বরাতে শিল্পী হওয়াই লেখা ছিল। চেয়েছিলেনও শিল্পকেই পেশা হিসেবে নেয়ার। তবে সমস্ত পরিকল্পনা একেবারে একশো আশি ডিগ্রি বেঁকে গেল বাবা আর ভাইয়ের চাপে।
কেসটা কেশে পরিষ্কার করে বলি। ভেঙ্কটেশ প্রভু কস্তুরি রাজার ভীষণ ইচ্ছে ছিল রন্ধনশিল্পে কিস্তিমাত করার। লা জওয়াব রান্নার জবাবে লোকের চোখেমুখে যে আনন্দের ঝিলিক ভেসে ওঠে, ওতেই জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেতেন।
রান্নাটাকে শখের ট্যাগ পরিয়ে পাশেই রাখতে হয়েছে। তবে কোটি ভক্তের ওই আনন্দের হেতু কিন্তু ঠিকই হতে পেরেছেন সেই যুবা অর্থাৎ আজকের ধানুশ।
আরম্ভে দক্ষিণে ভক্তি মিললেও, গোটা ভারত এবং ক্রমে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার তাগড়া ঘোড়া দিনকে দিন সামনেই এগিয়ে যাচ্ছে তাঁর। একের পর এক ধুন্ধুমার পারফরম্যান্স শুধু দর্শককেই থিয়েটারে টানছে না, সাথে সমালোচকদের চোখেও আদরণীয় রজনীকান্ত-জামাতা।
ধানুশের ঝুলিতে টানা হিটের সংখ্যা নেহাতই বেশি। এর মাঝে গোটা পাঁচকে সামনে আনা জটিল কম্মো, তাই সাম্প্রতিক আর বার্তা নির্ভর চলচ্চিত্রগুলোই ঠাই দিলাম তালিকায়।
ধানুশের সেরা ৫ সিনেমা
Asuran (2019)
মানুষের সুরাসুর- আসুরান যেন সেই বার্তারই বাহক ; Photo: IMDb
‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।
লালন বলে জেতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে।‘
কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ কায়স্থ, কেউ মুসলিম, কেউ বৌদ্ধ- এতো বাহ্যিক পরিচয়, অন্তরে সকলে ঈশ্বরের সৃষ্টি। অথচ ইতিহাসের পানে তাকালে আমরা দেখি, এই সরল সত্যকে কূট প্যাঁচে জড়িয়ে শুধু বিভেদই প্রবল দম্ভে দাঁড়ানো।
অসুরের উত্থান যুগে যুগে ধ্বংসের ইঙ্গিত হিসেবে প্রকট। মানুষের মাঝেও যখন ধ্বংসাত্মক লীলা রুদ্রপ্রতাপে জাগে, তখন তো তাকে অসুরের সাথেই তুলনা করা হয়। তবে আসুরিক উত্থানের পেছনের গল্পটা অনেক সময়েই চাপা পড়ে যায় তাণ্ডবে।
‘আসুরান’ এর আখ্যানটাও অনুরূপ। তামিলনাড়ুর তিরুনেল্ভেলি, আশির দশকে আজকের মতো এতটা ঠাটবাট ছিল না ওখানে। জাতপ্রথা তখনও ভীষণ বিক্রমে শাসন করছে সমাজ। শিভাস্বামী সেই সমাজেরই একজন নাগরিক,তবে সে শুধু কাগজে-কলমে। আদতে নিচু জাতকে তো মানুষ হিসেবেও গ্রহণীয় নয়।
নারাসিমহান সে তুলনায় কেউকেটা, স্থানীয় জমিদার, উঁচু জাতের প্রতিভূ। তিন বিঘে জমির লোভে শিভাস্বামীর সাথে বিরোধ বাধে নারাসিমহানের। সেই বিরোধের জেরে খুন হয় ভেলমুরুগান, শিভা-পাচিআম্মার বড় ছেলে। কিন্তু স্বজন হারানোতেই কি এই বিরোধের সমাপ্তি হয়? নাকি জাত প্রথা ডেকে আনে কুরুক্ষেত্র? শিভাস্বামীই বা নিশ্চুপ কেন? পুত্রশোক নাকি অতীতের রক্তাক্ত ইতিহাস তাড়া করে ফেরে তাঁকে?
