নগরায়ন কি? নগরায়ন কাকে বলে?
কাজের প্রকৃতি ও বসতির ধরণ অনুসারে পৃথিবীর প্রায় সাতশো কোটি মানুষকে গ্রামীণ ও নগর এই দুটো শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। মানুষ যখন তার খাদ্যের জন্য সংগ্রহ এবং শিকারের উপর নির্ভর করতো, তখন মানুষ ছিল যাযাবরের মতো। কিন্তু যখন খাদ্য সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা তার আয়ত্তে এলো, তখন সে স্থিতিশীল জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতে আরম্ভ করল। গড়ে উঠল স্থায়ী বসতি। এরপর সময়ের সাথে সাথে ব্যবসা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে নগর। শিল্প বিপ্লবের পরে নগরায়ন নতুন মাত্রা ও গতি পায়।
কোনাে একটি স্থানে নগর সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে নগরায়ন (Urbanization) বলা হয়। গ্রাম কিংবা অনুন্নত মফস্বল শহর থেকে মানুষ যখন জীবন ও জীবিকার তাগিদে কোনাে শহরে গিয়ে বসবাস তখন তাকে নগরায়ণ বলা হয়। এছাড়া বর্তমানে দেখা যায়, উচ্চশিক্ষা বা কর্মসংস্থানের আশায় মানুষ শহরে গিয়ে বসবাস শুরু করে৷ এর ফলে সে শহরের জনবসতি, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সহজ কথায়, বিপুল সংখ্যক মানুষের গ্রাম থেকে শহরে স্থানন্তর, শহরের জনবসতি ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি নগরায়ণ নামে পরিচিত।
নগরায়নের প্রভাব
নয়রায়নের ফলে সৃষ্ট প্রভাবকসমূহ নিম্নরূপ-
১. জনসংখ্যার ঘনত্ব: সাধারণত শহর বৃহৎ জনসংখ্যাবিশিষ্ট এবং ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে থাকে। বাংলাদেশের কোন বসতিকে শহর হিসেবে স্বীকৃতি লাভের জন্য কমপক্ষে ৫ হাজার জনসংখ্যা এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১,৫০০ জনের বসবাস থাকতে হবে। শহরে জন্ম ও মৃত্যুর হার গ্রামের মতো উচ্চ নয়। তবে অভিবাসনের কারণে শহরের জনসংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২. বসতবাড়ির ধরণ: শহরে সাধারণত বহুতলবিশিষ্ট বাড়ির সংখ্যা অধিক। এর ফলে স্বল্প পরিসর স্থানে অধিক লোকের সংস্থান হয়। প্রশস্ত রাজপথ, পার্ক, কৃত্রিম লেক প্রভৃতি শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। জীবন ধারণের জন্য আধুনিক প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন- বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ পাওয়া যায়। সহজ পরিবহণ ব্যবস্থা শহরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
৩. পরিবহণ ব্যবস্থা: নগরে যাতায়াতের জন্য অধিক সংখ্যক রাস্তা গড়ে ওঠে। ফলে মানুষ সহজেই একস্থান থেকে অন্যস্থানে বিভিন্ন ধরণের পরিবহণ ব্যবহার করে যাতায়াত করতে পারে।
৪. পরিবার: পরিবার হলো মানুষের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান। শহর জীবনে সচরাচর একক পরিবার কাঠামো লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন ধরণের পেশা ও শহরের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে শহরের লোকেরা প্রায় অবসরহীন জীবনযাপন করে। ফলে তারা নিজ নিজ পরিমন্ডলের লোকদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে না।
৫. চালচলন: শহর জীবনে গতিময়তা খুব প্রবল। বিভিন্ন প্রকার পেশা গ্রহণের সুযোগ থাকায় শহরের মানুষ অনেক সময় পেশা পরিবর্তন করে উন্নততর সুযোগ সুবিধা গ্রহণে ব্রত হয়। এখানে আয় দ্বারা সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয়ে থাকে। অপরপক্ষে গ্রামের মানুষ স্বভাবত রক্ষণশীল। সনাতন সামাজিক রীতির প্রতি গ্রামের মানুষ শ্রদ্ধাশীল থাকে। গ্রামে মানুষের সামাজিক অবস্থা জন্মসূত্রে নির্ধারিত হয়।
৬. খাদ্যাভ্যাস ও পোশাক পরিচ্ছদ: নগর মানুষের মধ্যে খাদ্যাভ্যাস ও পোশাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। শহরের মানুষ পোশাক পরিচ্ছেদে আধুনিক ফ্যাশনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে।
৭. অর্থনীতি: শহরের মানুষ দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত। নগরে মানুষের পেশা বহু বৈচিত্রপূর্ণ। তারা প্রধানত ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকর্ম, শিক্ষা, প্রশাসন ও সেবা প্রভৃতি অকৃষি পেশায় নিয়োজিত থাকে।
৮. সেবা সুবিধা: নগর জীবনে মানুষের জন্য বিভিন্ন প্রকার সেবা সুবিধা যেমন- বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও পয়ঃপ্রণালি, রাস্তাঘাট ইত্যাদি অপরিহার্যভাবে গড়ে ওঠে।
৯. শিক্ষা ও চিকিৎসা: নগরে মানুষ শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যাপারে সর্বপ্রকার সুবিধা ভোগ করে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল নগরেই গড়ে উঠে।
১০. বিনোদন ব্যবস্থা: নগরে কর্মক্লান্ত মানুষের চিত্তবিনোদনের সুযোগ সুবিধা থাকে। সিনেমা, থিয়েটার, খেলাধুলা প্রভৃতি বিনোদনমূলক কার্যকলাপ নগর জীবনের মানুষকে প্রভাবিত করে।
