প্রত্যেকটি মানব শিশু একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং পরিবারেই বড় হয়। মানুষের জন্ম, সমগ্র কর্মময় জীবন এবং শেষ পরিণতি পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। পৃথিবীতে এমন কোন মানব সমাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে পরিবার নেই। পরিবার হলো একটি ক্ষুদ্রতম সামাজিক সংগঠন, যেখানে পিতা-মাতা ও তাদের সন্তান-সন্ততি একত্রে বসবাস করে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের স্নেহ-ভালোবাসা, শাসন, নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে পরিবারেই শিশুর সকল সামাজিক গুণের বিকাশ ঘটে।
পরিবার কাকে বলে
পরিবার হলো সমাজকাঠামোর মৌল সংগঠন। গোষ্ঠী জীবনের প্রথম ধাপ হচ্ছে পরিবার। পরিবার হচ্ছে মোটামুটিভাবে স্বামী- স্ত্রীর একটি স্থায়ী সংঘ বা প্রতিষ্ঠান, যেখানে সন্তান- সন্ততি থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে।
বিবাহ পরিবার গঠনের অন্যতম পূর্বশর্ত। একজন পুরুষ সমাজস্বীকৃত উপায়ে একজন নারীকে বিয়ে করে একটি পরিবার গঠন করে। আদিম সমাজেও পরিবারের অস্তিত্ব ছিল। সে সমাজে বিবাহ ব্যতিরেকেই পরিবার গঠিত হতো। কিন্তু আমাদের সমাজে এটা সম্ভব নয়। সুতরাং বলা যায় যে, বিবাহের মাধ্যমেই পরিবার গঠন করা যায়।
পরিবার হচ্ছে মানুষের দলবদ্ধ জীবনযাপনের বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠান। সব সমাজে এবং সমাজ বিকাশের প্রত্যেক স্তরেই পরিবারের অস্তিত্ব রয়েছে। এটি আমাদের দলবদ্ধ জীবনের আবেগময় ভিত্তি। সন্তান জন্মদান, প্রতিপালন এবং স্নেহ-মায়া-মমতার বন্ধন, মূল্যবোধ গঠন, অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি প্রভৃতি পরিবারের মধ্যেই ঘটে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের রয়েছে বিশেষ নিয়ম-নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ এবং কার্যগত সাংগঠনিক ভিত্তি, যার সামগ্রিকরুপই পরিবার কাঠামো।
আদিম সমাজ হতে শুরু করে আজ পর্যন্ত পরিবারের গঠন, কার্যাবলি ও কাঠামোতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তন সত্ত্বেও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় মানব সমাজে পরিবারের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, মানুষের জীবনের শুরু হতে শেষ অবধি আশ্রয়স্থল হচ্ছে পরিবার। পরিবারের সাথে মানুষের সম্পর্ক গভীর ও শৃঙ্খলিত, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। পরিবারের মাধ্যমেই সামাজিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
পরিবারের প্রকারভেদ
সমাজভেদে বা দেশভেদে বিভিন্ন প্রকারের পরিবার রয়েছে। বিভিন্ন মাপকাঠির ভিত্তিতে পরিবারকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। স্বামী-স্ত্রীর সংখ্যা, কর্তৃত্ব, পরিবারের আকার, বংশ মর্যাদা, বসবাস এবং পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের মাপকাঠির ভিত্তিতে পরিবার বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে।