দুর্ধর্ষ একশনের ছবিতে নাকি গল্প থাকে না, সেই মিথকে নাকচ করে দিয়েছে ‘আসুরান’। ভারতের সাহিত্য একাডেমী পুরস্কারজয়ী তামিল লেখক পুমানির খ্যাতনামা উপন্যাস ‘ভেক্কাই’ থেকে নির্মিত এই ছবিকে ধানুশকে শুধু অনন্য উচ্চতাতেই নিয়ে যায়নি, পরিচালক ভেট্রিমারানের সাথে তাঁর জোটকেও অপ্রতিরোধ্য প্রমাণ করেছে। ১৩৯ মিনিটের এই একশন-ড্রামা ছবিতে আরও আছেন মাঞ্জু ওয়ারিয়ের, প্রকাশ রাজ, পাশুপাথি প্রমুখ।
দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফির সাথে পরিমিত সংলাপ এবং ক্ষুদ্র চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনই আসুরানের সর্বমহলা জনপ্রিয়তার কারণ। গুরুতর এবং তর্কমুখর বিষয়ের পাশাপাশি বহু সত্য ঘটনাকে সেলুলয়েডে তুলেছে ছবিটি। যেমন ধরুন, ১৯৬৮ তে ঘটে যাওয়া কিলভেনমানি গণহত্যা কিংবা দলিতের প্রতি দৈনন্দিন নির্যাতন। একবিংশ শতকে স্রেফ ব্যবসাসফল হিসেবে এটি পরিগণিত হলেও নিঃসন্দেহে দলিত শ্রেণি ও জাত বৈষম্যের নিদারুণ চিত্রায়ন জাতীয় পুরষ্কার জেতা ছবিটি। IMDb রেটিং ৮.৫।
ধানুশের এই মুভিটি ইউটিউবে দেখতে ক্লিক করুন এখানে – আসুরান
Karnan (2021)
নিগ্রহের রক্তাক্ত অধ্যায়ের ব্যঞ্জনমুখর প্রকাশ কারনান; Photo: Filmibeat
গনগনে সূর্যের দিন, পিচ ঢালা রাস্তার মাঝেই শুয়ে আছে বছর দশের এক মেয়ে। কম্পিত দেহ ,ক্রমে মুখ বেয়ে নেমে আসছে ফেনা- মৃত্যুর লক্ষণ। অথচ দুপাশ দিয়ে স্রোতের মতো চলমান যান, তুমুল গতির প্রতিযোগে থামবার সময় নেই কারো!
যন্ত্রের গতির কোলে মানবতার মৃত্যু, ধীরে ধীরে শট টা আরও উপর থেকে দেখি আমরা, যেন ঈশ্বরও স্বয়ং দেখছেন। ছবির প্রথম দৃশ্যেই বীভৎস মৃত্যু। শিহরিত করবার জন্য যথেষ্টই বটে। এই মৃতা শিশুই পরবর্তীতে গ্রামীণ দেবী কাত্তু পেচি রূপে আবির্ভূত হয়, অধিকার আদায়ের সংগ্রামের অগ্নিপ্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
তামিলনাড়ুর প্রান্তিক দুই গ্রাম- মেলুর ও পোড়িয়ানকুলাম। জাতপাতের বিচারে মেলুর অধিপতিরা পোড়িয়ানকুলামের চেয়ে ঢের এগিয়ে। তারই ফায়দা তোলে তারা যোগাযোগ, শিক্ষা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও। বহু যুগ এই অপশাসনের তলে পিষ্ট পোড়িয়ানবাসী এক সময় মাথা তুলে দাঁড়ায়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে উগড়ে দেয় নিগ্রহের ক্ষোভ।
১৯৯৭ সালের পটভূমিকে কেন্দ্র করে হিন্দু দলিত সম্প্রদায় এবং উঁচু জাত ও পুলিশ প্রশাসনের সংঘাতকে তুলে এনেছেন পরিচালক মারি সেলভারাজ। ফোক ধারার সঙ্গীত ও নৃত্যকলার নানান রূপকের পাশাপাশি মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্রকেও যেমন- কর্ণ, দ্রৌপদী, যম উপস্থাপিত হয়েছে সফলভাবেই। কাত্তু পেচির রূপক সমালচকদের সন্তুষ্ট না করলেও আরেক তামিল দেবী পেচিআম্মানের (তামিল গ্রামীণ দেবী যে একই সাথে ধাত্রীবিদ্যা, যুদ্ধবিদ্যা এবং নীতিবিদ্যায় পারদর্শী) সংযোগ ভালোভাবেই এনেছেন মারি।
