বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সরকার ব্যবস্থা হলো গণতন্ত্র। বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই গণতন্ত্র ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সাধারণভাবে গণতন্ত্র বলতে বোঝায়, যে শাসন ব্যবস্থায় শাসন ক্ষমতা মুষ্টিমেয় লোকের হাতে পুঞ্জীভূত না থেকে রাষ্ট্রের স্ব জনসাধারণের ওপর ন্যস্ত থাকে এবং জনগণই তাদের সরকার গঠন করে।
গণতন্ত্র হলো এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকার থাকে। এ ব্যবস্থায় একাধিক রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জনগণের অংশগ্রহণ থাকে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা এবং রাষ্ট্রের কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও কল্যাণ বৃদ্ধির ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য।
গণতন্ত্রের ধারণা
আমেরিকার প্রখ্যাত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে- “গণতন্ত্র হলো, জনগণের, জনগণের জন্য ও জোনগণ দ্বারা নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা।” অধ্যাপক গেটেলের মতে, “যে শাসন ব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগে অংশ নেয়ার অধিকারী তাই গণতন্ত্র।” সাধারণ অর্থে, গণতন্ত্র হচ্ছে মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থে গঠিত ও পরিচালিত সরকার। এর অর্থ এই নয় যে, গণতন্ত্র সংখ্যালঘুর মতামত ও স্বার্থকে উপেক্ষা করবে, বরং গনতন্ত্রে আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। সুতরাং গণতন্ত্র বিশ শতকের একটি জনপ্রিয় ধারণা, যা বর্তমানে সরকার পরিচালনার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণেই গণতন্ত্র সমাজ ও রাষ্ট্র সংক্রান্ত অধ্যয়নযোগ্য বিষয়াবলীর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ।
সরকার ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল। গণতন্ত্র সর্বপ্রথম প্রচলিত হয় প্রাচীন গ্রীসের এথেন্সে। গ্রীসের নাগরিক সমাজ গণতন্ত্র বলতে বুঝতো এমন একটি রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা যাতে গোটা নাগরিক সমাজ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। এথেন্সীয় গণতন্ত্র পরবর্তীতে চলমান থাকেনি। মধ্যযুগে ধর্ম ও রাজার দ্বৈত শাসন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অনেকটা সময় কেটে গেছে। দীর্ঘকাল পরে ইউরোপে গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম ঘটে খ্রিস্টীয় সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে। উনিশ ও বিশ শতকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন দেখা যায়। অষ্টাদশ শতকের গণতান্ত্রিক ভাবধারার উৎসমূল হিসেবে ইংল্যান্ডকে চিহ্নিত করা হয়। বর্তমানে গণতন্ত্রের বিকাশ এতই সাফল্য লাভ করেছে যে, আধুনিক সভ্যতা গণতান্ত্রিক সভ্যতায় পরিণত হয়েছে।
গণতন্ত্রের প্রকারভেদ
গণতন্ত্র সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে কার্যকর হয়, যথাঃ ১। প্রত্যক্ষ বা বিশুদ্ধ গণতন্ত্র ও ২। পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র
যে শাসন ব্যবস্থায় নাগরিকগণ প্রত্যক্ষ বা সরাসরিভাবে শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় তাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। প্রাচীন গ্রিসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রগুলোতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কর ধার্য, বিচারকার্য পরিচালনাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ করত। সে সময় নাগরিকের ধারণা সীমাবদ্ধ ছিল। রাষ্ট্রের সকলেই নাগরিকত্বের সন্মান পেত না। আধুনিক রাষ্ট্র আয়তনে বিশাল। এর জনসংখ্যাও বেশি। এ অবস্থায় প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ কম। তবে সুইজারল্যান্ডের কয়েকটি অঞ্চলে আংশিকভাবে এখনও প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের ব্যবস্থা চালু আছে।
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র
পরোক্ষ গণতন্ত্র বলতে প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করার পদ্ধতিকেই বোঝায়। এ ধরনের গণতন্ত্রকে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলা হয়। এ পদ্ধতিতে নাগরিকগণ সরাসরি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করেন না। পরোক্ষ গনতন্ত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই আইন প্রণয়নসহ শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রই প্রচলিত রয়েছে।
গণতন্ত্রের দোষগুণ
গণতন্ত্রের সুন্দর দিকগুলো হলো গণতন্ত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি হলো দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা। এ শাসন ব্যবস্থায় সরকার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয় এবং জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা থাকে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা হলো জনমত দ্বারা পরিচালিত সরকার। স্বৈরাচারী পন্থায় নিয়ন্ত্রণ, দমন, নিপীড়নমূলক আচরণ এ শাসনব্যবস্থায় কোনক্রমেই কাম্য নয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় নীতি- নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ ব্যবস্থায় জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা স্বীকৃত। ফলে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার সৃষ্টি হয়। এ ব্যবস্থায় সরকার জনগণের সরকার হিসেবে বিবেচিত। জনগণের আস্থা হারালে এ সরকার টিকে থাকতে পারে না। এ ব্যবস্থায় ব্যক্তি তার আত্মবিশ্বাসের সর্বাধিক সুবিধা ভোগ করে। তদুপরি গণতন্ত্র হচ্ছে কল্যাণকামী সরকার। এর মূল উদ্দেশ্যই হলো জনকল্যাণ সাধন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটিও রয়েছে। প্রাচীনকালের প্রখ্যাত মনিষী ও দার্শনিকগণ, যেমন- প্লেটো ও অ্যারিস্টটল গণতন্ত্রকে মূর্খ বা অযোগ্যের শাসনব্যবস্থা বলে অভিহিত করেছেন। কেননা, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হিসেবে গণতন্ত্রে নির্বাচনের মাধ্যমে অজ্ঞ, অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিও শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। ফলে উপযুক্ত লোকের অভাবে গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না এবং শাসনকার্য পরিচালনায় নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
বাস্তবে গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসণে পরিণত হয়। সংখ্যালঘুরা আইনসভায় তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারে না। ফলে তাদের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে সরকার উদাসীন থাকতে পারে। গণতন্ত্রে বহু পরস্পরবিরোধী মত ও ধারণা দেখা যায়। এতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতপার্থক্য ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় এবং জাতীয় সংহতি বিনষ্ট হতে পারে। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে জাতি দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে।
অনুন্নত দেশগুলোতে সরকারি দল নিজ দলের স্বার্থের প্রতি লক্ষ রেখে শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে। ফলে নিরপেক্ষতা নষ্ট হয়। এতে করে গণঅসন্তোষ দেখা দেয়। গণতন্ত্র তুলনামূলক ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থা। ঘন ঘন নির্বাচনের ব্যবস্থা, জনমত গঠন, ব্যাপক প্রচারকার্য ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীদের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
আরও পড়ুন- রাষ্ট্র কাকে বলে? রাষ্ট্রের উপাদান কয়টি?