৮ম শ্রেণির ছাত্রী নাবিলা। অন্যান্য দিন টিফিন পিরিয়ডের সময় সহপাঠীদের সাথে খুনসুটিতে ব্যস্ত থাকলেও আজ সে মাথা নিচু করে ক্লাসের একটা কোণায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে৷ কিছুক্ষণ পর তার এক বান্ধবী তার এই মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে নাবিলা তার কানে কানে কিছু একটা বলে৷ নাবিলার কথা শোনামাত্রই তার সে বান্ধবী তৎক্ষনাৎ টিচার্স রুমের দিকে ছুটে যায়। অন্যদিকে নাবিলার ছেলে সহপাঠীরা তার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মুচকি মুচকি হাসছে৷
কিছুক্ষণ পর নাবিলার বান্ধবীর সাথে স্কুলের এক ম্যাডাম আসে এবং তিনি তাকে সাথে সাথেই লেডিস কমনরুমে নিয়ে যায়৷ তিনি নাবিলাকে বলেন তার মাসিক হয়েছে। ভয় পাওয়ার কারণ কোন কারণ নেই৷ এটি প্রত্যেক মেয়েরই হয়। মেয়েদের জন্য মাসিক, পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব হছে বয়সন্ধিকালের হরমোনের প্রভাবজনিত অতি স্বাভাবিক একটি ঘটনা।
একজন নারীর প্রতি মাসে ২ থেকে ৭ দিন মাসিক হয়ে থাকে। একজন নারীকে তার পুরো জীবনের গড়ে ছয় বছর মাসিকের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মাসিক নিয়ে সমাজে এখনো লুকোছাপা, অজ্ঞানতা, কুসংস্কারের শেষ নেই। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই যুগে কুসংস্কার নিয়ে পড়ে থাকার কোন মানেই নেই।
পিরিয়ড কি?
সহজ কথায়,পিরিয়ড আছে বলেই মেয়েরা গর্ভে সন্তান ধারণ করতে পারে৷ প্রতি চন্দ্রমাস পরপর হরমোনের প্রভাবে পরিণত মেয়েদের জরায়ু চক্রকে এক ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়৷ এই পরিবর্তনের ফলে রক্ত ও জরায়ু নিঃসৃত অংশ যোনিপথে বের হয়ে আসে৷ আর এটি মাসিক বা পিরিয়ড নামে পরিচিত।
মাসিক বা পিরিয়ড কেন হয়?

বয়ঃসন্ধি কালে একটি মেয়ের ডিম্বাশয়ে প্রায় ৩-৪ লাখ অর্ধ-প্রস্তুত, অ-নিষিক্ত ডিম্বাণু থাকে। মস্তিস্কের হাইপো থ্যালামাস ও পিটুইটারি গ্রন্থি প্রতি মাসে বিভিন্ন ধরণের হরমোন নিঃসৃত করে ডিম্বাশয় চক্র ও জরায়ু চক্র নামক দুটি চক্রের জন্য প্রস্তুতি নেয়। ডিম্বাশয় চক্রের কাজ হচ্ছে প্রতি মাসে যৌন হরমোন নির্গত করার পাশাপাশি যেকোন একটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুত করা।
অপরদিকে জরায়ু চক্র প্রথম দুই সপ্তাহ ধরে জরায়ুকে নিষিক্ত ডিম্বাণু ধারণের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করে। এই সময় জরায়ুর (Uterus) দেয়ালের আবরণ ঝিল্লি এন্ডোমেট্রিয়ামের দেয়াল মোটা হয়ে রক্তবাহী নালিকায় পরিণত হয়। নিষিক্ত ডিম্বাণুটি ডিম্বাশয় (Ovary) থেকে Fallopian Tubes হয়ে জরায়ুতে এসে নিপতিত হয়।
ভ্রুণ স্থাপনের জন্য এন্ডোমেট্রিয়াম সাধারণত সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করে। সঠিকভাবে নিষিক্ত ভ্রুণ স্থাপিত হলে জরায়ুতেই মানব শিশু বড় হতে শুরু করে। কিন্তু ডিম্বাণু নিষিক্ত না হলেই শুরু হয় মেয়েদের মাসিক বা ঋতুস্রাব। অ-নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামের রক্তবাহী নালিকার যে আবরণ, সেটির সাথে ভেঙ্গে পড়ে এবং রক্তের সাথে কয়েকদিন ধরে নারীর যোনি পথে বের হয়ে যায়।
