- ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার মহাখালী এলাকা থেকে রাজনৈতিক নেতা এম ইলিয়াস আলী গুম হয়েছিলেন। ৯ বছরেও মেলে নি হদিস।
- ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় যাওয়ার পথে সাভারের নবীন নগর থেকে নিখোঁজ হন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র আল মোকাদ্দাস ও ওয়ালীউল্লাহ ওয়ালীদ।
পরিসংখ্যান বলছে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ৬১৪ জন গুম হয়েছেন। আবার কোন হিসেবে এর সংখ্যা ১২০০-১৫০০ অব্দিও। ১১৩ মিনিটে সেই গুমের রাজনীতিকে ফিকশনের মোড়কে ওয়েব প্ল্যাটফর্মে পরিবেশন- ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’।
অসহিষ্ণু সময়কে ক্যামেরা বন্দি করতে গেলে যতটা সাহস লাগে তার পুরোটাই ঢেলে দিয়েছেন নির্মাতা রায়হান রাফি। গত ২২ অক্টোবর ‘চরকি’তে মুক্তি পেয়েছে থ্রিলার ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’।
কাহিনি সংক্ষেপ
রাজনীতির মাঠ সব সময়ই উন্মাতাল। ক্ষমতার পালা বদলের সাথে গদির আধিপত্য হয়তো বদলায়, কিন্তু বদলায় না সাধারণ মানুষের নিত্য দিনের নাভিঃশ্বাস। সেই অবিমিশ্র সময়েই পরিচয় হয় গ্রামীণ তরুণী পাখি আর উঁচু তলার নেতা ফিরোজ খানের। তবে পটভূমিকা মোটেও গতানুগতিক নয়।
নিভু নিভু এক কারখানায় চাকরির প্রলোভনে আসে গ্রামের সাধাসিধে এক তরুণী পাখি। কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যে জনশূন্য কারখানাতেই আটকে পড়ে সে। দিন শেষ হলেও তাকে উদ্ধারে কেউ এগিয়ে আসে না। ঘণ্টাখানেক বাদে সে টের পায়, একই কারখানায় আটকে আছে আরও একজন মানুষ। তবে সে আর দশটা সাধারণ লোকের কাতারে নয়, জনদরদী, প্রভাবশালী রাজনীতিক ফিরোজ খান।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুই বন্দির মাঝে গড়ে ওঠে নির্ভরতার সম্পর্ক। একত্রে বেরুবার পথ খুঁজতে গিয়েই পরস্পরের সত্যকে আবিষ্কার করে দুই ভিন্ন মেরুর মানুষ।
বাস্তবতার মঞ্চে অভিনেতা সকলেই
ফজলুর রহমান বাবু একজন আপাদমস্তক অভিনেতা। ভিন্ন অবতারে পদার্পণ করেন বিচিত্র প্রজেক্টে। এই যেমন- ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’র সাথে একই দিনে মুক্তি পাওয়া প্রসূন রহমানের ‘ঢাকা ড্রিম’- এ এক অন্ধ ভিক্ষুক হিসেবেও মিশে গেছেন সহজাতভাবে। তেমনি এখানেও অবরুদ্ধ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাঁর বিকল্প ভাবা কঠিনই।
তমা মির্জার নামের পাশে ‘নদী জন’- এর কল্যাণে রয়েছে জাতীয় পুরস্কারের তকমা। মিডিয়ায় ব্যক্তিগত যাত্রাতেও সে বিষয়ে সচেতন এই সমালোচক প্রিয় অভিনেত্রী।
পাখি চরিত্রে গ্ল্যামারের বাইরে সরল সোজা গ্রামীণ যুবতীর চরিত্রেও মানিয়ে গেছেন অনায়াসে। গল্পের প্রয়োজনে একজন অভিনেতার নিজস্ব নাম ঠেলে চরিত্রে অবগাহন এবং সময়ে তা অবমুক্ত করার প্রক্রিয়াটা ভালো মতোই রপ্ত করেছেন তিনি। সংলাপ, শারীরিক অভিব্যক্তি কোন অংশই জড়তার অধিকারে যায় নি। প্রজন্মের ব্যবধান সত্ত্বেও ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ ফিল্মে দুই অভিনেতার রসায়ন ছিল অনবদ্য।

মন্দের মন্ত্রণা কম
ওয়েব ফিল্মকে ঘিরে আলোচনার সুবাতাসে গত এক বছর ধরেই। হালের ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’, ‘মুনশিগিরি’র কল্যাণে নব্য ওয়েব প্ল্যাটফরম চরকিও আছে তুঙ্গে।
টানা পনেরো দিন চলে ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ সিনেমার শ্যুটিং। তাই গোটা ইউনিটের অবস্থানটাও ছিল আবশ্যক। রংপুরের এক পুরনো কারখানায় চিত্রায়ন হয় সিনেমার আশি ভাগের। এছাড়াও এফডিসিতেও করা হয় কিছু অংশের কাজ।
ছবিতে মূল দুই চরিত্রের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলেন সুমন আনোয়ার, ইন্তেখাব দিনার, নাসির উদ্দিন খান প্রমুখ। সাউন্ড ডিজাইনে আরাফাত কীর্তির কাজ ছিল প্রশংসনীয়। ক্লাইমেক্স অংশে চিরাচরিত কিছু ট্র্যাকের ব্যবহার বাদ দিলে সম্পূর্ণটাই ছিল মোলায়েম ও উপযুক্ত। এর বাইরে সুরারোপে ছিলেন আরাফাত মহসিন নিধি।
সীমিত রায় অন্তরের ওয়ার্ম এবং ডার্ক টোনে সিনেমার ভিজুয়ালাইজেশন একই সাথে বাস্তবিক এবং পরিচ্ছন্ন মনে হয়েছে। তবে সবচাইতে আরামদায়ক ব্যাপার হলো, স্বল্প পরিসরেও মিজো সিনের চর্চা। পরিত্যক্ত কারখানা, বাগান বাড়ি কিংবা রেল স্টেশন – স্বাভাবিক স্থানের চিত্রায়নেও যত্ন আর তৃপ্তির প্রভাব ছিল অনন্য।
ক্যামেরায় রাজিবুল ইসলাম কাজ করেছেন মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর সাথে। তাই অভিজ্ঞতার পাল্লায় দুঁদে শিল্পীদেরই পেয়েছেন রাফি। প্রযোজনায় ছিলেন আরও দুই বরেণ্য নির্মাতা- ক্রিয়েটিভ প্রযোজক আদনান আল রাজীব, প্রযোজক হয়েছেন রেদওয়ান রনি।
কারখানার দৃশ্যায়নে খামতি না থাকলেও এর দীর্ঘ ব্যপ্তি কিছুটা বিরক্তির উদ্রেক করেই। এক ঘণ্টারও বেশি সময় একই সারভাইভাল থ্রিলের গোলক ধাঁধায় আটকে রাখার বদলে মিনিট বিশেক কমানোই যেত। ইন্তেখাব দিনারের কিছু সংলাপ প্রক্ষেপণ আরোপিত মনে হয়েছে। সে তুলনায় সুমন আনোয়ারের অভিব্যক্তি ও স্পষ্ট বাচন ভঙ্গি একই সাথে আনন্দদায়ক এবং আকাঙ্ক্ষিত।
পরিচালকের আলাপনে
২০১৪ সাল, তখন শর্ট ফিল্মের জয় যাত্রা সবে শুরু। ভেবে চিন্তে রায়হান রাফির মাথাতেও জুড়ল শর্ট ফিল্মের ভূত। মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে ঘোড়া রোগেরই নামান্তর ওটা। বিয়ের চেইন বিক্রি করে দেন মা। সে টাকাতেই প্রথম নির্মাণ আর আলোচনায় আসা। যার ফল গড়ায় পোড়ামন-২ এর পরিচালক হিসেবে মনোনয়নে। মায়ের সেই ত্যাগকে মনে রেখেই নিজের প্রযোজনা সংস্থার নাম রেখেছেন কানন।