ধানুশ ছবির মূল চরিত্র হলেও সম্পূর্ণ হিরোয়িক আদর্শে তাঁকে গড়েননি সেলভারাজ। সাহসী যুবক হিসেবে প্রতিভাত হলেও যুক্তিবুদ্ধি কিংবা বিতর্কের ঊর্ধ্বে ‘কারনান’ ওঠেনি। তবে বিতর্কের হাওয়া ঠিকই লেগেছে বছরের অন্যতম সেরা এই ছবির গায়ে।
গত শতকের শেষভাগে তামিলনাড়ুর কোরিয়ানকুলাম সহিংসতার ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৫ সালে। তখন ৬০০ পুলিশ ও স্থানীয় শাসকশ্রেণীর আক্রমণে পাল্লার বর্ণের প্রায় ২৮৭টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সহায় সম্পত্তি হারায়। নিচু বর্ণের লোকেদের অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। সেলভারাজের ছবিতেও উঠে এসেছে এই সহিংস সংঘাতের রোমহর্ষক চিত্র। তবে তথ্যগত ভিন্নতাকে ফিকশন হিসেবে মানতেই অনুরোধ পরিচালকের। করোনা কালেও সাফল্যের মুখ দেখেছে ২ ঘণ্টা ঊনচল্লিশ মিনিটের লাল, রাজিশা বিজয়া অভিনীত ছবিটি।
IMDb রেটিং ৮.২।
Aadukalam (2011)
মোরগ-লড়াই; দূর থেকে তাকালে স্রেফ নিষ্কণ্টক গ্রামীণ খেলাই মনে হবে। তবে মাদুরাইয়ের ক্রিড়াপ্রেমী জনতার কাছে এ শুধু নিছক আনন্দের উপকরণই নয়, সম্মানেরও নির্ধারক।
পেত্তাইকারান ও রাথনাসামির মধ্যকার প্রতিযোগিতা এই মোরগ লড়াইকে ঘিরেই। এই নিরীহ খেলা ক্রমে আমোদের বদলে প্রতিহিংসায় রূপ নিতে থাকে দুজনের মাঝে। ক্রীড়ার নৈতিক দৃষ্টিকোণ আর প্রতিশোধের স্পৃহা- দুই ধারার সংঘাত ক্রমে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করে খেলার মাঠকে। সেই উত্তাপের আঁচ লাগে গ্রামের অন্য তরুণদের মতো কারুপ্পুর পৌরুষেও। পেত্তাইয়ের শিষ্যত্বের ঠাই থেকে ক্রমশ নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে থাকে সে।
মনঃস্তাত্বিক থ্রিলার প্রেমিদের জন্য আদর্শই ‘আদুকালাম’; Photo: Upperstall.com
কারুপ্পুর মুনশিয়ানাই ক্রোধে অন্ধ করে তোলে পেত্তাইকে। যেই খেলা ছিল মোটে দুজনের অহমের হাতিয়ার , সেটাই সমস্ত গ্রামে বিশ্বাসঘাতকতার বীজ ছড়িয়ে দেয় একদিন। এর সমাপ্তি ঘটে রক্তক্ষয়ী এক ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে।
১০ কোটি বাজেটের ‘আদুকালাম’ আদায় করেছিল ৩০ কোটি। হালজমানায় মুক্তি পেলে কপালে রাজটীকাই পড়তো এর। মোরগ লড়াইয়ের কূট কৌশলের খুঁটিনাটি যেমন দর্শককে মুগ্ধ করেছে ,তেমনি প্রতিটি চরিত্রের মনঃস্ত্বত্বের সংযোগও হয়ে উঠেছে প্রাসঙ্গিক।
