’ বলে ঘোষণা দিলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানান সেই ঘোষণার। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে ভাষার প্রশ্নে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবক্রমে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গড়ে ওঠে। ১১ মার্চ হরতাল চলাকালে সচিবালয়ের সামনে থেকে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের করলে ওই মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। ফলে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত ও শফিউরসহ অনেকেই শহিদ হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলে বসে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং ১৩ দিন অনশন অব্যাহত রাখেন।
৬ দফা দাবিঃ ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোর সম্মেলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তিরসনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। একে ম্যাগনাকার্টাও বলা হয়ে থাকে। এ দাবি পেশকে কেন্দ্র করে ওই বছর তিনি মোট ১২ বার গ্রেফতার হন।
আগরতলা মামলাঃ ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে মোট ৩৫ জন সেনা ও সি এস পি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা দায়ের করে। তারপর ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আগরতলা মামলার বিচারকাজ শুরু হয়।
গণঅভ্যুত্থানঃ ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এ পরিষদ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে ২২ ফেব্রুয়ারী সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরের দিনে ২৩ ফেব্রুয়ারী ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘ আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু ‘ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
বাংলাদেশ নামকরণঃ ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ ‘।
নির্বাচনি বিজয়ঃ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় জাতীয় পরিষদের ১৬২টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে ১৬০টিতে জয়লাভ করে। তাছাড়া সংরক্ষিত ৭টি মহিলা আসনসহ আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত সর্বমোট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৭। আবার প্রাদেশিক পরিষদের সর্বমোট ৩০০টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। তাছাড়া ১০টি সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ আওয়ামী লীগের মোট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৮।
১৯৭১ঃ.১৯৭০সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা রকমের তালবাহানা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ডাক দেন। হাজারো জনতার সামনে তিনি বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন – “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম “।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে উত্তাল হয়ে উঠে সারা বাংলা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতির এ জাগরণে ভীত হয়ে ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করে, নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগকে এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়।
তারপর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তথাকথিত ‘অপারেশন সার্চ লাইট” নামে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর অতর্কিত হামলা চালায়। তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে।
মধ্যরাতের পর হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেফতারের পূর্বেই অর্থাৎ ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর স্বাক্ষরিত ঘোষণা বার্তাটি তৎকালীন ইপিআর এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়। এরপর চট্টগ্রামের ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে ২৬ ও ২৭শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে প্রচারিত হয় স্বাধীনতার ঘোষণা। সারা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামের চেতনা।
বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনঃ ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি করা হয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্র পতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এই সরকারের অধীনেই গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী এবং শুরু হয় পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর ৩০ লক্ষ বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে আসে বিজয়। ১৬ই ডিসেম্বর সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেখান থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সেখানেই বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর হাতে আত্মাসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় নতুন একটা দেশ,যার নাম ‘বাংলাদেশ ‘।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনঃ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তান জেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপরে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে বিনা শর্তে মুক্তি প্রদানে বাধ্য হয়। সে দিনই তাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডন পাঠানো হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছালে বঙ্গবন্ধুকে অবিস্মরণীয় এক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সেদিন লাখো বাঙালি বরণ করে নেয় ঢাকা বিমানবন্দরে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডঃ দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সমস্ত দেশ যখন নতুন করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই আসে আরেকটি আঘাত। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সামরিক বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে এক বর্বর হামলা চালিয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডটি ঘটায়। সপরিবারে হত্যা করা হয় বন্ধবন্ধুকে। কেবল তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা সেই সময় দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান তারা। সদ্য স্বাধীন জাতির জীবনে এক অপূরনীয় ক্ষতি নিয়ে আসে এই হত্যাকান্ড।
উপসংহারঃ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলার জনসাধারণ তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন। বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু চিরকাল এক আর অভিন্ন হয়েই থাকবে।
আরও পড়ুন- গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য রচনা।