in ,

প্লুটো কেন গ্রহ নয়?

প্লুটোকে কেন এখন গ্রহ বলা হয় না?

প্লুটো কেন গ্রহ নয়?
প্লুটো কেন গ্রহ নয়?

প্লুটো কি গ্রহ? কিংবা প্লুটো কেন গ্রহ নয়? কিংবা প্লুটোকে কেন বামন গ্রহ বলা হয়? এই কয়েকটি প্রশ্ন অনেকের কাছেই ধাঁধার মতো। কেনই বা সেটা হবে না?

প্রায় ৭৬ বছর ধরে শিক্ষার্থীরা “আমাদের সৌরজগতে গ্রহের সংখ্যা কয়টি?” এই প্রশ্নের উত্তরে জেনেছে “আমাদের সৌরজগতে গ্রহের সংখ্যা নয়টি”। আর এই গ্রহগুলোর মাঝে সর্বাপেক্ষা ছোট গ্রহটির নাম “প্লুটো”।

কিন্তু, ২০০৬ সালে প্লুটোকে গ্রহ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়৷ যদি প্লুটোর আকার আকৃতির কোন পরিবর্তন সাধিত না হয়, তবে হঠাৎ কেন প্লুটোকে গ্রহ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হলো?

২০০৬ সালে জোতির্বিদদের সংগঠন “ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন” নতুন করে গ্রহকে সংজ্ঞায়িত করে। তাদের নতুন সংজ্ঞায় প্লুটো গ্রহের তালিকা থেকে বাদ পরে যায়। তারা জানান, প্লুটো একটি বামন গ্রহ (Dwarf Planet)। বামন অর্থ হলো তুলনায় ছোট।

প্লুটো কেন গ্রহ হওয়ার মর্যাদা হারালো এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে চলুন প্লুটো সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

প্লুটো

প্লুটোর আবিষ্কারঃ

আমরা জানি, আমাদের সৌরজগতের প্রথম চারটি গ্রহ- বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল হলো পাথুরে গ্রহ। এর পরে আছে গ্যাসীয় দানব বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন।

১৮৪০ এর দশকে ইউরেনাস গ্রহের কক্ষপথ পর্যবেক্ষণ করে মূলত নেপচুন গ্রহটি আবিষ্কার করা হয়। এই ঘটনার পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, নেপচুনের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে প্ল্যানেট নাইন বা নবম গ্রহের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

সে সময়কার প্রতিষ্ঠিত ধনী ব্যবসায়ী পারসিভাল লয়েল ১৮৯৪ সালে আকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য আমেরিকার এ্যারিজোনায় লয়েল অবজারভেটরি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৬ সালে নবম গ্রহ আবিষ্কার সম্পর্কিত গবেষণা শুরু হলেও ১৯০৯ সালে নবম গ্রহের সম্ভাব্য কিছু অবস্থান ঘোষণা করা হয়। যদিও তা পরবর্তীতে খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি৷

১৯১৬ সালে পারসিভাল লয়েল মারা গেলে লয়েল অবজারভেটরি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে৷ লয়েল নবম গ্রহ সম্পর্কিত তেমন কোন তথ্যের অনুসন্ধান করতে না পারলেও ১৯১৫ সালে তার অজান্তেই তার তোলা দুটো ছবিতে প্লুটোকে অস্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছিল৷ কিন্তু অনেক ছোট ও অনুজ্জ্বল বলে তাতে কেউ গুরুত্ব দেয়নি।

দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ১৯২৯ সালে লয়েল অবজারভেটরিতে আবার নতুন করে রহস্যময় প্ল্যানেট নাইন খোঁজা শুরু করা হয়। এই কাজে নিয়োগ দেয়া হয় শখের জোতির্বিদ ক্লাইড টমবোকে।