১৬০ মিনিট ব্যাপ্তির এই একশন- ড্রামায় আরও রয়েছেন তাপসী পান্নু, কিশোর, মুরুগাদস প্রমুখ। ভেট্রিমারান পরিচালিত ছবিটি ভারতের ৫৮ তম জাতীয় পুরষ্কারের আসরে আদায় করে নেয় ৬ টি এ্যাওয়ার্ড।
IMDb রেটিং ৮.১।
Vada Chennai (2018)
কলিউডে ধানুশ- ভেট্রিমারান জুটির অনবদ্য উপহার ‘ভাডা চেন্নাই’ বা ‘উত্তর চেন্নাই’। আশি, নব্বই এবং মিলেনিয়ামের দশক- এই তিন সময়কালে স্থানীয় মাফিয়ার উত্থানপতন এবং পালাবদলের উত্তেজনাময় স্বাদ পাবেন দর্শক।
আনবু- ক্যারম খেলোয়াড় থেকে মাফিয়া দলের বিশ্বস্ত ডানহাত ; Photo: The Hindu
প্রথম ভাগে ধুন্ধুমার একশন আর গরাদের জীবনে থ্রিলের হরদম আনাগোনা থেকে ক্রমশ রহস্যময়তার দিকে এগিয়ে যায় সিনেমার গল্প। ধীরে ধীরে উত্তোলিত হয় নদী তীরবর্তী দরিদ্র জনপদের জীবন আর মাফিয়াদের দৌরাত্মের রক্তাক্ত ইতিহাস।
ট্রিলজির পরিকল্পনা নিয়েই ধানুশ- ভেট্রির এই প্রজেক্ট। ইতোমধ্যেই দর্শক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এর দ্বিতীয় কিস্তি। ঐশ্বরিয়া রাজেশ, আন্দ্রেয়া জেরেমিয়াহ, কিশোর প্রমুখ দর্শক নন্দিত অভিনেতাও রয়েছেন ক্রাইম-একশন-থ্রিলারে।
IMDb রেটিং ৮.৫। মুভিটি ইউটিউবে দেখতে ক্লিক করুন এখানে- Vada Chennai
Maryan (2013)
২০০৮ সাল, সুদানের দারফুরে তিন ভারতীয় তেল শ্রমিক অপহৃত হন সেদেশের সন্ত্রাসীদের হাতে। ২১ দিনের নিদারুণ অত্যাচারের পর পালাতে সমর্থ হন তাঁরা। সেই ঘটনাই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্দায় তুলে আনেন পরিচালক ভারত বালা। তবে তেল শ্রমিকের বদলে তিন ভাগ্য বিড়ম্বিত জেলে যুবাকেই স্পটলাইটে রেখেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত, ‘সাউথের জেলেরা ভীষণ কঠিন জীবনকে বেছে নিয়েছে বংশানুক্রমেই। তাঁরা ভাগ্যের সাথে লড়াই করে টিকে থাকে । সেই সংগ্রামটাই আমি দেখাতে চেয়েছি।‘
বাস্তবের ভিত্তিতে হলেও চলচ্চিত্রের দাবিতেই মারিয়ান ও পানি মালারের প্রেম আখ্যান হাজির হয় ছবিতে। তবে এতে ছবির রাশভারিক্কি ভাব কিংবা মূল বার্তা মোটেও কমে না। বরং মারিয়ানের বন্দীদশা থেকে উত্তরণের শক্তি হিসেবেই কাজ করে মালারের ভালোবাসা।
আরোপিত নায়ক নয়, সাধারণ জেলে যুবক হিসেবেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন ধানুশ; Photo: India Today
ধানুশের সাথে পাল্লা দিয়ে এতে অভিনয় করেছেন পার্বতী থিরোভোথু, জাগান, আপ্পাকুট্টি সহ আরও অনেকে। ১৩৩ মিনিট দীর্ঘ ছবিটির মূল চিত্রায়ন হয়েছে কন্যাকুমারী, সুদান ও নামিবিয়ায়।
IMDb রেটিং ৭.১। ধানুশের এই মুভিটি ইউটিউবে দেখতে ক্লিক করুন এখানে- Maryan
লিখেছেন- সারাহ তামান্না
আরও পড়ুন- ইরানি সিনেমায় সেরা পাঁচ