in

রচনাঃ ছাত্রজীবন

ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য

ছাত্রজীবন রচনা 
ছাত্রজীবন রচনা 

ছাত্রজীবন রচনা

ভূমিকাঃ ছাত্রজীবন হলো মূলত সেই সময়, যে সময়ে মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে। সারা জীবনই মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে। কিন্তু একটা নিদির্ষ্ট সময় পর্যন্ত মানুষ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সময়টুকু কাটায় সেটাই হলো ছাত্রজীবন। ছাত্রজীবন মানুষের জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। ছাত্র জীবনই হলো একজন মানুষের নিজের জীবনকে গড়ে তোলার উপযুক্ত সময়। জীবনে চলার পথের পাথেয় মানুষ ছাত্রজীবনে সঞ্চয় করে। ছাত্রজীবনের উপর নির্ভর করে একজন মানুষের ভবিষ্যতের সফলতা ব্যর্থতা।

প্রধান কর্তব্যঃ সংস্কৃত ভাষায় একটা প্রবাদ আছে – ‘ছাত্রনং অধ্যায়নং তপঃ।’ এর অর্থ হল অধ্যয়ন বা পড়াশোনা করাই হচ্ছে ছাত্র জীবনের প্রধান কর্তব্য। এ সময়টাতে অধ্যয়নের পাশাপাশি আরো অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। পিতা মাতা ও শিক্ষকদের সম্মান করা, সহপাঠীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, ছোট বড় সবার সাথে  ভালো আচরণ করা। একজন মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে তার অভ্যাসগুলো। তাই ছাত্রজীবনেই ভালো ভালো অভ্যাস চর্চা করাও একজন ছাত্রের কর্তব্যের মধ্যে পরে। যেমন- একজন ছাত্রের কোনভাবেই উচিৎ নয় সারা রাত ফেসবুকিং করে পরের দিন ক্লাসে যাওয়া।

চরিত্র গঠনঃ ছাত্রজীবনেই একজন মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত তৈরি হয়। এজন্য একজন মানুষকে ছাত্রজীবনেই চরিত্র গঠন করতে হয়। কারণ চরিত্রহীন মানুষ পশুর নামান্তর। একজন মানুষ শিক্ষিত  হলেও যদি তার চরিত্র ঠিক না হয়, তবে তার দ্বারা মানুষের উপকারের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশি। তাই ছাত্র জীবনে জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি একজন ছাত্রকে উত্তম চরিত্র গঠনেও মনযোগী হওয়া দরকার। সব ধরনের কু-রিপু যেমন অন্যায়, মিথ্যা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, অন্যের ক্ষতি করা ইত্যাদি হতে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।ছাত্রজীবনেই উচিৎ সৎ চরিত্র তথা সততা, সত্যবাদিতা, আত্মসংযম, দেশপ্রেম, মহানুভবতা, পরোপকারী হওয়া প্রভৃতি গুণাবলি আয়ত্ত করে নিজেকে দেশের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।

সুস্বাস্থ্যঃ স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে মনও প্রফুল্ল থাকবে না। এতে করে পড়াশোনায় মনযোগী হওয়া সম্ভব হয় না। তাই ছাত্রজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া একজন ছাত্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভোরে ঘুম থেকে উঠা, শরীরচর্চা করা, নানা রকম খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করা, সঠিক সময়ে আহার গ্রহণ করা, রাত না জাগা ইত্যাদি বিষয়ে একজন ছাত্রের মনযোগী হওয়া দরকার। স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করা যায়, এতে করে পরীক্ষায় ভালো ফলও পাওয়া যায়।

পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী হওয়াঃ ছাত্রজীবনে সফল হতে হলে একজন ছাত্রকে অবশ্যই পরিশ্রমী আর অধ্যাবসায়ী হতে হবে। কবি বলেছেন, ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’। একজন ছাত্রকে সব সময়
মনে রাখতে হবে,পরিশ্রম ছাড়া কখনো জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব না। পরিশ্রম আর কঠোর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে একজন ছাত্র সাফল্যের দেখা পায়। পৃথিবীতে যারা তাঁদের কর্মের জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন, তাঁরা কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের কারণেই নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পেরেছেন। কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে একজন সাধারণ ছাত্রও তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। তাই ছাত্রজীবনে সময় অপচয় না করে একজন ছাত্রের উচিত কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা, নিজেকে সফলতার পথে এগিয়ে নেওয়া।

ছাত্রজীবনে শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধঃ মানবজীবনের অন্যতম একটা গুণ হল সৌজন্যতা ও শিষ্টাচার।সৌজন্যতা আর শিষ্টাচারের ছোঁয়াতেই একজন ছাত্র হয়ে উঠে নম্র, ভদ্র, অমায়িক। ছাত্রজীবনে বিদ্যা লাভের পাশাপাশি সৌজন্যবোধ আর শিষ্টাচারের শিক্ষা গ্রহণ করাটাও জরুরি। ছাত্রজীবনে যে ছাত্র শিক্ষকদের, গুরুজনদের সম্মান করতে শিখলো না, তার পরবর্তী জীবনেও সে কখনো কাউকে সম্মান করতে পারবে না।ঔদ্ধত্য আচরণ কখনো একজন মানুষকে বিনয়ী হতে শেখায় না। যে মানুষ ছাত্রজীবনে শিষ্টাচার শেখে না তার ভবিষ্যৎ কখনো সুন্দর হয় না। মানুষ বিনয়ী হলে, তার আচার আচরণে সৌজন্যবোধের প্রকাশ পেলে তাকে সবাই সম্মান করা, তার সাফল্যের পথে কোন কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

ছাত্রজীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ ছাত্রজীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নিজেকে একজন সৎ ও আর্দশ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাশ করা আর সার্টিফিকেট অর্জন করার জন্য পড়াশোনা করলে সে শিক্ষা দিয়ে জীবনে বেশি দূর আগানো যায় না। পাঠ্য পুস্তকের পাশাপাশি একজন ছাত্রকে সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী ও বিনয়ী হওয়ার শিক্ষালাভ করা জরুরি।কারণ কর্মজীবনে একজন মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে এসব গুণাবলী তাকে সফল হতে সাহায্য করে।ছাত্রজীবনের শিক্ষাই ব্যক্তিজীবনে প্রভাব ফেলে।

ছাত্রজীবনে সামাজিক নেতৃত্বঃ ছাত্রসমাজ সমাজের যে কোন কাজে নেতৃত্ব দিতে পারে। কারণ আজকের  ছাত্রসমাজ আগামী দিনে দেশের নেতৃত্ব দান করবে। সমাজের উন্নয়ন করতে হলে ছাত্রসমাজকে সচেতন হতে হবে। সমাজের নানান কুসংস্কার, অন্যায়, অবিচার এগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ছাত্ররা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ছুটে যায়, এতে করে ছাত্ররা  সহযোগিতা করা শেখে। রক্তদানের মধ্য দিয়ে তারা রোগীর বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারে। ছাত্ররা চাইলে আশে পাশের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের বিনা পয়সায় পড়াশোনা শেখাতে পারে। এতে করে অশিক্ষার হাত থেকে অনেকে রক্ষা পায়। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে ছাত্র সমাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ছাত্রজীবনে বন্ধু নির্বাচনঃ ছাত্রজীবনে বন্ধু নির্বাচন অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। ছাত্রজীবনে যারা সঠিক বন্ধু নির্বাচন করতে পারে না তারা পরবর্তীতে নানা রকম অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ে। পড়াশোনায় আগ্রহী, নম্র, ভদ্র, কোনো রকম খারাপ অভ্যাস নেই- সব ছাত্রেরই এমন বন্ধু নির্বাচন করা জরুরি। এতে করে বন্ধুদের সাথে পড়াশোনা নিয়ে, কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়। এমন বন্ধুদের কাছে বিপদে আপদে সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায়। অন্যদিকে খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশলে তাদের সাথে এক হয়ে ক্লাস না করা, পড়াশোনা না করে অন্য কাজে অহেতুক সময় নষ্ট করা, আরো নানা রকম খারাপ কাজে না চাইলেও জড়িয়ে পড়তে হয়। তাই ছাত্রজীবনে বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক হওয়া জরুরি। কথায় আছে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসত সঙ্গে সর্বনাশ।

ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা শেখাঃ ছাত্রজীবনই শৃঙ্খলা আর নিয়মানুবর্তিতা শেখার উপযুক্ত সময়। এসময় সজীব কোমল মনে শৃঙ্খলা আর নিয়মানুবর্তিতার বীজ বপন করলে পরে এর সুফল পাওয়া যায় ঠিকই। ছাত্রজীবনের প্রথম আর প্রধান কাজ অধ্যয়ন। ছাত্রদের কখনোই আজকের পড়া কালকের জন্য ফেলে রাখা উচিত নয়। সময়ের কাজ সঠিক সময়ে শেষ করা না হলে পরবর্তীতে কাজের বোঝা বেড়ে যায়, তাই ছাত্রদের সময়মতো পড়াশোনা করা, নিজের প্রাত্যহিক কাজগুলো যথাসময়ে শেষ করার চেষ্টা করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা মেনে চলা শিখলে ছাত্ররা কখনোই উশৃংখল হবে না। শৃঙ্খলা না থাকলে সে জীবনে কখনোই সফলতা আসে না এটা ছাত্রদের মনে রাখতে হবে।

এই পৃথিবীতে যারা নিজের গুণে সফল হয়েছে তারা সবাই ব্যক্তিগত জীবনে ছিল শৃঙ্খল। যেই ব্যক্তি খুবই শৃঙ্খলার সাথে জীবন যাপন করবে এবং সময়কে যথাযথ মূল্য দেবে এই জীবনে কোন কিছুই তার সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

স্বদেশপ্রেমঃ স্বদেশপ্রেম মানুষের একটি সহজাত গুণ। ছাত্রছাত্রীদের উচিত  নিজের দেশকে ভালোবেসে, দেশের যেকোন প্রয়োজনে নিজের দায়িত্ব পালনে একাগ্র হওয়া। ছাত্ররা হচ্ছে বয়সে তরুণ, তারা নির্মোহ স্বচ্ছ প্রাণের অধিকারী। দেশের কল্যাণে ছাত্ররা যে কোন প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে সক্ষম। কারণ ছাত্ররা হচ্ছে দেশের কর্নধার। দেশের স্বার্থে কোনো অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেওয়া ছাত্রদের গুরু দায়িত্ব। দেশের প্রচলিত আইন কানুনের প্রতিও ছাত্রদের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত।

বর্তমানে ছাত্রসমাজের উশৃংখলতার কারণঃ বর্তমান সময়ে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রসমাজের উশৃংখলতা বেড়ে চলছে। যার প্রেক্ষিতে সকল ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকরা বেশ উদ্বিগ্ন। এই উদ্বেগ অমূলক নয়। উশৃংখল ছাত্ররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারি করে এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ তৈরি করে, যেটা মোটেও কাম্য নয়। শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় এসব উশৃংখল ছাত্ররা সমাজিক পরিবেশও বিনষ্ট করছে। এসব ছাত্ররা নানা অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে নিজেরও ক্ষতি করে, সাথে দেশেরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

উপসংহারঃ ছাত্রজীবন মানব জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। এসময়টা ছাত্রদের পড়াশোনা করা, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব কর্তব্য পালনের শিক্ষা গ্রহণ করা, সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণ হওয়া, শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ শেখা ইত্যাদি কার্যকলাপে নিজেকে গড়ে তোলার উপযুক্ত সময়। এ সময়টা কাজে লাগাতে পারলে জীবনে সফল হওয়া সম্ভব। ছাত্রজীবনের মধুর সময়টাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে ভবিষ্যৎ জীবন অন্ধকারে পর্যবসিত হয়। একজন ব্যক্তির ভবিষ্যৎ সুন্দর হওয়ার পেছনে ছাত্রজীবনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ছাত্ররা যাতে ভালো কিছু শেখে, হতাশায় হারিয়ে না যায়, অন্যায় কাজে জড়িয়ে না পড়ে তার জন্য পরিবার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের উচিত ছাত্রদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা দান করা।

আরও পড়ুন- অন্যান্য রচনা।