আমাদের চারপাশে অসংখ্য মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে শহরে বসবাস করা প্রায় প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ এই রোগে আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে ডায়াবেটিস এখন একটি মহামারি রোগ। ডায়াবেটিস সহজে সারে না কিন্তু এটি সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। পুরো বিশ্বে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। ২০২৫ সালের মধ্যে এ সংখ্যা দ্বিগুনের বেশি ছাড়িয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা মোট ১ কোটি ১০ লাখ।
ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে ডায়াবেটিস সংক্রান্ত কিছু প্রাথমিক তথ্য আমাদের সকলের জেনে রাখা দরকার। ডায়াবেটিস কি, কেন হয়, এর লক্ষণ, ডায়াবেটিস নিয়াময়যোগ্য কিনা কিংবা ডায়াবেটিস কি বংশগত রোগ কিনা, ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা, ডায়াবেটিস কমানোর উপায়- এসব নিয়েই আজকে আমরা আলোচনা করবো।
ডায়াবেটিস কি, কেন হয়?
আমরা যখন কার্বোহাইড্রেট বা সাধারণ শর্করা জাতীয় কোন খাবার খাই তখন আমাদের শরীর সেই খাবারের শর্করাকে ভেঙ্গে চিনি বা গ্লুকোজে পরিণত করে। মানবদেহে অগ্ন্যাশয় নামের একটি গ্রন্থি আছে যেটি দেখতে অনেকটা গাছের পাতার মতো। এই অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নামক একটি হরমোন নিঃসৃত হয়। ইনসুলিনের কাজ হচ্ছে গ্লুকোজকে মানব দেহের কোষগুলোয় পৌঁছে দেয়া। এই গ্লুকোজ ব্যবহার করে শরীরের কোষগুলো শক্তি উৎপাদন করে। আর এই শক্তিই দিয়ে মানুষ তার দৈনন্দিন কাজকর্ম করে।
কোন কারণে অগ্ন্যাশয় থেকে এই ইনসুলিন যদি আর নিঃসৃত না হয় তবে রক্তে গ্লুকোজ বা চিনির মাত্রা বেড়ে যায়। রক্তে চিনি বা গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়াকে বলা হয় ডায়াবেটিস।
ডায়াবেটিসের ফলে মানব দেহের কোষগুলোতে গ্লুকোজ পৌঁছাতে পারে না। এতে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত গ্লুকোজ সাধারণত প্রসাবের মাধ্যমে মানব দেহ থেকে বের হয়ে যায়। এই কারণে ডায়াবেটিস রোগীর ঘনঘন প্রসাব হয়। অপরদিকে গ্লুকোজ দেহের কোষগুলোতে পৌঁছাতে না পারায় কোষগুলো প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করতে পারে না। ফলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর শরীর দূর্বল হয়ে যায়।
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ
ডায়াবেটিস সাধারণত দুই রকম। টাইপ-১ ডায়াবেটিস, টাইপ-২ ডায়াবেটিস।
টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীর শরীরে ইনসুলিন একেবারেই তৈরি হয়না। বলা যেতে পারে তাদের অগ্ন্যাশয় নামের গ্রন্থিটি পুরোপুরি কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের পুরোপুরি ওষুধের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাদের সবসময় চিকিৎসকদের পরামর্শে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। মোট আক্রান্তদের ১০ শতাংশ টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। টাইপ-১ রোগীদের লক্ষণ ছোটবেলা থেকেই দেখা দিতে পারে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর অগ্ন্যাশয়ে যথেষ্ট ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না অথবা উৎপন্ন হলেও ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজ করে না।
যখন আমাদের শরীরে স্থূলতা বেড়ে যায় তখন ইনসুলিন তার কার্যকরীতা হারিয়ে ফেলে। খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ যখন কাজের চেয়ে বেশি হয়ে যায় তখন অতিরিক্ত খাবার চর্বি হিসেবে আমাদের শরীরে জমতে থাকে৷ এই চর্বি পেটে অধিক পরিমাণে জমে থাকার কারণে ইনসুলিন তার কার্যকরীতা হারিয়ে ফেলে। ফলে, শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যায়। এটিকে বলা হয় টাইপ ২ ডায়াবেটিস। বয়স ৪০ বছরের বেশি হওয়ার পর থেকে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে কারা বেশি থাকে?
অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে ডায়াবেটিস বংশগত রোগ কিনা। যাদের মা-বাবা বা পরিবারের সদস্যদের ডায়াবেটিস আছে তাদের বংশগতভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আসলে আমরা কেউই ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নই৷ নিম্নোক্ত চার শেণীর মানুষ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে বেশি থাকে।
- যাদের পরিবারের কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
- যাদের ওজন বেশি।
- যারা কায়িক শ্রম তুলনামূলক কম করে।
- যারা স্টেরয়েড জাতীয় ঔষুধ দীর্ঘ দিন ধরে সেবন করে আসছে৷
ডায়াবেটিসের লক্ষণ
কোন ব্যক্তি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে তার শরীরে নিম্নোক্ত লক্ষণসমূহ দেখা যায়। যেমন:
১. ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া
২. পানির তেষ্টা পাওয়া
৩. ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া। নিয়মিত খাওয়ার পরও ঘন ঘন ক্ষুধা অনুভব করা
৪. প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করা
৫. চোখে ঝাপসা বা কম দেখতে শুরু করা
৬. শরীরের কোন অংশ কেটে গেলে সহজে না শুকানো, চামড়ায় শুষ্ক, খসখসে ও চুলকানি ভাব
৭. নিয়মিত খাওয়া সত্ত্বেও কোন কারণ ছাড়া ওজন কমে যাওয়া
৮. হাতে-পায়ে ব্যথা বা মাঝে মাঝে অবশ হয়ে যাওয়া
৯. দূর্বল বোধ করা
১০. মিষ্টি জাতীয় খাবারের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা
১১. অল্পতেই বিরক্ত হয়ে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়
ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। কিন্তু হাঁটা চলা, খাবার অভ্যাস, জীবন যাপনে শৃঙ্খলা আনলে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই রোগ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার কিছু উপায় নিচে তুলে ধরা হল-
১. প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘন্টা হলেও হাঁটা৷ পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
২. মিষ্টিজাতীয় খাবার, ফাস্টফুড, পোলাও, বিরিয়ানি, রেড মিটের মতো ভারী খাবার এড়িয়ে চলা।
৩. নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর রক্তের শর্করা পরিমাণ পরিমাপ করা।
৪. চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষুধ সেবন।
৫. ধূমপান ও মদ্যপান থেকে নিজেকে বিরত রাখা।
ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খাদ্যের ব্যাপারে সচেতন হওয়ার কোন বিকল্প নেই। কিছু খাবার আছে যেগুলো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা তাড়াতাড়ি বাড়িয়ে দেয়। এমন সব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাবার, প্রক্রিয়াজাত পানীয় পুরোপুরি এড়িয়ে চলতে হবে। সাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। হোয়াইট পাস্তা, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি খাবার তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।
যে সব খাবার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ায় সেগুলো খাওয়া যাবে। যেমন- লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি, সবজি, ফল, গোটা শস্যদানা। স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খেলেও কোন সমস্যা নেই।
এছাড়া একবেলা ভরপেট না খেয়ে পরিমাণে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
ডায়াবেটিস হলে কি কি জটিলতা দেখা দিতে পারে?
ইনসুলিন ঠিক মতো নিঃসরণ না হওয়ার কারণে রক্তে চিনির পরিমাণ বেশি হলে রক্তনালীর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। আবার শরীরের সব জায়গায় রক্ত যদি ঠিকমতো প্রবাহিত না হতে পারে, তাহলে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডায়াবেটিসের কারণে অন্ধত্ব, কিডনি নষ্ট হওয়া, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ১৯৮০ সালে পুরো পৃথিবীতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ১১ কোটি। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪২ কোটিতে। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের প্রায় ৮০ শতাংশ মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশের।
– পূজা ধর
আরও পড়ুন- পিরিয়ড কি? পিরিয়ড কেন হয়? পিরিয়ড হলে করণীয়