যে বিশেষ নাম্বারের মাধ্যমে করদাতাকে শনাক্ত করা হয় সেটি টিআইএন বা ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (টিন) হিসেবে পরিচিত। অনেকের ধারণা, শুধুমাত্র ব্যবসায়িক প্রয়োজনে টিআইএন (টিন) দরকার হয়। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়৷ দৈনন্দিন আয় থেকে পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ- সর্ব ক্ষেত্রে টিআইএন একটি জরুরি কর সনদপত্র। টিআইএন (টিন) করদাতাকে করের সব ঝামেলা থেকে সুরক্ষা প্রদান করে থাকে।
টিআইএন কী কী কাজে লাগে?
১. আপনি যদি কোন ব্যবসা শুরু করতে চান তবে ট্রেড লাইসেন্স নিতে।
২. গাড়ির মালিকানা পেতে হলে টিন প্রয়োজন।
৩. সিটি করপোরেশনের অঞ্চলে থাকা কোনো জমি, ফ্ল্যাট বা ভবন রেজিস্ট্রেশন করতে টিআইএন (টিন) দরকার হয়৷
৪. ক্রেডিট কার্ড পেতে
৫. কোনো কোম্পানির শেয়ার কিনতে
৬. নিজের কোম্পানি নিবন্ধন করতে
৭. কোনো পণ্য আমদানির লাইসেন্স নিতে হলে
৮. মুক্ত পেশাজীবী যেমন হিসাবরক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলীদের পেশার চর্চা করতে
৯. নির্বাচনে প্রার্থী হতে
১০. ব্যবসায়িক সমিতি বা কোনো নিবন্ধিত সংগঠনের সদস্য হতে
১১. সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার দরপত্রে অংশ নিতে এবং রাইড শেয়ারিং কোম্পানিতে গাড়ি দিতে।
১২. আইএসডি টেলিফোন সংযোগের জন্য।
১৩. মুসলিম বিবাহ ও তালাকনামা রেজিষ্ট্রেশনের জন্য।
টিআইএন থাকার সুবিধা
১. টিআইএন থাকলে আপনি ট্যাক্স প্রদানকারী হিসেবে নিবন্ধিত হবেন।
২. টিআইএন রেজিস্ট্রেশন নাম্বার থাকলে ব্যাংক আপনার গচ্ছিত অর্থ থেকে ১০ শতাংশ কর কাটবে, যদি না থাকে তবে কাটা যাবে ১৫ শতাংশ। আপনি যদি কোনো উপহার বা পুরস্কারের অর্থ পেলেন, যা ব্যাংকের মাধ্যমে আপনাকে দেওয়া হলো, সে ক্ষেত্রেও টিআইএনধারীরা ১০ শতাংশ কর কেটে অর্থ হাতে পাবেন, আর যাঁদের টিআইএন নেই, তাঁদের কাটা হবে ১৫ শতাংশ।
৩. ব্যাংকঋণ নিতে চাইলে টিআইএন থাকতেই হবে।
কারা টিআইএন সার্টিফিকেট নেবেন?
১. জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী কোন ব্যক্তির আয় যদি মাসে ১৬ হাজার বা তার বেশি হয়ে থাকে তবে তার টিআইএন থাকা আবশ্যক।
২. এমনিতে পুরুষদের বছরে তিন লাখ, সব বয়সের নারী এবং ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে সব নাগরিক সাড়ে তিন লাখ এবং প্রতিবন্ধীদের বছরে সাড়ে চার লাখ টাকার ওপরে আয় না হলে কর দিতে হয় না।
৩. করসীমার নিচে থাকলে টিআইএন দেখিয়ে শূন্য বিবরণী জমা দিতে হয়।
৪. যদি কোন ব্যক্তির করযোগ্য আয় না থাকে কিন্তু তার গাড়ির মালিকানা বা কোনো সংগঠনের সদস্যপদ থাকে তবে তার অবশ্যই টিআইএন সার্টিফিকেট থাকতেই হবে।
টিআইএন কীভাবে করবেন?