১। স্বামী- স্ত্রীর সংখ্যার ভিত্তিতে পরিবারঃ এ ভিত্তিতে পরিবার তিন ধরনের হয়ে থাকে, যেমন- একপত্নী, বহুপত্নী ও বহুপতি পরিবার। একজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারীর বিবাহের মাধ্যমে একপত্নী পরিবার গড়ে ওঠে। বিশ্বে এ ধরনের পরিবার অধিক দেখা যায়। আদর্শ পরিবার বলতে মূলত এ পরিবারকেই বোঝায়। এ ধরনের পরিবার কাঠামোতে স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। আবার একজন পুরুষের সঙ্গে একাধিক নারীর বিবাহের ভিত্তিতে যে পরিবার গঠিত হয়, তাকে বহুপত্নী পরিবার বলে। এ ধরনের পরিবারে মূলত একজন পুরুষের একই সময়ে একাধিক স্ত্রী বর্তমান থাকে। সাধারণত কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ মুসলিম সমাজে এ ধরনের বহুপত্নীক পরিবার দেখা যায়। এস্কিমো উপজাতি এবং আফ্রিকার নিগ্রোদের সমাজেও এ ধরেনর পরিবার প্রথা রয়েছে। একজন নারীর সাথে একাধিক পুরুষের বিবাহের মাধ্যমে যে পরিবার গড়ে ওঠে তাকে বহুপতি পরিবার বলে। এ ধরনের পরিবার আধুনিক সভ্য সমাজে দেখা যায় না। তবে এক সময়ে তিব্বতে বহু স্বামী গ্রহণ পদ্ধতির প্রচলন ছিল। তাছাড়া, দক্ষিণ ভারতের মালাগড় অঞ্চলে টোডাদের মধ্যে এ ধরনের পরিবার দেখা যেত।
২। কর্তৃত্বের ভিত্তিতে পরিবারঃ কর্তৃত্বের ভিত্তিতে পরিবার দুই ধরনের হয়ে থাকে, যেমন- পিতৃপ্রধান বা পিতৃতান্ত্রিক এবং মাতৃপ্রধান বা মাতৃতান্ত্রিক পরিবার। পরিবারের সামগ্রিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভার পুরুষ সদস্য অর্থাৎ পিতা, স্বামী কিংবা বয়স্ক পুরুষ ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত থাকলে এ ধরনের পরিবারকে পিতৃপ্রধান পরিবার বলে। এ ধরনের পরিবারের বংশ পরিচয় সাধারণত পুরুষ সূত্র দ্বারা নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশের সমাজে এ ধরনের পরিবার রয়েছে। আবার যে পরিবারে সামগ্রিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভার মায়ের হাতে থাকে সে পরিবারকে মাতৃপ্রধান পরিবার বলে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা খাসিয়া এবং গারোদের পরিবার মাতৃতান্ত্রিক বা মাতৃপ্রধান।
৩। আকারের ভিত্তিতে পরিবারঃ আকারের ভিত্তিতে পরিবার তিন ধরনের হয়ে থাকে, যেমন- একক বা অণু পরিবার, যৌথ পরিবার ও বর্ধিত পরিবার। স্বামী- স্ত্রী ও তাদের অবিবাহিত সন্তান- সন্ততি নিয়ে গঠিত পরিবারকে একক পরিবার বলে। এই পরিবার দুই পুরুষে আবদ্ধ। দুই পুরুষ হলো পিতা এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান- সন্ততি। আমাদের দেশের শহরাঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারই একক পরিবার। গ্রামাঞ্চলেও এ ধরনের পরিবার গড়ে ওঠার প্রবণতা লক্ষণীয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এ ধরনের পরিবার প্রথা প্রচলিত। যখন দাদা-দাদি বা পিতা-মাতার কর্তৃত্বাধীনে বিবাহিত পুত্র ও তার সন্তানাদি এক সংসারে বাস করে তখন তাকে যৌথ পরিবার বলে। একক পরিবারের মতো যৌথ পরিবারের বন্ধনও মূলত রক্তের সম্পর্কের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারই যৌথ পরিবার। এখন এ ধরনের পরিবারের সংখ্যা নানা কারণে হ্রাস পাচ্ছে। তিন পুরুষের পারিবারিক বন্ধনের পরিবার হলো বর্ধিত পরিবার। বর্ধিত পরিবারে পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয় দিকের সদস্য অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। আমাদের দেশের গ্রামীণ সমাজে এ ধরনের পরিবার এখনও দেখা যায়। চীনেও এ ধরনের পরিবার প্রথা রয়েছে।
