পরের অনিষ্ট চিন্তা করে যেই জন
মূলভাবঃ
যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
একজন নীতিবান মানুষ সর্বদা অন্যের কল্যাণ কামনা করেন। অসৎ চিত্তের মানুষ পরের অনিষ্ট চিন্তার মাধ্যমে একধরনের সুখ অনুভব করেন। কিন্তু, তারা ভুলে যায় অন্যের অমঙ্গল কামনা কখনোই কারোর জন্য সুফল বয়ে আনেনা।
সম্প্রসারিত ভাবঃ মানুষ হিসেবে আমাদের প্রধান কর্তব্য অন্যের বিপদে আপদে এগিয়ে আসা। কারণ, আমরা সামাজিক জীব। এই সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে হলে প্রত্যেকেরই সমাজের প্রতি কিছুনা কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। সমাজের প্রতি আমাদের প্রধান দায়িত্ব অন্যের প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু, আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা শুধু নামে মাত্র মানুষ। মনুষ্যত্ব নামের কিছু তাদের ধারে কাছেও থাকেনা। তারা নিজের হাজার কিছু থাকার পরেও অন্যের জিনিসের প্রতি লোভ সংবরণ করতে পারেনা। তারা চায় শুধু তারাই প্রাচুর্যে থাকবে আর অন্যরা থাকবে অভাব অনটনে। এদের দ্বারা সমাজের কোন উপকার তো হয়না বরং ক্ষতি সাধিত হয়।
ধরুন, আপনার কোন এক বন্ধু অসুস্থ। তাই সে ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল। পরেরদিন সে আপনার কাছে জানতে চাইলো ক্লাসে কি পড়িয়েছে। আপনি তাকে ঠিকই লেকচার সিট দিলেন কিন্তু সবটা না৷ কিছুদিন পর সে বন্ধু পরীক্ষায় কিছুটা নাম্বার কম পেল। কারণ, আপনি তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে গুরত্বপূর্ণ লেকচার সিট গুলো দেননি। এতে করে আপনি হয়তো পরীক্ষায় কিছুটা নাম্বার বেশি পেলেন কিন্তু মানুষ হিসেবে আপনি অকৃতকার্য৷ এই ধরনের মানুষ ভুলে যায় সময় সব সময় একরকম থাকেনা। আজ আপনি যার ক্ষতি চাইছেন একদিন তার কাছে আপনার সাহায্য চাইতে হবে কিনা সেটি কিন্তু কেউ বলতে পারেনা।
আমরা হয়তো আমাদের কুকর্মের কথা ভুলে যাই। কিন্তু প্রকৃতি ঠিকই মনে রাখে। “Revenge Of Nature ” নামে একটা কথা আছে। ভালো কিংবা খারাপ যাই হোক আমরা যেমনটা করবো প্রকৃতি আমাদের ঠিক সেটাই কোন না কোনভাবে ফিরিয়ে দেবে। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.) ও ইহুদী বুড়ির কথা মনে আছে তো? ইহুদী বুড়ি রোজ মহানবী (সা.) এর নামাজে যাবার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো, মহানবী নামাজে সিজদা করার সময় পিঠে উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দিতো। এতেই শেষ ছিলনা। তাকে রোজ অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতো৷ একদিন পথে কাঁটা নেই দেখে মহানবী (সা.) বুড়ির বাড়ি যায় ও গিয়ে দেখতে পায় বুড়ি অসুস্থ। এরপর মানবতাবাদী মহানবী বুড়ির সেবা শুশ্রূষা করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। এই গল্প থেকে বোঝা যায় পরের অনিষ্ট চিন্তা কখনোই কারোর জন্য সুফল বয়ে আনেনি। বরং অন্যের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মধ্যেই রয়েছে জীবনে সার্থকতা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ঘুমন্ত বাঙ্গালীর উপর পাকিস্তানী হানাদারদের আক্রমণের কথা যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন ঘৃণার সাথে স্মরণ করা হবে৷ একসময় যখন পাকিস্তানিরা বুঝতে পারলো তাদের পরাজয়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে ঠিক আত্মাসমর্পনের আগে আগে তারা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের নির্বিচারে হত্যা করলো। কিন্তু, আজ সেই পাকিস্তানকে পুরো বিশ্ব চেনে জঙ্গী রাষ্ট্র হিসেবে আর পুরো বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। পরের অনিষ্ট করতে গিয়ে নিজের ঠিক কতখানি ক্ষতি হয় এর চেয়ে সুন্দর উদাহরণ হয়তো আর কিছু হতে পারেনা৷
পরের অনিষ্ট চিন্তাকারী সমাজ- রাষ্ট্র উভয়ের জন্য বিষাক্ত। নিজের স্বার্থের জন্য এরা যে কারোর ক্ষতি করতে পারে, হোক সে তার আপনজন বা রাষ্ট্র। এই ধরনের মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব নামের কিছুই থাকেনা৷ সর্বদা এদের ভাবনায় থাকে অন্যের ক্ষতি করার চিন্তা৷ মমতাজ উদদীন আহমদের ‘সুখী মানুষ’ নামের একটি নাটিকা রয়েছে। সে নাটিকার প্রতীকী চরিত্র মোড়ল নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের ক্ষতি করতো৷ একসময় তার হাড়মড়মড় রোগ হয় এবং তা কোন চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব হয়না। অনিষ্টকারীরা ভুলে যায় পাপ কাউকে ছাড় দেয় না। আজ হোক কিংবা কাল, পাপের শাস্তি সকলকে ভোগ করতেই হবে৷ পরের অনিষ্ট করে যেই জন সেই জন সর্বদা বর্জনীয়।
মন্তব্যঃ পল্লীকবি জসীমউদ্দিন এর “সবার সুখে হাসব আমি,কাঁদব সবার দুখে, নিজের খাবার বিলিয়ে দেব অনাহারীর মুখে” এই কবিতার মর্মার্থ যদি শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ না রেখে আমরা বাস্তব জীবনে কাজে লাগাই, তবে পরের অনিষ্ট চিন্তা কভু কারোর জন্য সুফল বয়ে আনতে পারেনা তা আমরা সহজে অনুধাবন করতে পারবো৷
আরও পড়ুন- ভাবসম্প্রসারণঃ দুর্নীতি জাতীয় জীবনে অভিশাপস্বরূপ
আরও পড়ুন- ভাবসম্প্রসারণঃ ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ
আরও পড়ুন- ভাবসম্প্রসারণ: কীর্তিমানের মৃত্যু নেই / মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়
আরও পড়ুন- ভাবসম্প্রসারণঃ একতাই বল