১. সর্বপ্রথম জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটে যেতে হবে এবং সেখানে ফরম দেখতে পাবেন৷
২. এরপর মুঠোফোন নাম্বার, জাতীয় পরিচয়পত্র, সদ্য তোলা এক কপি ছবি দিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য পূরণ করলে ঘরে বসেই ই-টিআইএন নাম্বার পাওয়া যাবে।
৩. ধরুন, আপনি পূর্বে টিআইএন নাম্বার নিয়েছেন। সেপুরোনো নাম্বার দিয়ে আপনি টিআইএন পেতে পারেন ও সার্টিফিকেটটি সংরক্ষণ করতে পারেন৷
অনেকের ১২ ডিজিটের টিআইএন আছে কিন্তু করযোগ্য আয় নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কি আয়কর বিবরণী বা ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন কি জমা দিতেই হবে? উত্তর হচ্ছে অবশ্যই দিতে হবে। তবে নিয়মে একটু ব্যতিক্রম আছে।
তিন শ্রেণীতে টিআইএন থাকলেও যদি করযোগ্য আয় না থাকে, তাহলে কর রিটার্ন দেওয়ার দরকার নেই। যেমন অনেকে জমি বিক্রি করতে নিয়ম মেনে টিআইএন নিয়েছিলেন, কিংবা টিআইএন নিয়েছিলেন ক্রেডিট কার্ড করার জন্য। করযোগ্য আয় না থাকলে তাঁদের আর কর রিটার্ন দেওয়ার দরকার নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশে কোনো ‘ফিক্সড বেজ’ বা স্থায়ী ভিত্তি নেই, এমন অনাবাসীদেরও কর রিটার্ন দিতে হচ্ছে না। এর বাইরে যাঁদেরই করযোগ্য আয় আছে, তাঁদের রিটার্ন দিতেই হবে।
করযোগ্য আয় কত?
১. ব্যক্তির ক্ষেত্রে বছরে তিন লাখ টাকার বেশি আয়কে করযোগ্য আয় ধরা হয়।
২. নারী এবং ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের কারো আয় বছরে সাড়ে তিন লাখের বেশি হলে সেটি করযোগ্য আয়।
৩. গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার আয় বছরে ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকার বেশি হলে সেটি করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
যদি আরেকটু বিস্তারিতভাবে বলা যায় তবেঃ
১. প্রথম বার্ষিক তিন লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর কোনো কর দিতে হয় না।
২. তিন লাখের পরের আয়ের ১ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ কর দিতে হয়। ওই আয়ের ওপর ব্যক্তির আয়কর হবে বার্ষিক ৫ হাজার টাকা।
৩. পরবর্তী ৩ লাখ টাকা আয়ের ওপর কর বসে ১০ শতাংশ, ফলে ব্যক্তির করের পরিমাণ দাঁড়াবে আরও ৩০ হাজার টাকা।
৪. পরবর্তী ৪ লাখ টাকার ওপর কর ১৫ শতাংশ। তখন করদাতাকে আরও ৬০ হাজার টাকা কর দিতে হয়।
৫. পরবর্তী ৫ লাখ টাকার ওপর কর হয় ২০ শতাংশ, এতে ব্যক্তিকে দিতে হয় আরও ১ লাখ টাকা কর।
৬. অবশিষ্ট টাকার ওপর কর আরোপ হয় ২৫ শতাংশ হারে। ফলে যত বেশি আয় হবে, তত বেশি করে দিতে হবে।
যাঁদের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক
১.কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডারের কর্মচারী, কোনো ফার্মের অংশীদার হলে।
২. সরকার অথবা সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন বা ইউনিটের কর্মচারী হিসেবে ১৬ হাজার বা তার বেশি বেতন পেলে।
৩. কোনো ব্যবসায় বা পেশায় নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পদে কর্মরত থাকলে৷
৪. আয়কর অব্যাহতি পেলেও হ্রাসকৃত হারে করযোগ্য হলে।
৫. মোটরগাড়ির মালিক হলে (জিপ বা মাইক্রোবাসকেও বোঝাবে)।
