in

জোম্বি সিনেমার সেরা পাঁচ

জোম্বি সিনেমার সেরা পাঁচ
জোম্বি সিনেমার সেরা পাঁচ

বরাবর-আটপৌরে এক সকাল, প্রতিদিনের মতো আড়মোড়া ভেঙে পত্রিকার খোঁজে দরজা খুললেন। একি! কেউ যেন দুমড়ে মুচড়ে গেছে ওটা, হাতে তুলে নিতেই চটচটে লালচে তরলের ছোঁয়া মিললো। খানিকটা বিরক্তি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই টের পেলেন ‘কুছ তো গড়বড় হ্যায়!’ নইলে এই সাত সকালে এত সুনসান কেন পাড়া? শব্দের সরোবর যেই পাশের ফ্ল্যাট, ওখানের হল্লাও হঠাৎ গায়েব!

সাত পাঁচ ভাববার আগেই জানালায় আছড়ে পড়লো কিছু। চোখ রগড়ে নিতেই বুঝলেন, এতদিন কল্পগল্পে আর বিদেশি সিনেমায় যেই পিশাচের কাহিনি পড়ে হেসে লুটিয়েছেন, উনারাই বাইরে জনসমাবেশে ব্যস্ত। কোনমতে আপনাকে পেলেই হলো- দু-তিনজনের ব্রেকফাস্ট হয়ে যাবে আরামসে।

পাঠককে ভড়কে দেবার কোন অভিলাষই নেই লেখকের। স্রেফ গতানুগতিক জোম্বি-হরর ছবির প্রাথমিক প্লট বলছিলাম আর কি। যেই জোম্বি নিয়ে মার্কিন মুলুকে এত সিনেমা,গল্প আর গেমের আড়ম্বর তা কিন্তু মার্কিনীদের মৌলিক চিন্তার ফসল নয়। এই শব্দের উদ্ভব পশ্চিম আফ্রিকার ভুডু ধর্ম থেকে। ক্রমান্বয়ে হাইতিতে এই জিন্দা লাশের ধারণা পরিণতি পায় এবং তাদের সাহিত্য, আচার কর্ম থেকে ছড়িয়ে পড়ে উপনিবেশিক অন্যান্য দেশে।

সমসাময়িকতার সূত্র ধরেই সরেস পাঁচ জোম্বি সিনেমা নিয়ে জমাট আলোচনা হবে এই ফিচারে। চলুন তবে ভীতি আর রক্তস্নানের রাজ্যে ঢুঁ মেরে আসি।

জোম্বি সিনেমার সেরা পাঁচ

Army of the Dead (2021)

উদ্দাম জীবন, ক্যাসিনোর শহর হিসেবেই বছর পর বছর দাপুটে ইমেজ বজায় রেখেছে লাস ভেগাস। সেই শহরই যদি হয় জোম্বি আক্রমণের রাজধানী, কি ধুন্ধুমার কাণ্ডটাই না হবে!

জুয়া আর যৌনতার মহারণ্য লাস ভেগাসের অধিপতি বনে যাওয়া জোম্বিদের নিয়ে জাস্টিস লীগ খ্যাত জ্যাক স্নাইডারের রোমাঞ্চকর হরর-হাইস্ট ‘Army of the Dead’. ওপেনিং ক্রেডিটে প্রিসলির বিখ্যাত ‘Viva Las Vegas’এর সাথে জোম্বি উত্থান থেকে উৎখাতের চেষ্টা -সমস্ত আখ্যানটা মিনিট কয়ের মাঝেই বুঝে ফেলে দর্শক। তবে এতেই কিন্তু শেষ নয়।

জোম্বি আক্রমণের পর কেটে যায় ৬ বছর। ইতোমধ্যেই পারমাণবিক বোমায় গোটা শহর উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনাও করে ফেলে মার্কিন সরকার। এতেই যেন টনক নড়ে সাবেক ক্যাসিনো মালিক তানাকার।

সূত্রমতে, ২০০ মিলিয়ন ডলার লুকোনো আছে লাস ভেগাসের পাতাল ভল্টে। এ যেন আধুনিক গুপ্তধন! প্রাক্তন সৈনিক স্কট ওয়ার্ডের কাছে সেই অর্থ উদ্ধারের প্রস্তাব দেয় তানাকা। শর্তমতে ৫০ মিলিয়ন পাবে স্কট আর তার দল। কিন্তু এই অভিযান কি আদতেই এতটা সহজ? আঁটসাঁট পরিকল্পনা কি সত্যিই সফলতা পাবে? নাকি তাদের কপালেও আছে জোম্বিতে পরিণত হবার দুর্ভাগ্য?

