in

রচনা: আমার প্রিয় শিক্ষক 

প্রিয় শিক্ষক
প্রিয় শিক্ষক

রচনা: আমার প্রিয় শিক্ষক

ভূমিকাঃ একজন শিক্ষকের দায়িত্ব হলো তিল তিল করে তার ছাত্রদের গড়ে তোলা, তিনি একবার তার দায়িত্বে অবহেলা করলে তার ছাত্ররা সারাজীবন অবহেলিত হতে পারে।

– মার্ক রুজভেল্ট

কথায় আছে একজন শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। শৈশবে গুটি গুটি পায়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষা জীবনের সূচনা হয়৷ শিক্ষা জীবনে আমাদের অনেক শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়৷ তারমধ্যে এমন কিছু শিক্ষক থাকেন যার সাথে সম্পর্কটা শুধু স্কুল, বই এইসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তার ব্যক্তিত্ত্ব, শিক্ষাদান পদ্ধতি সবই আমাদের স্মৃতির পাতায় আজীবনের জানি গেঁথে যায়। আর সে শিক্ষক হয় আমাদের “প্রিয় শিক্ষক”।

আমার প্রিয় শিক্ষকঃ যে মানুষটির কথা মনে পড়লে আজো শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, আমার সে প্রিয় শিক্ষকের নাম হচ্ছে ” আশিকুর রহমান “। তিনি বান্দরবান ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের হিসাববিজ্ঞানের প্রভাষক ছিলেন। তার বাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জ জেলায়৷

প্রথম সাক্ষাৎঃ একাদশ শ্রেণিতে প্রথম ক্লাস৷ আমাদের শ্রেণি শিক্ষক ক্লাসে প্রবেশ করলেন। নিজের পরিচয় দেওয়ার পর তিনি আমাদের সকলের পরিচয় জানতে চাইলেন। সেদিনকার সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল তিনি ক্লাসের সকলকে “হিসাববিজ্ঞান” শব্দটি লিখতে বলেছিলেন। প্রায় ছাত্রছাত্রী লিখলো “হিসাব বিজ্ঞান”।  স্যার হাসিমুখে সকলের খাতা চেক করলেন এবং যারা ভুল করেছিল তাদের ভুলটা ধরিয়ে দিলেন। সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম বেশ মজার একজন শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছি আমরা৷

প্রিয় শিক্ষক হওয়ার কারণঃ স্যার সম্পর্কে যতই বলিনা কেন আমার কাছে মনে হয় কম বলা হচ্ছে। স্যারের মত মহৎ এক ব্যক্তিত্ব শুধু আমার নয় পুরো প্রতিষ্ঠানের সকলের কাছে ছিল অত্যন্ত প্রিয়। কেউ যদি  আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার প্রিয় শিক্ষক কে? আশিক স্যারের নামটাই সর্বপ্রথম আমার মনে পড়ে কারণ-

বন্ধুসুলভ আচরণঃ স্যারের সাথে পুরো শ্রেণির সকলের ভীষণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। স্যারের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের কারণে ক্লাসের সকলে নির্ভয়ে যে কোন সমস্যার কথা স্যারের কাছে খুলে বলতে পারতো। কোন শিক্ষার্থীর যদি কোন পড়া বুঝতে সমস্যা হত তবে সে হাজার বার চাইলেও প্রশ্ন করতে পারতো। স্যার কখনোই বিরক্তবোধ করতেন না। এমনকি টিফিন ব্রেকেও স্যার দুর্বল শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে সময় দিতেন।

অভিনব পাঠদান পদ্ধতিঃ পড়লাম, মুখস্থ করলাম আর পরীক্ষায় পাস করলাম -স্যার এই থিওরিতে মোটেও বিশ্বাসী ছিলেন না৷ স্যারের ভাষায় পড়াশোনার প্রথম শর্ত তাকে উপভোগ করতে হবে৷ স্যারের শিক্ষাদান পদ্ধতি এতটাই মনোমুগ্ধকর ছিল যে হিসাববিজ্ঞানের মত জটিল বিষয়টিও আমাদের কাছে জটিল মনে হতনা। বোর্ডে অংক করিয়ে দিলাম আর ক্লাস শেষ হয়ে গেল- স্যার মোটেও তেমন ছিলেন না। স্যার প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে গিয়ে জানতে চাইতেন স্যারের লেকচার বুঝতে কারো কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা।

আদর্শ ন্যায়পরায়ণঃ স্যার যেমন বন্ধুসুলভ ছিলেন তেমনি অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ করতেন না। যদি ক্লাসের কোন ছাত্র অপর কোন ছাত্রের সাথে খারাপ ব্যবহার করতো তবে স্যার মিষ্টি ভাষায় সে ছাত্রকে তার অন্যায়টি বুঝিয়ে দিতেন। পরে সে ছাত্র নিজেই স্বীকার করে নিত যে সে অন্যায় করেছে। একজন শিক্ষকের জন্য এর চেয়ে বড় সফলতা আর কি হতে পারে। স্যার আমার দেখা আদর্শ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষদের মধ্যে একজন।

দায়িত্বপরায়ন কর্তব্যনিষ্ঠঃ শেণি শিক্ষক হওয়ার সাথে সাথে আশিক স্যার ছিলেন হোস্টেল সুপার। হোস্টেলে অবস্থানরত সব ছাত্রের শেষ ভরসার নাম ছিল আশিকুর রহমান। সব ছাত্ররা জানতো তাদের সব বিপদে আপদে যে মানুষটিকে তারা সর্বপ্রথম পাশে পাবে সেটি হচ্ছে তাদের আশিক স্যার৷ স্যারের যে জিনিসটি তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ বাড়িয়ে দিয়েছে সেটি হচ্ছে স্যারের আন্তরিকতা। স্যারকে দেখে মনে হতো সব শিক্ষার্থীরা তার পরিবারের সদস্য। স্যার নিজেই আমার কাছে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

শিক্ষার্থীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাঃ যদি ক্লাসে কোন শিক্ষার্থীকে অমনোযোগী মনে হত তবে আশিক স্যার তার কাছে গিয়ে জানতে চাইতো তার শরীর ঠিক আছে কিনা। হোস্টেলে সব ছাত্র ঠিকঠাক ভাবে পড়াশোনা করছে কিনা, তাদের শরীর ঠিক আছে কিনা, কলেজ ছুটি হলে তারা সকলে বাড়িতে ঠিকাঠাক ভাবে পৌঁছলো কিনা এসব খোঁজখবর নেওয়া ছিল স্যারের রোজকার জীবনের অংশ৷ কোন শিক্ষার্থী যদি দীর্ঘদিন কলেজে অনুপস্থিত থাকতো তবে স্যার নিজেই তার বাসায় ফোন করে খবর নিত। বর্তমানে, যেখানে মানুষ নিজেই সম্পর্কে দেয়াল তুলে রাখে সেখানে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি স্যারের এমন অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রমাণ করে দেয় একজন আদর্শ শিক্ষকের পাশাপাশি আশিক স্যার একজন আদর্শ মানুষ।

সময়নিষ্ঠঃ ঘড়ির কাটায় সাড়ে আটটা বাজার সাথে সাথেই ক্লাসরুমের দরজা থেকে আশিক স্যারের গলায় ভেসে আসতো “গুড মর্নিং “। একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় হাতেগোনা কয়েকদিন ছাড়া আশিক স্যারকে কখনো দেরিকরে ক্লাসে প্রবেশ করতে দেখেছি বলে মনে পড়েনা। যদি আজ কোন পরীক্ষা হয় তবে কাল বা পরশুর মধ্যেই স্যার খাতা হাতে ক্লাসে প্রবেশ করতেন। স্যারের কড়া আদেশ ছিল তিনি প্রবেশ করার পর কোন শিক্ষার্থী যেন আর ক্লাসে প্রবেশ না করে। স্যারের ভাষায় “তোমরা যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করবে নিশ্চয় অফিসে বস আসার পর তিনি তোমাদের দেরি করে অফিসে ঢোকাটাকে সহজ ভাবে নেবেন না।” স্যারের বলা কথাগুলো আজো আমার কানে এসে লাগে। স্যারের বলা প্রতিটি কথা ঠিক যেন অমূল্য রতন৷

সাহিত্য প্রেমীঃ আশিকুর রহমান হিসাববিজ্ঞানের প্রভাষক হলেও তার লেকচার কেবল পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি তার শিক্ষার্থীদের বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বিভিন্ন গল্প বা উপন্যাসের বইয়ের বর্ণনা এমনভাবে করতেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে আপনা আপনি সে বই পড়ার আগ্রহ জন্মাতো৷ এছাড়াও, স্যার পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে সাধারণ জ্ঞান সম্পর্কিত বিষয় সম্পর্কেও ধারণা দিতেন। কোন শিক্ষার্থী যদি ব্যাগ ভারী হয়ে যাচ্ছে তাই বই আনেনি সে অজুহাত দিত তখন স্যার বলতেন,” বইয়ের বোঝা বহন করতে না পারলে বিদ্যার বোঝা বহন করবে কি করে?”। স্যারের কথার মর্মার্থ তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারি তাঁর প্রতিটি কথাই ছিল বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত।

সংস্কৃতমনাঃ আশিক স্যার খুব ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন। তাছাড়া, স্যার খুব ভালো গল্প ও কবিতা লিখতেন। স্যারের লেখা গল্প, কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতো৷ স্যার সব শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ প্রদান করতেন। স্যারের কথা ছিল, “তুমি হয়তো গান, কবিতা এইসব না পারতে পারো কিন্তু গলাতো মেলাতে পারো৷ এতে করে যে মঞ্চে আছে সেও উৎসাহ পাবে আর তোমার মনটাও ভালো থাকবে। স্যার অন্যকে তাচ্ছিল্য করা ব্যাপারটাকে মোটেও প্রশ্রয় দিতেন না। স্যারের ভাষায়, আমরা কেউই সব বিষয়ে দক্ষ না। অন্যের দুর্বলতাকে নিয়ে হাসাহাসি মানে নিজের কাছে নিজেকে ছোট করা৷

উপসংহারঃ কথায় আছে, “সময় ও স্রোত কখনোই কারোর জন্য অপেক্ষা করে না৷ ” কলেজ জীবন শেষ হলো। আশিক স্যার আজ অন্য একটি দেশে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। স্যারের সাথে হয়তো আর কখনো দেখা হবে না৷ কিন্তু, স্যারের দেওয়া উপদেশগুলো সব সময় আমার সাথে থাকবে। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা তিনি যেন স্যারকে সবসময় সুস্থ রাখেন, আনন্দে রাখেন৷

আরও পড়ুন- রচনাঃ স্বদেশপ্রেম (২১ পয়েন্ট)

আরও পড়ুন- দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান

আরও পড়ুন- চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান / চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান