in

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান / চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান / চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান রচনাটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রচনা সবাই নিজের মতো করেই লিখে। তবে রচনায় ভালো মার্কস পেতে হলে পয়েন্ট ও উক্তি ঠিক রাখতে হয়।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান / চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান

ভূমিকা:

“বিজ্ঞান হচ্ছে মনের পরিশ্রমের কারুকাজ” – ফ্রান্সিস বেকনের এই উক্তির সাথে আপনার দ্বিমত থাকতেই পারে, কিন্তু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে বর্তমানের আধুনিক মানবসভ্যতা বিজ্ঞানের আশীর্বাদস্বরূপ। বিজ্ঞান আমাদের জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে৷ আর বিজ্ঞানের যে শাখাটি ছাড়া মানুষ বর্তমানে তার অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারেনা সেটি হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞান।

প্রাচীনকালের রাজা বাদশাদের গল্প নিশ্চয় শুনেছেন, অঢেল সম্পদ থাকার পরেও সামান্য জ্বরে তাদের প্রাণ হারাতে হতো। বর্তমানে, রাজা বাদশারা যেমন শুধুমাত্র গল্পের বইতে বন্দী তেমনি অসুস্থ হওয়া মানেই যে প্রাণনাশ সে ধারণাও অনেকাংশে বদলে গিয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদানের কল্যাণে।

প্রাচীনকাল চিকিৎসা ব্যবস্থা:

প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক ভীষণ নিবিড়। আর প্রাচীনকালে মানুষ চিকিৎসার জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রকৃতিতে অফুরন্ত উপকারী ভেষজ উপাদান রয়েছে৷ কিন্তু এসব উপাদানকে সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ তখনকার দিনে অসম্ভব ছিল। কারণ তখন বিজ্ঞান ছিল না। ফলে দেখা যেত ডায়রিয়া কলেরার মত যেসব রোগ নিয়ে বর্তমানে কারো বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই, তখনকার দিনে এসব রোগে গ্রামের পর গ্রামের মানুষ প্রাণ হারাতো। কারো এসব রোগের লক্ষণ দেখা দিলে তাকে একঘরে করে রাখা হতো। যদি লতাপাতায় কাজ না হতো তবে তাদের শেষ ভরসা ছিল পানি পোড়া, তাবিজ, ঝাড়ফুঁক, পীর, ফকির, ওঝা৷ এডাম স্মিথ বলেছিলেন,

“উদ্দীপনা এবং কুসংস্কারের বিষের দুর্দান্ত প্রতিষেধক হলো বিজ্ঞান।”

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সূচনা:

সর্বপ্রথম ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে বিজ্ঞান পৃথিবীকে বুঝিয়ে দেয় যে সময় এসেছে পুরনো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার৷ বিজ্ঞান ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ করতে থাকে মানব সভ্যতাকে৷ চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়নি মানুষ৷ নতুন নতুন ঔষুধ, আধুনিক যন্ত্রপাতি, শরীরে নকল অঙ্গ প্রতিস্থাপন, রেডিয়াম, লেজার রশ্মি, অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে ক্যান্সারের মত দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা, পিত্তথলি- মূত্রতলির পাথর নিরসন, ছানিপড়া চোখের অপারেশন করা- এই সবই সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের গবেষণার ফলে৷

বয়স বাড়লে অনেকের কানে শুনতে সমস্যা৷ চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান তার গবেষণার মাধ্যমে এমন কিছু যন্ত্রপাতির আবিষ্কার করেছে যা ব্যবহারের মাধ্যমে যে কেউ এমন সমস্যা থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে৷ এমনকি বর্তমানে কেউ জন্মানোর আগে তার কোন শারীরিক সমস্যা আছে কিনা সেটিও নির্ণয় করে তার চিকিৎসা শুরু করা যাচ্ছে। এর এসবই বিজ্ঞানের বহুবছরের গবেষণার ফলে সম্ভব হয়েছে।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের নব নব উদ্ভাবন:

বর্তমানে দৈনন্দিন জীবন হোক বা চিকিৎসা, সব ক্ষেত্রেই আমরা পুরোপুরি বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। তবে, আজকের এই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বিজ্ঞানের বহু দিনের গবেষণার ফলাফল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রণালী ও যন্ত্রপাতি এক এক সময় আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন:

আবিষ্কারের সাল      চিকিৎসা পদ্ধতি / যন্ত্রপাতি

১৯০৩                       ইসিজি মেশিন, জিনের গঠন প্রণালী, ক্যান্সারের রেডিওথেরাপি

১৯২৮                       পেনিসিলিন

১৯৪৩                        ফিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন

১৯৭৮                        টেস্ট টিউব প্রজনন পদ্ধতি

তাছাড়া, এক্সরে আলট্রানোগ্রাফি বা রজন রশ্মি আবিষ্কার করেন অধ্যাপক রঞ্জন৷ অধ্যাপক কুরি ও মাদাম কুরি কর্তৃক আবিষ্কৃত হয় রেডিয়াম।

আরও পড়ুন– দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান / প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান প্রযুক্তি

রোগ প্রতিরোধে বিজ্ঞানের ভূমিকা:

ইমারসন বলেছেন-

“অজানাকে জানার জন্য মানুষের কৌতুহল এবং এই কৌতুহল থেকেই বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু।”

প্রাচীনকালের মানুষরা কিভাবে নিজেদের রোগ-বালাই থেকে সুস্থ রাখবে সে জ্ঞান তাদের ছিলনা বলেই ঘরে ঘরে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটতো। কেন এত মৃত্যু, কেনই বা এত সহজে মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে – এই প্রশ্নের উত্তর জানার কৌতুহল থেকে ধীরে ধীরে মানব দেহ নিয়ে বিজ্ঞানের গবেষণা বাড়তে থাকে।