আকাশে টেলিস্কোপ তাক করে ছবি তোলা ও পর পর তোলা ছবিগুলো মিলিয়ে দেখে গতিময় কোনো বস্তু নির্ণয় করা- এই দুই সমীকরণের ভিত্তিতে ১৯৩০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ক্লাইড টমবো মহাকাশে গতিশীল একটি বস্তু আবিষ্কার করেন। কিছু গবেষণা শেষে তিনি তার এই আবিষ্কার হার্ভাড কলেজ অবজারভেটরিতে প্রেরণ করেন। সব কিছু যাচাই বাছাই করে অবশেষে ক্লাইড টমবোর হাত ধরে পৃথিবীবাসী পরিচিত হয় সৌরজগতের নবম গ্রহের সাথে। গ্রহটির নাম দেয়া হয় প্লুটো। প্লুটো হচ্ছে গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর মৃতদের দেবতা এবং অন্ধকার জগতের শাসনকর্তা।

ক্লাইড টমবোর নিজ হাতে তোলা সেই বিখ্যাত ছবি যেখানে প্লুটোর গতিশীলতা ধরা পরেছে, লাল বৃত্তের মধ্যে প্লুটোকে দেখা যাচ্ছে।
ক্লাইড টমবোর নিজ হাতে তোলা সেই বিখ্যাত ছবি যেখানে প্লুটোর গতিশীলতা ধরা পরেছে, লাল বৃত্তের মধ্যে প্লুটোকে দেখা যাচ্ছে।

ভেনেসিয়া বার্নি নামের এক ১১ বছর বয়সী বালিকার প্রস্তাবিত নামানুসারে গ্রহটির নামকরণ করা হয় “প্লুটো”। বার্নির দাদা ফ্যালকনার ম্যাডান ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের গ্রন্থাকারিক। বার্নি তার দাদার কাছে “প্লুটো” নামটি উপস্থাপন করলে তিনি তা জ্যোতির্বিদ্যার অধ্যাপক হার্বার্ট হল টার্নারের কাছে হস্তান্তর করেন। প্লুটো নামটির “P ও L” বর্ণদুটি পারসিভ লয়েলের নামের আদ্যক্ষর। তাই,
সর্বসম্মতিক্রমে নবম গ্রহটির নাম রাখা হয় “প্লুটো”।

প্লুটো সম্পর্কিত কিছু সাধারণ তথ্যঃ

প্লুটোকে কখনোই খালি চোখে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। কারণ প্লুটো আকাশের উজ্জ্বলতম বস্তুগুলোর একটি নয়। প্লুটো সূর্যের চারপাশে নিজ কক্ষপথে ঘুরার সময় যখন সূর্যের সবচেয়ে কাছে আসে তখন সূর্য থেকে এর দূরত্ব হয় ২.৭ বিলিয়ন মাইল, আর যখন সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে চলে যায় তখন সূর্য থেকে এর দূরত্ব হয় ৪.৫ বিলিয়ন মাইল।

প্লুটোর ব্যাস মাত্র ১,৩৭৫ মাইল যা পৃথিবীর ৫ ভাগের ১ ভাগ। সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর হিসেবে প্লুটোর ২৪৮ বছর লেগে যায়। সূর্য থেকে প্লুটোর অবস্থান অনেক দূরে বলে প্লুটোর গয়র তাপমাত্রা মাইনাস ২১২ থেকে ২২৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস।

সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হচ্ছে, এই প্লুটো গ্রহের আবার একটি চাঁদও রয়েছে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেন যে প্লুটোর চাঁদটি প্লুটো থেকে মাত্র ১২ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত এবং চাঁদটির ব্যাস প্লুটোর ব্যাসের অর্ধেক। প্লুটো ছাড়া সৌরজগতে আর কোন গ্রহের চাঁদের ব্যাস সেই গ্রহের অর্ধেক নয়। প্লুটোর চাঁদের নাম রাখা হয় কেরেন৷

প্লুটো কেন গ্রহ নয়? প্লুটোকে কেন বামন গ্রহ বলা হয়?

