হুমায়ূন আহমেদের বৃক্ষ প্রেমের কথা তার সব পাঠক মাত্রই জানেন। হুমায়ূন বিশ্বাস করতেন নুহাশপল্লীর গাছেরা তার সাথে কথা বলতে পারতো। এমনকি ক্যান্সারের চিকিৎসা চলাকালীন সময় তিনি দেশে ফিরেছিলেন মা আয়শা ফয়েজ ও নুহাশপল্লীর বৃক্ষদের টানে। একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন নুহাশপল্লীর বৃক্ষদের প্রতি তার আবেগের কথা।
সম্প্রতি ডা. এজাজুল ইসলাম তার ইউটিউব চ্যানেলে হুমায়ূন আহমেদ কীভাবে নুহাশপল্লী কিনেছিলেন সেই গল্প শুনিয়েছেন। আমাদের হিজিবিজির পাঠকদের জন্য ডা. এজাজের জবান থেকে সেই গল্পের চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হল।
হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় ডা. এজাজ অভিনীত প্রথম নাটক “সবুজ সাথী”। দ্বিতীয় নাটক “অদেখা ভুবন”। এই দ্বিতীয় নাটক করতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাথে ডা. এজাজের হৃদ্যতা গড়ে উঠে। অদেখা ভুবন নাটকটির শুটিং হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের গ্রামের বাড়ি কুতুবপুরে। বাসে করে ঢাকা থেকে কুতুবপুর যাওয়ার সময় হঠাৎ হুমায়ূন আহমেদ ডা. এজাজকে ডেকে বলেন, “বুঝতে পেরেছেন ডা. সাহেব, আমার স্বপ্ন একটা সুন্দর বাগানবাড়ির। একটা সুন্দর বাগানবাড়ি থাকবে আমার। যেখানে আমি যাবো, মাঝেমধ্যে লেখালেখি করবো। আমি আমার অনেক আপনজনকে বলেছি, অনেক পরিচিতজনদের বলেছি, যখন বলি তখন সবাই খুঁজে দিবো বলে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই খুঁজে দেয় নি। তো আমি আমাকে একটা সুন্দর বাগানবাড়ি খুঁজে দেবার দায়িত্ব শুধু আপনাকে দিলাম”।
একে তো হুমায়ূন আহমেদের সাথে কাজ করার উত্তেজনা, তার উপর এমন গুরুদায়িত্ব! অদেখা ভুবনের শুটিং শেষ করেই ডা. এজাজ তার রোগীদের মাধ্যমে গাজীপুরের আশেপাশে বাগানবাড়ি খোঁজার কাজে নেমে পরেন। যেই রোগীই আসেন ডা. এজাজ তাকেই বলেন, “আপনার বাড়ির আশেপাশে আপনার জানা আছে এই রকম বাগানবাড়ির জন্য একটি জায়গা।”
এমন করতে করতেই একদিন লতিফ মাস্টার নামের একজনকে ডা. এজাজ বাগানের ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর লতিফ সাহেব একটি জায়গা খুঁজে পান। ডা. এজাজেরও সেই জায়গাটি পছন্দ হয়। প্রথমবার সেই জায়গা দেখার অনুভূতি সম্পর্কে ডা. এজাজ বলেন,
“সেই জায়গায় যেতে গাঁ ছমছম করে। তারপর গেলাম বনের ভিতরে একটা জায়গায়। চারিদিকে গজারি বন। লোকজনের বাড়িঘর কিছু নেই, একদম ফাঁকা।”
বাগান দেখা শেষ করে ডা. এজাজ হুমায়ূন আহমেদকে এসে বলেন, “স্যার, একটা জায়গা পাওয়া গেছে। জায়গাটা অনেক সুন্দর কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যোগাযোগ খুবই খারাপ, রাস্তাঘাট খুবই খারাপ।”
সব শুনে হুমায়ূন আহমেদ ডা. এজাজকে জিজ্ঞেস করেন, “জায়গাটি কি আপনার পছন্দ হয়েছে?”