গবেষণার ফলশ্রুতিতে আজ আমরা কিভাবে নিজেদের বিভিন্ন জীবাণু থেকে মুক্ত রাখবো সে সম্পর্কে অবহিত আছি। ডায়েরিয়া, কলেরার মত রোগেও একসময় বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিজ্ঞান আমাদের বোঝালো মল-মূত্র ত্যাগের পর হাত ধোঁয়া আমাদের এই ধরনের রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখে। যক্ষা, ধনুসটংকার, চিকেরন পক্স এর মত রোগ থেকে যেন আমরা সুরক্ষিত থাকি তাই বিজ্ঞান গবেষণার মাধ্যমে টিকা আবিষ্কার করেছে৷ সুতরাং রোগ প্রতিরোধে বিজ্ঞানের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

জটিল রোগের চিকিৎসায় বিজ্ঞান:

কুরি দম্পতি বহু বছর আগে রেডিয়াম ক্যান্সারেরর মতো জটিল রোগ আবিষ্কার করেছিল৷ রেডিয়াম ক্যান্সারকে তখন বলা হতো “no answer” অর্থাৎ, কেউ ক্যান্সার আক্রান্ত হলে ধরেই নেওয়া হতো যে তার মৃত্যু সন্নিকটে। তবে, বিজ্ঞানের কল্যাণে বর্তমানে ক্যান্সারের মত জটিল রোগের চিকিৎসাও সম্ভব হয়েছে। এক সময় কি কেউ ভেবেছিল যে একজন অঙ্গহীন মানুষের শরীরে নকল অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যাবে! চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান এই অসম্ভকেও সম্ভব করে দেখিয়েছে।

রোগ নিরাময়ে বিজ্ঞানের ভূমিকা:

একসময় মানুষ শুধু এটুকু বুঝতো তাদের শরীরে রোগ বাসা বেঁধেছে, কিছুদিন বাদে তাদের সব মায়া কাটিয়ে পৃথিবী ছেড়ে পরলোকে পাড়ি জমাতে হবে। ধীরে ধীরে বিজ্ঞান রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি আবিস্কার করলো, তারপর কিভাবে বিভিন্ন রোগ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা যায় সে সম্পর্কে মানবসভ্যতাকে জানানো। তারপর প্রকৃতিতে বিদ্যমান ভেষজ উপাদানগুলো ঔষুধ হিসেবে ব্যবহার পদ্ধতি ছিল চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রথম সাফল্য। তারপর ধীরে ধীরে প্রতিটি রোগের জন্য আলাদা আলাদা ঔষুধ আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞান। মানুষের শরীরে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড সংযোজন এই অবধি বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সাফল্য:

কোন দূর্ঘটনায় মুখ বা শরীরের কোন অংশ পুড়ে যাওয়া মানুষগুলো জানে তাদের জীবনটা ঠিক কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠে। তবে বর্তমানে কসমেটিক সার্জারির মাধ্যমে বিকৃত চেহারাকে অনেকটাই আগের রূপে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আর এটি সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে। বর্তমানে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বদৌলতে ঠোঁট কাটা, নাক কাটা, ভোঁতা নাক সূচালো, আঁকাবাঁকা নাক সোজা করা সম্ভব হচ্ছে। সিজারিয়ান পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে অনেক প্রসূতি মা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ব্যর্থতা:

বিজ্ঞান অনেক মুমূর্ষু রোগীকে জটিল রোগ থেকে মুক্ত করে তাদের নতুন জীবন উপহার দিয়েছে। কিন্তু, এইডস ও ব্লাড ক্যান্সার – এই দুটো রোগের ঔষুধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান আজো সফলতার মুখ দেখতে ব্যর্থ৷ তবে এইডস কেন হয়, কিভাবে এই রোগ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা যায় সে সম্পর্কে বিজ্ঞান সর্বদা আমাদের অভিহিত করে৷

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বর্তমান চ্যালেঞ্জ:

উহান শহর থেকে যে মহামারী “করোনা ” ভাইরাসের সূত্রপাত ঘটেছিল সে ভাইরাসের তান্ডবে এখন পুরো বিশ্ব নাজেহাল। বিজ্ঞানীরা এটাও বলতে পারছেনা এই ভাইরাসের যাত্রা কবে শেষ হবে। অনেক বিজ্ঞানীরা বলছে এই ভাইরাসকে সাথে আমাদের চলতে হবে৷ ইতোমধ্যে, অনেক দেশ এই ভাইরাস থেকে যাতে সুরক্ষিত থাকা যায় তার জন্য টিকা আবিষ্কার করেছে৷ এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই ধরনের হঠাৎ সৃষ্ট ভাইরাস থেকে মানবসভ্যতাকে সুরক্ষিত রাখা।

উপসংহার:

বিজ্ঞান মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেকখানি উন্নত করেছে। দৃষ্টিহীনকে দান করেছে দৃষ্টি, আবার অঙ্গহীনকে উপহার দিয়েছে অঙ্গ। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের গবেষণার ফলে অনেক প্রসূতি মা, অনেক নবজাতক রক্ষা পেয়েছে মৃত্যু থেকে। পরিশেষে আইজাক আসিমভের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই,

“বিজ্ঞান আমাদেরকে বিভ্রান্তির পথ থেকে সরিয়ে সঠিক পথ দেখিয়ে দেয় এবং প্রকৃত জায়গায় পৌঁছে দেয়।”