তালিবান শব্দটি উঠে এসেছে আরবি শব্দ থেকে যার শাব্দিক অর্থ শিক্ষার্থী। তালিবানরা তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে এই সংগঠনের জন্ম বলে এর নাম দেয়া হয় তালিবান। যদিও আফগানিস্তানে এর সূত্রপাত, কিন্তু এক সময় পাকিস্তানে তাদের আস্তানা গড়ে তুলে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের ৩০ টি জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে অন্যতম ছিল টিটিপি। ২০০৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন উপজাতীয় নেতা বায়তুল্লাহ মেহসুদ। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আফগান প্রেসিডেন্ট বোরহান উদ্দিনকে হটিয়ে তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তানি উপজাতীয় নেতারা তখন আফগান সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তানে এসে তাদের কার্যক্রম শুরু করেন।
শুরুতে এরা জঙ্গি গোষ্ঠী নামে পরিচিত হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এদের বেশ ভালোই সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলা হওয়ার পর আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপর অনেক তালিবান যোদ্ধারাই পাকিস্তানে চলে আসেন। অভিযোগ রয়েছে যে, যখন তালিবানকে সাহায্যের জন্য খাইবার পাখতুনখাওয়ার পার্বত্য এলাকায় আস্তানা গড়ে তুলে তখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের সেসময় তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
তালিবান সরকার মূলত কট্টরপন্থী ছিলেন। এরা একটা সময় যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় উৎখাত হয়েছিলো। ইতিহাসের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় যে, তালিবানরা এর কিছুদিন পরেই বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিরোধ করতে শুরু করে। আর এই প্রতিরোধ করার জের ধরেই তাদের শক্তি এবং প্রতিরোধের মাত্রা কমতে এবং বাড়তে থাকে। তালিবান গোষ্ঠী সাধারণত জঙ্গি গোষ্ঠী। পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের শরিয়া আইনের প্রতিষ্ঠার জন্য এরা অনেককাল লড়ে গেছেন। সাধারণত এই গোষ্ঠী ধর্ষক এবং খুনিদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দিতে অর্থাৎ এমন শাস্তি দিতে তারা পক্ষে ছিলেন। দূরবর্তী দেশ আফগানিস্তানে পুরুষদের দাঁড়ি রাখা এবং নারীদের বোরকা পরার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক এক নিয়ম ছিল। আর এই নিয়ম পালন করা হতো মুস্লিম নারী পুরুষদের মাঝে। একটা সময় এরা গান শোনা, সিনেমা দেখা ইত্যাদির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তাছারা দশ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের ছিল না স্কুলে যাওয়ার অনুমতি!
তাদের বিভিন্ন আন্দোলনের প্রধান ছিলেন মোল্লা মুহাম্মাদ উমার। উমারের পরেই ছিল সামরিক কমান্ডার ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের একটি ইউনিটের অবস্থান। দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরেও এরা আফগানের রাজধানী কাবুলের ক্ষমতাসীন ছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পরেও মাত্র তিনটি দেশ তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সেই তিনটি দেশ হলো পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
মুসলিম শরিয়া ভিত্তিক শাসনে তালিবানরা বরাবরই কঠোর ছিলেন। ক্ষমতায় থাকার সময় এরা এযাবৎ কালে সবচেয়ে বেশী কঠোর ছিলেন। বিশ্বে সবচেয়ে নিন্দিত ছিল নারীদের প্রতি অন্যায় এবং বিরূপ আচরণের জন্য। শিক্ষা, চাকরী, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত করতো। এমনকি পুরুষ ডাক্তাররা তাদের চিকিৎসাও করতে পারতো না। একান্ত দরকারে স্বামী বা আত্মীয় নিয়ে যেতে হতো। জানা যায়, পুরুষ মহিলা কেউ তালিবান আইন ভঙ্গ করলেই তাদের কঠিন শাস্তি দেয়া হতো। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানে ইসলামি আমিরাত প্রতিষ্ঠা করে। ২০০১ সালে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স ও ন্যাটো জোটের যৌথ অভিযানে তালিবান সরকারের পতন হলেও সম্পূর্ণ এদের শেষ করা যায়নি। বর্তমানে এরা শক্তিশালী অবস্থায় আছে। জানা যায়, ২০২০ সালে আফগানিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে বেশ কিছু সেনা প্রত্যাহার করবে। যদি তালিবানরা যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া চুক্তির শর্ত মানে তাহলে আগামী ১৪ মাসের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান সেনাদের সবাইকেই প্রত্যাহার করে দিবে।
আফগানদের গৃহযুদ্ধের সময় তালিবানরা তাদের নিজস্ব সাদা পতাকা ব্যবহার করতো। তালিবানরা ১৯৯৬ সালে কাবুলের উপর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে ও আফগানিস্তানকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। তালিবানদের এই সাদা পতাকা তাদের কাছে এক সময় জাতীয় পতাকা হিসেবে চিত্রিত হয়। এই সাদা পতাকা বিশ্বাসবোধ এবং তালিবান সরকারের বিশুদ্ধতার প্রতিক হিসেবে পরিচিত হয়। ১৯৯৭ সালের পর ওই পতাকায় শাহাদাহ চিহ্ন যুক্ত করা হয়। আফগানিস্তানে বর্তমানে তালিবানের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। দেশটির একটা বড় অংশে তাদের সক্রিয় উপস্থিত আছে। দেশটির রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তারা হুটহাট হামলা চালাচ্ছে। এই বেপরোয়া হামলার পরিমান দিনদিন কেবল বাড়ছেই। এরা সাধারণত তাদের হামলায় শক্তিশালী বিস্ফোরক সহ অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে আসছে। বিভিন্ন এই অস্ত্র ব্যবহার করতে হামলা সহ সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করতে প্রচুর অর্থ খরচ করছে এই তালিবান গোষ্ঠী।সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ইতিহসের মধ্যে তালিবানরা উঠে এসেছে তাদের এই যুদ্ধ, জঙ্গি সাংগঠনিক কাজের জন্য। এইসব অস্ত্রশস্ত্র তাদের হাতের মুঠোয় আসার পরেই তাদের শক্তি বাড়তে থাকে আর সেই শক্তির অপব্যবহারের কারণেই হয়ত এই গোষ্ঠী আজ সমালোচনার মুখে।
তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যে এতো অর্থ তালিবানদের কোত্থেকে আসে! এ সম্পর্কে জানা যায় যে, দেশের ভেতর এবং বাইরে দুই জায়গা থেকেই অর্থের জোগান আসে। গত বছর ডিসেম্বর নাগাদ বিবিসি এক প্রতিবেদন জানায়, জঙ্গিবাদের খরচ মেটাতে তালিবানরা একটি অত্যাধুনিক আর্থিক নেটওয়ার্ক ও কর-ব্যবস্থা চালিয়ে আসছে। তালিবানদের আয় সম্পর্কে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে যা হচ্ছে আট বছর আগে তাদের বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৪০ কোটি ডলার। গত কয়েক বছরে তাদের যে প্রতিপত্তি বেড়েছে তেমন করে বেড়েছে তাদের আয়ও। তালিবানদের বর্তমান বার্ষিক আয় দেড়শ কোটি ডলারের কাছাকাছি। তারা স্বীকার না করলেও তাদের দেশের ভেতরে আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে মাদক। আফগানিস্তানেই রয়েছে আফিমের উর্বর ভূমি। আর সেই সুবাদে বিশ্বে আফিমের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী দেশ এই আফগানিস্তান। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তালিবানরা আফগানের হয়ে আফিম চাষ করে থাকে। আফিম অর্থনীতির জোরে তালিবানদের অর্থ ভাণ্ডারও এখন বাড়বাড়ন্ত!
২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারের হামলা হয় আর সেই হামলার মূল হোতা হিসেবে আল কায়দা প্রধান ওসামা বিল লাদেনকে চিহ্নিত করা হয়। ওসামা বিন লাদেনের সাথে তালিবানদের সুসম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। কারণ হিসেবে জানা যায় সোভিয়াতের বিরুদ্ধে আফগানিস্তান যখন যুদ্ধ করে তখন লাদেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। যার দরুন ৯/১১ এর হামলার পর পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” নামে এক পরিকল্পনার ঘোষণা দেন।
২০০৬ সালের মদ্ধে তালিবান মুজাহিদদের পিছু হটতে বাধ্য করেন। এবং তারা এই কারণে দূরবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ চালাতে থাকে। বর্তমানে আফগানিস্তানদের হেলমান্দ এবং কান্দাহারের অধিকাংশ অঞ্চল তালিবানদের অধীনে রয়েছে। ২০০৬/৭ এর দিকে তালিবানদের সদস্য সংখ্যা যেখানে মাত্র হাতেগোনা পনেরো হাজার ছিল, আজ সেখানে তা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ষাট হাজারের কাছাকাছিতে। আর তাই এতো বছরেও তালিবানদের কেউ দমন করতে পারেনি। ধারণা করা হয় যে, আফগান তালিবানের শীর্ষ নেতা মোল্লা ওমার সহ অনেকে এক সময় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাকিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে পাকিস্তান তালিবানের সহযোগিতায় হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য লড়াই অব্যহত রাখেন তালিবান। অনেকেই মনে করেন যে মোল্লা ওমারই এখন আফগান তালিবানের হয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তালিবানের সাথে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সরকারের শাস্তির প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চলে আসছে। সর্বশেষ গত বছরের জুনে কাতারে তাদের নিজস্ব কার্যালয় খুলেছিলেন আফগান তালিবান। তারা আশা করেছিলেন সেই কার্যালয় সরকারের সাথে সমঝোতায় এলে একটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু দুই পক্ষের চরম অবিশ্বাসের কারণে সম্পর্কে ফাটল ধরে। যার দরুন তাদের আশাও আর পূরণ হয়নি বলে জানা যায়। তাদের কার্যক্রমের কারণেই হয়ত সারা বিশ্ব জুড়ে সমালোচনার মুখে থাকবে এই জাতি।