সাধারণত ১১-১৪ বছর বয়সে একটি মেয়ে প্রথম ঋতুবতী হয়৷ একটি মেয়েকে প্রায় ৪০-৫০ বছর বয়স পর্যন্ত এই ঋতুস্রাবের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পিরিয়ডের সময়কাল ৩-৭ দিন পর্যন্ত হতে পারে৷ প্রতি পিরিয়ডে একটি মেয়ের শরীর থেকে ৩০-৯০ মি.লি রক্ত প্রবাহিত হয়৷ মাসিক সাধারণত ২৮ থেকে ৩০ দিন পর পর হয়ে থাকে৷
পিরিয়ডে করণীয় ও বর্জনীয়:
মাসিকের মতো একটি শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার সাথে একটি মেয়ের হরমোন, ওজন, মানসিক স্বাস্থ্য ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। এই সময় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা৷ কিন্তু আমাদের দেশের মাত্র ২০% মেয়ে মাসিকের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে। এখনো সিংহভাগ মেয়ে পিরিয়ডের সময় সাধারণ কাপড় ব্যবহার করে৷ গ্রামাঞ্চলে এর পরিমাণ বেশি৷ এই কাপড় থেকে পরবর্তীতে জরায়ুর মুখে টিউমার, ইউরিন ইনফেকশন, জরায়ু ক্যান্সারের মত ভয়াবহ রোগের সৃষ্টি হতে পারে৷ তাছাড়া, পিরিয়ডের সময় ৪ ঘন্টা অন্তর অন্তর প্যাড পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। প্যাডের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরের হওয়ায় এখনো সবাই এটি ব্যবহার করতে পারে না।
পিরিয়ডের সময় তলপেটের অতিরিক্ত ব্যথা, খিটখিটে মেজাজ, মাথা ঘুরানো, এসিডিটি, মুখের অরুচি, বমি বমি ভাব, অস্বস্তিবোধ ইত্যাদি ধরনের লক্ষণ দেখা যায়। এই সময় উচিত খাদ্যতালিকায় সামুদ্রিক মাছ, ডার্ক চকলেট, গ্রিন টি, লেবু, কলা, আদা, দারুচিনি চা, বাদাম, কাঠবাদাম, রঙিন ও সবুজ শাক-সবজি, আনার, অ্যালোভেরা, গাজর, আয়রন সমৃদ্ধ খাবার রাখা৷
মাসিকের সময় কফি বা দুধ চা, গরুর দুধ, অতিরিক্ত ভারী খাবার ও তেলে ভাজাপোড়া খাবার, প্রসেসড খাবার, কোল্ড ড্রিংকস ও অতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবার, অতিরিক্ত লবণাক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। মাসিক চলাকালীন সময়ে ঠান্ডা পানি, কোমল পানীয় এবং নারিকেল খাওয়া মোটেই উচিত নয়।
পিরিয়ডের সময় অনেকে পেটে ব্যথা অনুভব করে বলে উপুড় হয়ে শুতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু এই সময় উপুড় হয়ে শুলে হার্ট রেটে তারতম্য হয়, রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয় এবং অক্সিজেন ঠিকমতো সরবরাহ হয় না বলে মাথা ঝিমঝিম বা ব্যথা করে।
পিরিয়ডের সময় ভারী জিনিস তোলা, ভারী ব্যায়াম থেকে বিরত থাকতে হবে। অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করতে হবে। পিরিয়ডের সময় লোমকূপ আলগা থাকে৷ তাই এই শ্যাম্পুর ব্যবহার দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
অনিয়মিত পিরিয়ড:
যদি কোন মেয়ের মাসিক ২১ দিনের আগে বা ৩৫ দিনের পরে হয় এবং তা যদি ৩ দিনের কম বা ৭ দিনের বেশি স্থায়ী হয় তবে তাকে অনিয়মিত ঋতুচক্র বলা হয়৷ বিভিন্ন কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে। যেমন:
- শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া বা হঠাৎ কমে যাওয়া।
- অত্যাধিক মানসিক চাপ।
- অতিরিক্ত শরীরচর্চা।
- জরায়ুর টিউমার, এন্ডোমেট্রিওসিস, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম।
- যেসব মায়েদের শিশুকে বুকের দুধ পান করায়৷
- জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল সেবন।
- কপার টি ব্যবহার।
- কিশোর বয়সে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের তারতম্যের কারণে।
অনিয়মিত ঋতুস্রাবের কারণে রক্তপাতের পরিমাণ বেড়ে যায়। অনেক সময় সন্তান ধারণে অক্ষমতার মতো তিক্ত অভিজ্ঞতাও হতে পারে৷ তাই, যদি কেউ দীর্ঘসময় ধরে অনিয়মিত ঋতুস্রাবের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায় তবে তার অবশ্যই কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
ঋতুস্রাব ও সামাজিক ট্যাবু:
নেপালের পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামীণ সমাজে এখনো পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে মেয়েদের কুঁড়েঘর বা গোয়ালঘরে রাখা হয়। কারণ সে সমাজে মনে করা হয় পিরিয়ড চলাকালীন সময় অপবিত্র(!!!) মেয়েদের ঘরে রাখলে দেবতারা অসন্তুষ্ট হতে পারে৷
আমাদের দেশের কুতুবদিয়া দ্বীপাঞ্চলের এক মেয়ের সাথে কথা বলে জানতে পারি, পিরিয়ড চলাকালীন সময় তাদের বিছানায় শুতে দেওয়া হয় না৷ সে সময়টাতে তাদের জায়গা হয় মেঝেতে৷
আমাদের দেশে এখনো অনেক পরিবারে মহিলা অবিভাবকেরাও মেয়েদের সাথে পিরিয়ড নিয়ে কথা বলতে সংকোচবোধ করেন৷ ফলে দেখা যায় একটি মেয়ে যখন প্রথম মাসিক হয় তখন তাকে এক অস্বস্তিকর অনুভূতির সম্মুখীন হতে হয় যা তার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
পিরিয়ড প্রত্যেকটি মেয়ের জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। তাই সকলের উচিত এই বিষয়টিকে সহজভাবে নেওয়া। পাঠ্যবইগুলোতেও পিরিয়ড সম্পর্কে বিশদ আলোচনা দরকার যাতে ছেলে মেয়ে উভয়ই বুঝতে পারে এটি খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থলে মেয়েদের বাথরুমে স্যানেটারি ন্যাপকিন মজুদ রাখা উচিত যাতে কোন মেয়েকে অস্বস্তিকর অবস্থার সম্মুখীন হতে না হয়৷
স্যানেটারি ন্যাপকিন যাতে সুলভ মূল্যে পাওয়া যায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা দরকার। এখন অবশ্য বাজারে অনেক রি-ওয়াশেবল প্যাড কিনতে পাওয়া যায়। গ্রামের অধিকাংশ মহিলাদের মধ্যে স্যানেটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে এক ধরনের অনীহা কাজ করে। সেটা হতে পারে অজ্ঞতার কারণে কিংবা আর্থিক কারণে।
শেষ করার আগে ছোট একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। এক স্কুল ছাত্রী রাস্তায় অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে কারণ তার ড্রেসে পিরিয়ডের দাগ লেগে গিয়েছিল। এক স্কুল ছাত্র ব্যাপারটি লক্ষ্য করে তার কাছে এগিয়ে এসে নিজের সোয়েটার খুলে দিয়ে বলেছিল, “এটা পেছনে বেঁধে নিন। আমারও বাসায় বোন আছে৷ তারও পিরিয়ড হয়৷ ” পরে সে ছাত্রীটির মা ফেসবুক অজানা ছেলেটির উদ্দেশ্যে স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, “ছেলেকে সুশিক্ষা দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।”
মূলকথা হচ্ছে সচেতনতা শুরু করতে হবে প্রতিটি পরিবার থেকেই তবে পিরিয়ড সম্পর্কে অজ্ঞতা দূরীকরণ সম্ভব।
লিখেছেন- পূজা ধর
আরও পড়ুন- ফিরিয়ে দিয়েছেন রং ফর্সাকারী ক্রিমের ২ কোটির প্রস্তাব, প্রচলিত সৌন্দর্য ধারণার বিপরীতে সাই পল্লবী