১১. অপরাধ বৃত্তি: নগরে অপরাধের ঘটনা বেশি পরিলক্ষিত হয়, যেমন- চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, প্রতারণা ইত্যাদি। এসব ঘটনা নাগরিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
১২. রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন: নগরে নাগরিক সংগঠনগুলো খুব সক্রিয় থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচি ও কর্মকান্ড শহর থেকেই পরিচালিত হয়। এছাড়া অন্যান্য সামাজিক সংগঠনগুলো নানা ধরণের সাংস্কৃতিক ও লোক ঐতিহ্য মেলার আয়োজন করে থাকে। যা নগর জীবনকে আনন্দময় করে তোলে।
নগরায়নের ফলে সৃষ্ট সমস্যা
বাংলাদেশ সম্প্রতি নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের উপনিত হয়েছে। দেশে অনেক নতুন প্রকল্প, মেগা প্রজেক্টটা এর কাজ শুরু হয়েছে। সে সাথে দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সিংহভাগ শহরকেন্দ্রিক। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চল এখনো অনেকখানি পিছিয়ে আছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে শহর, গ্রাম তথাপি পুরো দেশকে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমনঃ
১. অপরিকল্পিত নগরায়নের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পরে পরিবেশের উপর। বিপুলসংখ্যক মানুষ শহরমুখী হওয়ার কারণে শহর অঞ্চলে বাসস্থান সংকট দেখা দেয়। অতিরিক্ত লোকের বাসস্থানের ঘাটতি মেটাতে যথেচ্ছা দালানকোঠা নির্মাণের জন্য বৃক্ষ নিধন করা হয়। এটি পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে৷
২. নগরায়নের ফলে বাড়তি জনবসতির চাপে পরিবেশ দূষণ ও বাসস্থান সংকটের পাশাপাশি খাদ্যের অভাব, পরিবহণ সংকট, যানবাহন সংকট ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র অভাব পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।
৩. এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ নগরে বাস করে। তবে বাংলাদেশে এই অনুপাত কিছুটা কম। ঢাকা বাংলাদেশের সবচেয়ে জনবসতিপূর্ণ শহর। মানহীন পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বর্জ্যের তীব্র দুর্গন্ধ ও বিষাক্ত ধোঁয়া পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠস্থ পানিকে দূষিত করছে।
কল-কারখানার কালো ধোঁয়া, চামড়া শিল্পের বর্জ্য, যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া বায়ু দূষণের প্রধান নিয়ামক। ফলে হাঁপানি, সর্দি, ক্যান্সার, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়ার মত রোগের প্রাদুর্ভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঢাকা শহরে গড়ে ৯০০ টন বর্জ্য নিচু খোলা জায়গায় ফেলা হয়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্বের অবসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
৪. বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও বাংলাদেশে জনপ্রতি কৃষি জমির পরিমাণ প্রায় ০.০৫ হেক্টর (বিশ্ব ব্যাংক, ২০১১)। দিন দিন জনসংখ্যা বাড়লেও কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমতে শুরু করেছে। কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে শহরগড়ে তোলার কারণে একসময় দেশে খাদ্যসঙ্কট দেখা দিতে পারে।
৫. বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দশ লাখ অধিবাসী অধ্যুষিত এক একটি শহরে প্রতিদিন ৬২.৫০০ মেট্রিক টন পানি প্রয়োজন। ঢাকা মহানগরীতে বর্তমানে প্রতিদিন ২৮.৫ কোটি গ্যালন পানি প্রয়োজন হলেও ওয়াসা সরবারাহ করতে পারে ১৮ কোটি গ্যালন। তারমধ্যে আবার সরবরাহকৃত পানির প্রায় সাড়ে তিন কোটি গ্যালনই অপচয় বা অব্যবহৃত হয়। ফলে, ১৫ কোটি গ্যালনের উপর ঘাটতি থেকে যায়। বিশ্ব সংস্থার হিসাব মতে, আমাদের জনপতি গড়ে ৭ গ্যালন পানি জনপ্রতি প্রয়োজন হয়। কিন্তু ঢাকাবাসী এর অর্ধেকও পায়না। শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করে।
৬. অপরিকল্পিত নগরায়ন ও যানবাহন বৃদ্ধির ফলে ঢাকা শহরে গ্যাসের সংকট ও পুরনো গ্যাসের সংযোগ থেকে দুর্ঘটনার শঙ্কা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যানবাহনের ধোঁয়া থেকে নির্গত সীসা, পারদ, নিকেল, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতির কারণে হাঁপানি, সর্দি, কাশি সহ অন্যান্য এলার্জি জনিত রোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে ।
অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে শহরবাসীর জন্য শিক্ষা-চিকিৎসার সুবিধা ও বিনোদন ব্যবস্থা করা দুরূহ ব্যাপার৷ পরিকল্পনাহীন ব্যবস্থাপনা, দূর্বল অর্থনীতি, অপরিকল্পিত নগরায়ন থেকে পরিবেশে ব্যাপক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তাঁর প্রতিকার
আরও পড়ুন- গ্রীন হাউজ কি? গ্রিন হাউজ ইফেক্ট কি? গ্রিন হাউজ ইফেক্টের কারণ