৬. কোনো সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে কোনো ব্যবসা বা পেশা পরিচালনা করলে।
৭. মূল্য সংযোজন কর আইনের অধীন নিবন্ধিত কোনো ক্লাবের সদস্যপদ থাকলে।
৮. চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, প্রকৌশলী, স্থপতি অথবা সার্ভেয়ার হিসেবে বা সমজাতীয় পেশাজীবী হিসেবে কোনো স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার নিবন্ধিত হলে।
৯. আয়কর পেশাজীবী হিসেবে এনবিআরে নিবন্ধিত হলে।
১০. কোনো বণিক বা শিল্পবিষয়ক চেম্বার অথবা ব্যবসায়িক সংঘ বা সংস্থার সদস্য হলে
১১. কোনো পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের কোনো পদে বা সাংসদ পদে প্রার্থী হলে
১২. কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা কোনো স্থানীয় সরকারের কোনো টেন্ডারে অংশগ্রহণ করলে।
১৩. কোনো কোম্পানির বা কোনো গ্রুপ অব কোম্পানিজের পরিচালনা পর্ষদে থাকলে।
১৪. মোটরযান, স্পেস বা স্থান, বাসস্থান অথবা অন্যান্য সম্পদের মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত থাকেন (যেমন উবারে গাড়ি দেওয়া)
১৫. লাইসেন্সধারী অস্ত্রের মালিক হলে।
রিটার্ন দাখিলের সময় ও জরিমানা
২০২০-২১ কর বছরের রিটার্ন দাখিলের সর্বশেষ তারিখ ২০২০–এর ৩০ নভেম্বর। যদি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করা সম্ভব না হয় তবে সময়সীমা বাড়ানো যায়। তবে এক্ষেত্রে একটি আবেদন প্রক্রিয়া রয়েছে। এ জন্য নির্ধারিত ফরমে উপযুক্ত কারণ উল্লেখ করে উপ–কর কমিশনারের কাছে আবেদন করতে হয়। এনবিআরের ওয়েবসাইটে সময় বাড়ানোর আবেদন ফরম পাওয়া যায়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিল না করলে জরিমানা, ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত সরল সুদ এবং বিলম্ব সুদ আরোপ করবে এনবিআর। আর সময় বাড়ানোর অনুমোদন থাকলে কেবল জরিমানা দিতে হবে না, কিন্তু অতিরিক্ত সরল সুদ ও বিলম্ব সুদ দিতে হবে।
রিটার্ন কোথায় দাখিল করতে হয়?
প্রতিটি শ্রেণীর করদাতার রিটার্ন দাখিলের জন্য নির্দিষ্ট আয়কর সার্কেল রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা জেলায় অবস্থিত সব বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী ও পেনশনভুক্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীর নাম ‘এ’ ‘বি’ ‘সি’ অক্ষর দিয়ে শুরু হয়েছে, তাঁদের ডাকা কর অঞ্চল-৪–এর কর সার্কেল-৭১–এ রিটার্ন জমা দিতে হবে। পুরোনো করদাতারা বর্তমান সার্কেলে রিটার্ন জমা দেবেন। নতুন করদাতারা তাঁদের নাম, চাকরিস্থল বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানার ভিত্তিতে নির্ধারিত সার্কেলে টিআইএন উল্লেখ করে আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন।
রিটার্ন দাখিলের সময় কেউ যদি দেশের বাইরে অবস্থান করে তবে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসেও রিটার্ন দাখিল করতে পারবে৷ আবার কোনো সরকারি কর্মকর্তা প্রেষণে বা ছুটিতে উচ্চশিক্ষা বা প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে থাকলে বা লিয়েনে বাংলাদেশের বাইরে থাকলে, প্রেষণ বা লিয়েন শেষ করে দেশে আসার তিন মাসের মধ্যে সব রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।
আরও পড়ুন- পিরিয়ড কি? পিরিয়ড কেন হয়? পিরিয়ড হলে করণীয়