ডা. এজাজ উত্তর দেন, “জি স্যার, আমার পছন্দ হয়েছে।”
শুধুমাত্র ডা. এজাজের এই কথার উপর ভরসা করেই হুমায়ূন আহমেদ জায়গাটি কিনবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। হাসতে হাসতে ডা. এজাজকে বলেন, “আমি খারাপ রাস্তাই চাই। ভালো রাস্তা হলে লোকজন আমার বাগানবাড়ি যাবে, আমার লেখালেখিতে সমস্যা হবে। খারাপ রাস্তা হলে কেউ যেতে পারবে না।”
এরপর জমির মালিকের সাথে কথা বলে হুমায়ূন আহমেদ ডা. এজাজকে জমির জন্য বায়না করে ফেলতে বলেন।
আতঙ্কিত হয়ে ডা. এজাজ হুমায়ূনকে বলেন, “স্যার, আপনি জায়গা বায়না করবেন? আপনি জায়গা দেখবেন না?”
হুমায়ূন উত্তর দেন, “আপনি না বললেন জায়গা আপনার খুব পছন্দ হয়েছে।”
ডা. এজাজঃ “স্যার, আমার পছন্দ হয়েছে কিন্তু আপনার তো পছন্দ নাও হতে পারে”
হুমায়ূন আহমেদঃ “এই কদিনে আপনার সম্বন্ধে আমার অনেক ধারণা হয়েছে। যেই জায়গা আপনার পছন্দ হয়েছে সে জায়গা আমারও পছন্দ হবে।”
এই কথোপকথনের পরে হুমায়ূন আহমেদের অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ডা. এজাজ শুনতে পান কেউ একজন হুমায়ূন আহমেদকে বলছেন, “আপনি পাগল নাকি? একটা জায়গা দেখলেন না, কিছু জানলেন না, কোথাকার কে এসে আপনাকে বললো জায়গা ঠিক আছে, জায়গা তার পছন্দ হয়েছে আর আপনি বায়না করে ফেলবেন?”
এর উত্তরে হুমায়ূন যা বলেছিলেন সেটি হয়তো ডা. এজাজ আমৃত্যু মনে রাখবেন, “দেখ, আমি মানুষ চিনতে ভুল করি না। কোন সমস্যা হবে না।”
হুমায়ূন আহমেদ বায়নার সব টাকা নগদ অর্থে পরিশোধ করেন। এরপর বাগানবাড়ি দেখতে যাওয়ার জন্য একদিন সময় বের করেন।
গাড়ি, নৌকা তারপর আবার গাড়ি হয়ে হুমায়ূন আহমেদ নুহাশপল্লীতে পৌঁছান। মিনিট দুই-তিনেক জায়গাটা ঘুরে দেখে ছলছল চোখে ডাঃ এজাজের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেক করে বলেন, “ডাক্তার সাহেব গুড জব। অনেক সুন্দর জায়গা তো।”
জায়গাটি হুমায়ূন আহমেদের পছন্দ হবে কি হবে না এই ভেবে ডাঃ এজাজ ভয়ে অস্থির হয়ে ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের উচ্ছ্বাস দেখে ডা. এজাজ যেন প্রাণ ফিরে পান। হুমায়ূন আহমেদ জায়গাটি ঘুরে দেখতে থাকেন আর বলতে থাকেন, “ডা. সাহেব অনেক সুন্দর জায়গা তো।” একটা সময় গিয়ে আবেগী হুমায়ূন ডা. এজাজকে বলেন,
“ডাক্তার সাহেব আমার জীবনের অনেক বড় একটা স্বপ্ন আপনি পূরণ করে দিলেন।”
আসলেই তাই। আমরা সবাই জানি এরপরে হুমায়ূন আহমেদ যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিনই নুহাশপল্লী ছিল হুমায়ূন আহমেদের প্রাণের জায়গা। নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা। পারিবারিক দোটানা থাকলেও শেষ পর্যন্ত হুমায়ূনকে সমাহিত করা হয়েছে নুহাশপল্লীতেই।
আরও পড়ুন- ‘স্যার, এই যে ১০ লাখ টাকা। বই দেবেন কবে?’
আরও পড়ুন- চলচ্চিত্র নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার