আমাদের এই লেখাটি মূলত গ্রীন হাউজ ইফেক্ট কি, গ্রীন হাউজ ইফেক্টের কারণ ও পরিবেশের উপর গ্রীন হাউজ ইফেক্টের প্রভাব নিয়ে। তবে গ্রীন হাউজ ইফেক্ট কি তা জানার আগে গ্রীন হাউজ কি তা জেনে নেয়া প্রয়োজন।
গ্রীন হাউজ কি?
শীতপ্রধান দেশগুলোর তাপমাত্রা বেশির ভাগ সময়েই শাক-সবজি উৎপাদনের অনুকূলে থাকে না৷ তাই এসব শীতপ্রধান দেশে বিশেষ ধরনের কাঁচের তৈরি ঘরে কৃত্রিম উষ্ণ পরিবেশে শাকসবজি ও বিভিন্ন ফুল-ফলের চাষাবাদ করা হয়ে থাকে। এই কাঁচের তৈরি ঘরগুলোই গ্রীন হাউজ নামে পরিচিত।
গ্রীন হাউজে সূর্যরশ্মির তাপ কাঁচ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু সহজে তা বেরোতে পারেনা৷ ফলে, ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং শাক-সবজি বা গাছপালা জন্মানোর জন্য ঘরটির পরিবেশ উপযুক্ত হয়ে উঠে ।
গ্রীন হাউস ইফেক্ট কি?
আমাদের পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ভেদ করে সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছায়। এই আলো কিন্তু পৃথিবীর বাতাসকে উত্তপ্ত করতে পারে না, এটি উত্তপ্ত করে পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশকে। পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ দৃশ্যমান আলো শোষণ করে, কিন্তু এটি বিকিরণ করে ইনফ্রায়েড আলো। আমাদের বায়ুমন্ডলে এমন কিছু গ্যাস আছে যারা কিনা এই ইনফ্রায়েড আলো শোষণ করতে পারে। তাই পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশের বিকিরণ করে ছেড়ে দেয়া তাপশক্তি বায়ুমন্ডল ভেদ করে পৃথিবীর বাইরে চলে যেতে পারে না।
গ্রিন হাউজে যে রকম তাপমাত্রা ধরে রাখার ব্যবস্থা আছে, এই গ্যাসগুলো তেমনি পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশের বিকিরণ করা তাপশক্তি ধরে রেখে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই পুরো ব্যাপারটিকেই আমরা গ্রিন হাউজ ইফেক্ট নামে জানি। সুইডিস রসায়নবিদ সোভনটে আর হেনিয়াস ১৮৯৬ সালে সর্বপ্রথম ‘গ্রিন হাউজ ইফেক্ট’ কথাটি ব্যবহার করেন৷
আমরা জানি আমাদের বায়ুমন্ডলের ৯৯ ভাগই হচ্ছে নাইট্রোজেন (৭৮%) ও অক্সিজেন (২৩)। বাকি থাকে মাত্র ১% গ্যাস। প্রশ্ন হচ্ছে অবশিষ্ট এই গ্যাসগুলোর মধ্যে গ্রিন হাউজ গ্যাস কোনগুলো? বায়ুমণ্ডলে মূলত কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন (CFC), নাইট্রাস অক্সাইড (N2O), ওজোন (O3), জলীয় বাষ্পের (H2O) তাপ শোষণ করার ক্ষমতা অনেক বেশি। এই গ্যাসগুলোই মূলত গ্রিন হাউজ গ্যাস নামে পরিচিত। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
গ্রীন হাউজ ইফেক্টের কারণ
১৮২৪ সালে ফরাসী গণিতবিদ জোসেফ ফুরিয়ার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, “পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল একটি “হটবক্স” – যা একটি হিলিয়াম থার্মোমিটার এর মত কাজ করে”। গ্রীন হাউজ ইফেক্টের প্রধান কারণ সমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১) জীবাশ্ম জ্বালানীর পরিমান বৃদ্ধিঃ
সভ্যতা যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই কয়লা, পেট্রোল, ডিজেল ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বেড়েই চলেছে। এ সকল জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি ও কারখানা থেকে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ মোট গ্রীন হাউজ গ্যাসের শতকরা ৬৫ শতাংশ। কার্বন-ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন (CFC) ও ওজোন- এই গ্যাসগুলো গ্রীন হাউস ইফেক্ট সৃষ্টির জন্য দায়ী৷
২) বৃক্ষরোধন:
বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত বৃক্ষরোধন৷ আমরা জানি সবুজ উদ্ভিদ সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় তাদের খাবার তৈরি করার জন্য বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মাটি থেকে পানি ও সূর্যের আলো থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। মাত্রাতিরিক্ত বন উজাড়ের ফলে বিভিন্ন কারণে নির্গত কার্বন-ডাইঅক্সাইড বায়ুমন্ডলে থেকে যাচ্ছে। ফলে, বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৩) নাইট্রোজেন সারের অত্যাধিক ব্যবহার:
বর্তমানে জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে কৃষি জমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাই, ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জমিতে নাইট্রোজেন সার (যেমন – ইউরিয়া) ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে নাইট্রোজেন অক্সাইড (নাইট্রাস অক্সাইড) গ্যাসের পরিমাণও বেড়েই চলেছে। কারণ, নাইট্রোজেন বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে নাইট্রাস অক্সাইড উৎপন্ন করে।
৪) বর্জ্য ও মিথেন গ্যাস:
আবর্জনা, মৃত উদ্ভিদ, প্রাণী ও গবাদি পশুর মলমূত্র মিথেন গ্যাসের প্রধান উৎস। মিথেন গ্যাসও বায়ুমন্ডলের উপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে৷
গ্রীন হাউজ প্রভাবের ফলাফলঃ
গ্রীন হাউজ বায়ুমন্ডলের উপর কিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
তাপমাত্রা বৃদ্ধিঃ
১৮৮০ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল- এই সময়কালে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৬°C বেড়েছে । ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর উষ্ণতা ২.৫°C এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ৩.৮°C পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে৷ নাসার গোদার্দ ইনস্টিটিউট ফর স্পেন স্টাডিজের সমীক্ষা অনুসারে ১৯৯৮ ও ২০০৫ সাল ছিল সময়কালের সর্বাপেক্ষা উষ্ণতম বছর।
মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়াঃ
যে হারে বিষুবীয় ও মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনটা চলমান থাকলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে সুমেরু কুমেরুতে গ্রীষ্মকালে সমস্ত বরফ গলে যাবে৷
সমুদ্র-স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়াঃ
বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে যদি মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যায়, তবে এর ফলশ্রুতিতে সমুদ্রের স্তর ৩০–৪০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও, গ্রীন হাউজ গ্যাসের কারণে সমুদ্রে ক্ষারের পরিমাণ কমবে, ফলে জীবের অস্তিত্ব লোপ পেয়ে বাস্তুতন্ত্রের বিনাশ ঘটবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়াঃ
আবহাওয়া যতই পরিবর্তনের সম্মুখীন হবে ততই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানে ফসলের ক্ষতি, গবাদিপশু ও মানুষের প্রাণ সংশয়। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
গ্রীন হাউজ ইফেক্টের প্রভাব নিয়ন্ত্রনের উপায়ঃ
গ্রীন হাউজ ইফেক্টের প্রভাব নিয়ন্ত্রণের কিছু উপায় নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারের পরিমাণ যতটা সম্ভব কমাতে হবে। এতে করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাবে৷ জীবাশ্ম জ্বালানীর পরিবর্তে সৌর শক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস, বায়োডিজেল, জোয়ার-ভাটা শক্তি, ভূ-তাপীয় শক্তি, আবর্জনা থেকে প্রাপ্ত শক্তি, নিউক্লিয়ার এনার্জি প্রভৃ্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
কৃষিকাজে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে প্রাকৃতিক সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে৷
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে সবুজায়নের কোন বিকল্প নেই। পরিকল্পিত বনায়নই পারে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে। এছাড়া ক্রমবর্দ্ধমান গ্রীন হাউস প্রভাব নিয়ে প্রণীত চুক্তিগুলো যথাসম্ভব দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
আরও পড়ুন- প্লাস্টিক দূষণ
আরও পড়ুন- প্লুটো কেন গ্রহ নয়?