উদ্বাস্তু সংকট, মহামারি সামলাবার ক্ষেত্রে মার্কিন সরকারের ব্যর্থতা, অস্ত্রনীতি ও পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য- বিভিন্ন সমস্যাকেই আলতো ভাবে দেখিয়েছেন স্নাইডার। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডেভ বাতিস্তা, টিগ নোটারো, ওমারি হার্ডউইক,মাটিয়াস শোয়াগহফার, আনা দেলা রেগেরা, থিও রসি ,হুমা কুরেশি প্রমুখ।

গত ১৪ মে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায় ৯০ মিলিয়ন ডলারে নির্মিত ছবিটি। হররের সাথে হাইস্টের দুর্দান্ত সমন্বয় ঘটিয়ে দর্শক বিনোদনে খোরাক জমালেও সমালোচক আর উঁচু নাকের বোদ্ধাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি এটি। তাই দুই ঘণ্টা আটাশ মিনিট ব্যাপি সিনেমাটির আইএমডিবি রেটিং মাত্র ৫.৮।

বিগ বাজেটের একশন-হরর Army of the Dead; Photo: Netflix 
বিগ বাজেটের একশন-হরর Army of the Dead; Photo: Netflix

Shaun of the Dead (2004)

হরর-কমেডির জনরায় অনন্য স্থানের দখলদার এডগার রাইটের Shaun of the Dead. লন্ডনের মত এলেমদার শহরে জোম্বি আগ্রাসন আর দুই বন্ধু শন-এডের কীর্তি নিয়েই ৯৯ মিনিটের স্যাটায়ার-হরর এটি।

ব্রিটিশ সিটকম Spaced এর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে, এরই এক পর্ব থেকে Shaun of the Dead এর আইডিয়া মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে রাইটের। ব্রিটিশ এই পরিচালকের কাজের সাথে যারা পরিচিত তারা খুব সহজেই তাঁর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ধরে ফেলতে পারবেন। পপ রেফারেন্স, দুদ্দাড় গতির ক্যামেরা শট আর সম্পাদনার অনন্য ধারার জন্য রাইট বিখ্যাত।

এতেও ব্যত্যয় ঘটেনি। বরং স্যাটায়ারের সঞ্জীবনী শক্তি যেন ফুলে ফেঁপে উঠেছে হররের মিশ্রণে। জর্জ রমেরোর ডেড ট্রিলজির ভক্ত রাইট আর সাইমন পেগ। তাই ওখান থেকেই টুকে নিয়েছেন অনুপ্রেরণা। যার ফলাফল ভাবনার আট হপ্তার মাথায়ই দাঁড়িয়ে যায় পরিপূর্ণ চিত্রনাট্য।

ছয় মিলিয়ন ব্যয়ে নির্মিত ছবিটির মোট বক্স অফিস আয় ৩০ মিলিয়ন ডলার। এতে প্রধান চরিত্রগুলোয় রূপদান করেছেন সাইমন পেগ, নিক ফ্রস্ট, পেনেলোপ উইল্টন, কেট অ্যাশফিল্ড, লুসি ডেভিস প্রমুখ। আইএমডিবির খাতায় এর নম্বর ৭.৮।

স্টিফেন কিংয়ের চোখেও কাল্ট-ক্লাসিক দুর্দান্ত এই কমেডি-হরর; Photo:IMDb 
স্টিফেন কিংয়ের চোখেও কাল্ট-ক্লাসিক দুর্দান্ত এই কমেডি-হরর; Photo:IMDb

Train to Busan (2016)

দক্ষিণ কোরিয়ান হররের নামডাক ছিল আগে থেকেই। সেই মুকুটে বাড়তি পালক জুড়ে দিলো ইওন সাং-হোর Train to Busan. পরিপাটি চিত্রনাট্য আর ষোল আনা নাটকীয়তার কল্যাণে রাতারাতি ব্লকবাস্টারের তকমা পায় গং-উ, জুং ইউ-মি,মা দং-সক, ইউ সাং-কিম অভিনীত ছবিটি।

কাহিনীর আবর্তন ঘটে কর্পোরেট সিওক-উ আর ক্ষুদে কন্যা সু-আনকে ঘিরে। বাবা-মার বিচ্ছেদের কালো ধোঁয়া আচ্ছন্ন করে রেখেছে সু-আনকেও। সে কারণেই হয়তো অমোঘ দূরবর্তী এই পিতা-কন্যা। এক পাহাড় অভিমান বুকে নিয়েই শুরু হয় তাদের বুসান যাত্রা।

সেই দূরত্ব ঘুচে যায় মানুষখেকোর আকস্মিক হামলায়। সাথে মিলে যায় একদল সাহসি যাত্রীর দল।  তবে গৎবাঁধা হররের বৃত্তের বাইরে মানবিক দৃষ্টিকোণটাই প্রকট এতে। ক্রান্তিকালে শুধু জীবন বাঁচানোই পরম ধর্ম ছিল না সেই বুসান যাত্রীদের। বরং পরস্পরকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার আকুতিই সামনে এসেছে বারবার।

ছবি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৯ মিলিয়ন ডলার, যার ফলশ্রুতিতে বক্স অফিসে এর আয় দাঁড়ায় ৯৯ মিলিয়নে। ১১৮ মিনিটের রোমাঞ্চকর হররটির আইএমডিবি রেটিং ৭.৬।

গং-উর তারকা খ্যাতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে Train to Busan; Photo: IMDb 
গং-উর তারকা খ্যাতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে Train to Busan; Photo: IMDb

One cut of the dead (2017)

পরিচালক হিসেবে খুব একটা নাম করে উঠতে পারেনি মধ্যবয়সী হিগুরাশি। তবে ধ্যানজ্ঞান যখন সিনেমা তখন এত সহজে হাল ছাড়বার পাত্রও সে নয়। তার উপর আছে ঋণ শোধের বড্ড তাড়া। তাই বড় পর্দা না হোক ছোট পর্দার প্রয়োজনেই ক্যামেরা হাতে নেমে পড়লেন শ্যুটিংয়ে। বিষয়বস্তু? সেই ফর্মুলা মেনে জোম্বি আগ্রাসন।

শ্যুটিং স্পট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত কুখ্যাত এক পরিত্যক্ত জল পরিশোধনাগার। চিত্রনাট্য মেনে সবটাই এগুচ্ছিল ঠিকঠাক। তবে মিনিট খানেকের মাঝেই বদলে যায় হিসেব নিকেশ। উত্থান ঘটে আসল প্রেতের।

একদিকে জোম্বি আক্রমণে দিশেহারা কর্মীরা, অন্যদিকে হিগুরাশির অদম্য পরিচালক সত্তা। অবশেষে প্রকৃত জোম্বিদেরই ক্যামেরাবন্দিতে মেতে ওঠে আধোন্মাদ পরিচালক।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ছবির প্রথম ৩৭ মিনিট আদতেই এক টেকে শ্যুট করা। অবশ্য এর পেছনে ছিল মাস দুয়েকের কঠোর ট্রেনিং। পরিচালক শিনচিরো উয়েদার এই স্যাটায়ার রচনার মূল অনুপ্রেরণা ছিল জাপানি নাট্যকার রিওচি ওয়াদার Ghost in the box। একেবারে আনকোরা অভিনেতাদের সঙ্গী করেই স্বল্প বাজেটের ছবিটির চিত্রায়ন সম্পন্ন হয় মাত্র আটদিনে।

২৫ হাজার ডলারে নির্মাণের বিপরীতে এর বিশ্বব্যাপী আয় ৩২ মিলিয়ন ডলার। গল্প বলার মৌলিক ভঙ্গি, সরস আবহের সাথে ভীতির নিখুঁত সংমিশ্রণ, বাস্তবমুখী চিত্রায়নে দূরদর্শিতাই জাপানের বাইরেও এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভের কারণ।সেই সূত্রেই ফরাসি ভাষায় পুনঃনির্মিত হচ্ছে এটি।