৪। বংশমর্যাদা এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে পরিবারঃ এ ভিত্তিতে পরিবার দুই ধরনের হয়ে থাকে, যেমন- পিতৃসূত্রীয় ও মাতৃসূত্রীয়। পিতৃসূত্রীয় পরিবারের সন্তান-সন্ততি পিতার বংশমর্যাদার অধিকারী ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে। এ ধরনের পরিবার আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় রয়েছে। মাতৃসূত্রীয় পরিবার মায়ের দিক থেকে বংশমর্যাদা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জন করে। খাসিয়া ও গারোদের মধ্যে মাতৃসূত্রীয় পরিবার ব্যবস্থা এখনো প্রচলিত।
৫। বিবাহোত্তর স্বামী- স্ত্রীর বসবাসের স্থানের ওপর ভিত্তি করে পরিবারঃ এ ভিত্তিতে পরিবার তিন ধরনের হয়, যেমন- পিতৃবাস, মাতৃবাস এবং নয়াবাস পরিবার। যে পরিবারে বিবাহের পর নবদম্পতি স্বামীর পিতৃগৃহে বসবাস করে তাকে পিতৃবাস পরিবার বলে। আমাদের সমাজে এ ধরনের পরিবার দেখা যায়। বিবাহের পর নবদম্পতি স্ত্রীর পিতৃগৃহে বসবাস করলে তাকে মাতৃবাস পরিবার বলে। গারোদের মধ্যে এ ধরনের পরিবার দেখা যায়। বিবাহিত দম্পতি স্বামী বা স্ত্রী কারও পিতার বাড়িতে বাস না করে পৃথক বাড়িতে বাস করলে নয়াবাস পরিবার বলা হয়। শহরে চাকরিজীবিদের মধ্যে এ ধরনের পরিবার দেখা যায়।
৬। পাত্র-পাত্রীদের পছন্দের ভিত্তিতে পরিবারঃ মুসলমান সমাজে গোত্রভিত্তিক বিবাহের প্রচলন না থাকলেও হিন্দু সমাজে তা লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু সমাজে দু’ধরনের গোত্রভিত্তিক পরিবার, যথা- বহির্গোত্র বিবাহভিত্তিক পরিবার এবং অন্তর্গোত্র বিবাহভিত্তিক পরিবার বিদ্যমান রয়েছে। কোন ব্যক্তি যখন নিজের গোত্রের বাইরে বিবাহ করে তখন তাকে বহির্গোত্র বিবাহভিত্তিক পরিবার বলে। এ ধরনের পরিবার আবার দু’ধরনের হয়। উচু বর্ণের পাত্রের সাথে নিচু বর্ণের পাত্রীর বিবাহের মাধ্যমে গঠিত পরিবারকে অনুলোম বিবাহভিত্তিক পরিবার বলে। আর নিচু বর্ণের পাত্রের সাথে উচু বর্ণের পাত্রীর বিবাহের মাধ্যমে গঠিত পরিবারকে বোলে প্রতিলোম বিবাহভিত্তিক পরিবার। এ ধরনের বিবাহের মূল কারণ সামাজিক অনাচার রোধ করা। আবার যখন কোন ব্যক্তি নিজের গোত্রের মধ্যে যখন বিবাহ করে তখন তাকে অন্তর্গোত্র বিবাহভিত্তিক পরিবার বলে। অন্তর্গোত্রভিত্তিক বিবাহ হিন্দু সমাজেই অধিক প্রচলিত। এ ধরনের বিবাহের পিছনে যুক্তি ছিল নিজ গোত্রের মধ্যে তথাকথিত রক্তের বন্ধন ও বিশুদ্ধতা রক্ষা করা। বর্তমানে এ ধরনের পরিবার গঠনে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। অধিকাংশ হিন্দু পরিবার এ বর্ণপ্রথাকে কুসংস্কার মনে করে।
আরও পড়ুন- পরিবারের কার্যাবলী আলোচনা কর