দুর্নীতি জাতীয় জীবনে অভিশাপস্বরূপ / দুনীতি জাতীয় জীবনে সকল উন্নতির অন্তরায়
মূলভাবঃ
কোনও বিজ্ঞানই- রাজনীতির সংক্রমণ এবং ক্ষমতার দুর্নীতির প্রতিরোধ করতে পারে না ।
— জ্যাকব ব্রোনভস্কি
নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য অসৎ পন্থা অবলম্বন করে যখন নীতিকে বিসর্জন দিয়ে কোন কাজ করা হয় সেটিকে বলা হয় দুর্নীতি। এক কথায়, নীতিহীন বিবেকবর্জিত সকল কিছু দুর্নীতি। দুর্নীতি ব্যক্তি ও রাষ্ট্র- উভয়ের জন্যই অভিশাপস্বরূপ৷ দুর্নীতি জাতীয় জীবনে সকল উন্নতির অন্তরায়।
সম্প্রসারিত ভাবঃ
যে কোন রাষ্ট্রের জনগণকে ভালো রাখার প্রথম শর্ত হচ্ছে দেশের উন্নয়ন। কারণ, রাষ্ট্র ও উন্নয়ন এই শব্দ দুটো একসূত্রে গাঁথা। কিন্তু, দেশের অগ্রগতির প্রথম বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ যখন নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নিজের বিবেককে বিসর্জন দিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নেয় তখন সেই মানুষটি হয়ে উঠে রাষ্ট্রের জন্য বিষাক্ত। সে লোভে বশীভূত হয়ে নিজের সাময়িক উন্নতির আশায় দুর্নীতির আশ্রয় নেয় আর এতে করে ক্ষতি হয় সমাজের, আরও অন্য দশজনের। একজন অদক্ষ লোকের দ্বারা সমাজের কোন কল্যাণ না হলেও তার দ্বারা সমাজের কোন ক্ষতি হয়না। আর একজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি যতই কর্মক্ষম হোক না কেন সে হয় গিরগিটির মত। নিজের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যেকোন সময় সে নিজের রূপ বদলে ফেলতে পারে৷ ইস্রায়েলমোর আইভোর বলেছেন-
“কোন জাতিকে ধ্বংস করতে আপনার বোমার প্রয়োজন নেই । রাজনীতিবিদরা যারা নাগরিকের জীবনের চেয়ে তাদের পকেটকে মূল্য দেন, তারা এটা সর্বদাই করে।”
ব্যক্তিজীবন হোক বা রাষ্ট্রজীবন, উভয় ক্ষেত্রে সাফল্য লাভের জন্য সততার কোন বিকল্প নেই। জাপান যুদ্ধবিধধস্ত দেশ হয়েও নিজেদের উন্নত দেশ হিসবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে শুধুমাত্র সততা আর পরিশ্রমের বলে। একটি দুর্নীতিগ্রস্থ জাতির উন্নয়নটাও হয় নড়বড়ে। ধরুন, একটি ব্রীজ তৈরি করা হবে। এই প্রজেক্টের ভার এমন একজনের উপর অর্পণ করা হয়েছে যে কিনা আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজ। সেই ব্যক্তি সর্বপ্রথম নিজের পকেট ভর্তি করবে তারপর অল্প যা অবশিষ্ট থাকবে তা দিয়ে খুবই নিম্নমানের উপকরণ কিনবে৷ সব মিলিয়ে সে ব্রীজ টেকসই হবে বাঁশের ব্রীজের মতো।
দুর্নীতির ছোবল বড্ড বিষাক্ত। একজন দুর্নীতিবাজ লোকের হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া দেখে দেশে তার মতো আরও অনেকে ধনী হওয়ার সহজপন্থা অবলম্বন করতে চাইবে৷ আর এভাবেই শুরু হয় একটি জাতির কালো অধ্যায়ের গল্প।
দুর্নীতির দ্বারা পরোক্ষভাবে আরো অনেক অপরাধের উত্থান ঘটে। মিথ্যাচার, অনাচার, ব্যভিচার, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস এই অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে দুর্নীতি পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে। আর এভাবে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র জীবন নিমজ্জিত হয় অন্ধকারে। এই অন্ধকার অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া পরবর্তীতে ভীষণ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে৷ একজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি যতই গুণী আর বিদ্যান হোক না কেন সর্বোপরি সে হয় একজন নীতিহীন মানুষ।
বাংলাদেশের মত মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অন্যান্য সমস্যার মত দুর্নীতিও একটি বড় সমস্যা। আর এই সমস্যাই হচ্ছে দেশের উন্নয়নের অন্তরায়। বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে শুধুমাত্র দুর্নীতিরোধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জিডিপি ২-৩ শতাংশ বৃদ্ধি ও দেশের মানুষের আয় দ্বিগুণ হওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের জনগণের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের ৭৫ ভাগই দুর্নীতিবাজরা আত্মসাৎ করে নেয়। ফলে, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যকার বৈষম্য আরো প্রকট হয়ে ধরা পড়ে।
দুর্নীতি বর্তমানে আমাদের জাতীয় সমস্যা। শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি অফিস, সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির জয়জয়কার। ধরুন, এক ব্যক্তি চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে গেল। ইন্টারভিউ বোর্ড যদি তার মেধা যাচাইয়ের পরিবর্তে, সে তাদের ব্যাংকে কত টাকা পাঠাতে পারবে সে হিসেবে ব্যস্ত থাকে তবে সেই চাকরি প্রার্থীর ভাবনায় দুর্নীতির বীজ সেদিনই বপন হয়ে যাবে৷ এ পরিস্থিতিতে একজন বাধ্য হয়ে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে আর অন্যজন অপরপক্ষের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাকে বাধ্য করছে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে। এভাবে ধীরে ধীরে একটি জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির গল্প রচিত হয়৷
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর যে সমস্ত নেতিবাচক রেকর্ডের ভাগিদার হয়েছে তারমধ্যে সর্বাপেক্ষা তিক্ত রেকর্ড হচ্ছে পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে প্রথম স্থান অর্জন করা৷ ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২০’–এ বাংলাদেশ ১০০ স্কোরের মধ্যে পেয়েছে ২৬। ২০২২ সালে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান সারা বিশ্বের মধ্যে ১২তম আর দক্ষিণ এশিয়াতে দ্বিতীয়।
মন্তব্যঃ
একটি সুন্দর দেশ আমাদের সকলের কাম্য। দেশের প্রতি আমাদের সবারই কিছু দায়িত্ব থাকে। তাই, সবাই মিলে যার যার অবস্থান থেকে দুর্নীতিকে প্রতিহত করতে হবে৷ পিটার আইগেন এর ভাষায় –
“জনগণ সচেতন হওয়া উচিত যেন তারা দুর্নীতির অবস্থা পরিবর্তন করতে পারে ।”
আরও পড়ুন- ভাবসম্প্রসারণঃ ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ
আরও পড়ুন- ভাবসম্প্রসারণঃ একতাই বল
আরও পড়ুন- ভাবসম্প্রসারণ: কীর্তিমানের মৃত্যু নেই / মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়