বাদবাকিদের থেকে অনেকটাই আলাদা আইএমডিবি রেটিংয়ে ৭.৭ আদায় করা One Cut of the Dead. কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দেখতে হবে এক ঘণ্টা ৩৬ মিনিটের কমেডি-হরর জনরার ছবিটি।

বিশুদ্ধ আনন্দের স্বাদ দেবে One Cut of The Dead; Photo: IMDb 
বিশুদ্ধ আনন্দের স্বাদ দেবে One Cut of The Dead; Photo: IMDb

28 Weeks Later (2007)

কিস্তির প্রথম ছবির পরিচালক যখন ড্যানি বয়েল, তখন হুয়ান কার্লোস ফ্রেসনাদিলোর ঘাড়ে প্রত্যাশার চাপটাও ছিল ভারি। তবে সেই প্রত্যাশায় জল ঢালেননি এই স্প্যানিয়ার্ড।

রেইজ ভাইরাস সংক্রমণের পর কেটে গেছে আরও আটাশ সপ্তাহ। ন্যাটো বাহিনির হাতে ধরাশায়ী অধিকাংশ আনডেড। লন্ডনে ফিরতে শুরু করেছে বাস্তুহারার দল। সামরিক নিরাপত্তা আর সীমিত সুবিধার সাহায্যে ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারে ব্যস্ত বিজ্ঞানীরা। কিছুটা স্থবির যখন অবস্থা তখনই ডিসট্রিক্ট ওয়ানে ফের ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাস।

প্রশাসনের কর্তব্যে অবহেলা নাকি এক পরিবারের অযাচিত আবেগের ফলশ্রুতি এই নয়া মহামারি?

১৫ মিলিয়ন ডলার বাজেটের পোস্ট- এপোক্যালিপ্টিক ছবিটি আয় করে ৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রশাসনিক ও নিয়োজিত সেনাদের দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকটাই পরিণত ফ্রেসনাদিলোর এই সাই-ফাই হরর। তবে পূর্বতনের মানবিক আবেদন এখানে অনেকটাই অনুপস্থিত বলে মনে করেন দর্শক-সমালোচক। ইমোজেন পুটস, জেরেমি রেনার, ইদ্রিস এলবা, রবার্ট কার্লাইল ও রোজ বায়ার্ন অভিনীত ছবিটির আইএমডিবি রেটিং ৭।

জোম্বি ভূমিকায় অভিনেতাদের সকলেই ছিলেন নাচ অথবা জিমন্যাস্টিকে পারদর্শী; Photo: IMDb 
জোম্বি ভূমিকায় অভিনেতাদের সকলেই ছিলেন নাচ অথবা জিমন্যাস্টিকে পারদর্শী; Photo: IMDb

ভাইরাস বা অতিপ্রাকৃত কোন শক্তির প্রভাবে মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি লোপ এবং মাংসলোলুপ জিন্দালাশে পরিণত হওয়াকেই সিনেমাটিক ভাষায় জোম্বি বলা হয়। ডিস্টোপিয়ান ভবিষ্যতের আশঙ্কা, অতিমারির গ্রাস এই ধারণায় ঘি ঢালে দ্বিগুণ। ত্রিশের দশকে ভিক্টর হালপেরিনের ‘White Zombie’ (১৯৩২) দিয়ে এই ধারার যাত্রা। ইতিহাসে এই ধারাকে প্রবীণের কাতারে ফেললেও দর্শকের কাছে কিন্তু এর আবেদন প্রতি দশকেই অর্বাচীন।

জোম্বি জনরার সিনেমায় ঘুরেফিরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির কারণে একে ফর্মুলার কাতারেই ফেলা যায়।তবুও এই জনরার প্রতি দর্শকের উদ্দীপনা আর আগ্রহ মনে করিয়ে দেয় ,কাজী মোতাহার হোসেনের ‘জানা কথাও অনেক সময় জানবার কথা।‘ বাক্যটি অকাট সত্য।

লিখেছেন- সারাহ তামান্না 

আরও পড়ুন- ইরানি সিনেমায় সেরা পাঁচ

আরও পড়ুন- সেরা পাঁচ স্প্যানিশ মুভি