প্লুটোকে গ্রহ বলে বিবেচনা করা হবে কি হবে না এর পক্ষে বিপক্ষে অনেক যুক্তি দেয়া হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনোমিক্যাল এসোসিয়েশন গ্রহের যে সংজ্ঞা দিয়েছে সেটি অনেকটা এরকম- সৌরজগতের শুধু সেই সব বস্তুকেই গ্রহ বলা হবে যেগুলো আলাদা আলাদাভাবে সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে, যাদের আকার যথেষ্ট বড়, যারা নিজ কক্ষপথে ঘুরার সময় তার আশেপাশের এলাকায় নিজের একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

সৌরজগতের কোন বস্তুকে একটি পূর্ণ আকারের গ্রহের মর্যাদা পাওয়ার জন্য ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনোমিক্যাল এসোসিয়েশন দ্বারা স্বীকৃত তিনটি শর্তপূরণ করতে হয়ঃ

১. এটি সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরবে। যেমন চাঁদ কোন গ্রহ নয়, চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে।

২. এর পর্যাপ্ত ভর( mass) থাকতে হবে যাতে করে গ্রাভিটি এটিকে গোলগাল করে রাখতে পারে।

৩. এর ঝামেলাহীন কক্ষপথ (cleared neighborhood ) থাকতে হবে।

প্লুটো এই তিনটি শর্তের মধ্যে তৃতীয়টি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। প্লুটো সূর্যকে ঘিরে ঘুরে, এর আকৃতি গোলাকার কিন্তু প্লুটোর কক্ষপথ স্বতন্ত্র নয়, বরং এটি এর কক্ষে আবর্তনকালে নেপচুনের কক্ষের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এছাড়া খুবই ছোট আকারের কারণে প্লুটো তার কক্ষপথে নিজের প্রভাব ফেলতে পারে নি। সৌরজগতের অন্য সব গ্রহ সূর্যকে ঘিরে ঘোরার সময় তার কক্ষপথের কাছাকাছি যত জঞ্জাল আছে, সেগুলো পরিষ্কার করে ফেলে নিজের ভরের দরুণ সৃষ্টি হওয়া গ্রাভিটি দিয়ে। কিন্তু প্লুটো তা পারে না। প্লুটোর কক্ষপথে ছোট বড় অসংখ্য জঞ্জাল রয়েছে। এই “অপরাধে” প্লুটোর থেকে পূর্ণ গ্রহ হওয়ার মর্যাদা কেড়ে নিয়ে একে বামন গ্রহের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। সৌরজগতে বামন গ্রহের সংখ্যা ৪৪টি।

সৌরজগতের সব গ্রহগুলোর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য বামন গ্রহ কয়টি এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে।
সৌরজগতের সব গ্রহগুলোর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য বামন গ্রহ কয়টি এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে।

প্লুটো গ্রহ না বলার আরও একটি কারণ আছে। ১৯৯২ সাল হতে বিভিন্ন সময়ে সূর্য থেকে প্লুটো যে দূরত্বে অবস্থান করে সেখানে আরো কিছু বস্তু আবিষ্কৃত হতে থাকে। যেগুলো আকার আকৃতিতে প্লুটোর সাথে তুলনীয়। ২০০৫ সালে প্লুটোর কাছাকাছি আরেকটি বামন গ্রহের সন্ধান মেলে যার আয়তন প্লুটো থেকে ২৭ শতাংশ বেশি। এটির নাম রাখা হয় “ইরিস”।

সৌরজগতের শেষ মাথায় প্লুটোকে ছাড়িয়ে আরও দূরে জ্যোতির্বিদরা 2003 UB313 বা ” জেনা” নামের আরেকটি বড় বস্তু আবিষ্কার করেন। যদি প্লুটো গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি পায় তবে প্লুটোর চেয়ে বড় এই বস্তুগুলো কেন গ্রহের স্বীকৃতি পাবেনা এমন যুক্তিও অনেকে তুলে ধরেন। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনোমিক্যাল এসোসিয়েশন দ্বারা স্বীকৃত তিনটি শর্তপূরণ না করতে পারায় এগুলো কোনটিই পূর্ণ গ্রহের মর্যাদা পায়নি।

আশা করছি আমাদের প্রিয় পাঠকরা এতক্ষণে প্লুটোকে কেন বামন গ্রহ বলা হয় কিংবা প্লুটো কেন গ্রহ নয় সেই উত্তর খুঁজে পেয়েছেন।

বিজ্ঞান প্রিয় পাঠকরা আরও পড়ুন- 

আহ্নিক ও বার্ষিক গতি কি? আহ্নিক ও বার্ষিক গতির ফলাফল

জোয়ার ভাটা কি? জোয়ার-ভাটা কেন হয়?