নয়া ওয়েব ফিল্মে কী দেখতে পাবে দর্শক? প্রশ্নের জবাবে এই নন্দিত নবীন জানান,
‘সিনেমার গল্প এক পরিত্যক্ত কারখানায় আটকা পড়া দুজন মানুষের, যাদের মধ্যে একজন রাজনীতিবিদ ফিরোজ খান,অন্যজন পাখি। খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসার প্রাণান্তকর চেষ্টার মধ্য দিয়ে এক গোমড় বেরিয়ে আসার গল্প এটি।’

অস্থির, ক্রান্তি লগ্নে লেখা এই ছবির চিত্রনাট্য। অতিমারির দুঃস্বপ্নে যখন সকলের বসবাস তখনই সৃজনশীলতার মাঝে মুক্তি খুঁজেছিলেন রায়হান রাফি। প্রথম আলোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে উঠে আসে তারই খণ্ড অংশ-
‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ আমার স্বপ্নের প্রজেক্ট। প্রায় দুই বছর আগে এই গল্পটি আমি লিখেছিলাম।করোনার সময় দেশের সব কিছু যখন স্থবির, তখন আমি বেশ কিছু গল্প লিখি। এই গল্পটা চরকি খুব পছন্দ করলো। তাদের এই ভালো লাগা থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এটা আমি চরকির জন্যই বানাবো। আমার টিমের প্রতিটি মানুষ অনেক কষ্ট করে এটি বানিয়েছি।’
কী ভাবছেন কুশীলবেরা?
তমা মির্জা একে চ্যালেঞ্জিং কাজ হিসেবেই ধরছেন। এর কারণ হিসেবে জানান, ‘গল্পের বেশীর ভাগ জুড়ে দুটো মানুষ দেখানো হয়েছে। আমার জেনারেশনের কারও সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করি নি। ফজলুর রহমান বাবু ভাইয়ের মতো কিংবদন্তী অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছি।‘
এর আগে ‘নদী জন’, ‘ফ্রম বাংলাদেশ’, ‘ডার্ক সাইড অব ঢাকা’ ছবিগুলোতেও নন গ্ল্যামারাস চরিত্রে অভিনয় করেছেন তমা। তাই ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’তে সাধারণ নারী হিসেবে নিজেকে দর্শকের মনে স্থান করে নিতে সমস্যা হয় নি।
প্রায় এক যুগ ধরে কাজ করার পর আলোচনায় আসছেন এই সবে। এই উৎসাহকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন তমা। জানালেন নিজের আন্তরিকতার কথাও, ‘চেষ্টা করছি নিজেকে বারবার প্রমাণ করার। এই চেষ্টা সব সময় বজায় থাকবে।‘
আরও পড়ুন- মুন্সিগিরিঃ আয়নাবাজি ম্যাজিক নাকি নিষ্প্রভ থ্রিলার?
চরিত্রের প্রয়োজনে অভিনেতাদের পরিবর্তন করতে বহু কিছুই। বহির্বিশ্বে মেথড অভিনয়ের জোর চর্চা থাকলেও এদেশে এর কদর বা চিত্রনাট্য কোনটাই দেখা যায় না। প্রচারের পরিধি কম হলেও শ্রমে অবহেলা করেন নি তমা। চরিত্রের সন্ধানে এবং প্রয়োজনীয় চিত্রায়নের জন্য মেনে চলেছেন নিয়ম। শোনা যাক তার মুখেই,
‘তৃষ্ণা এবং খাবারের ক্ষুধা যেন চেহারায় বোঝা যায় সেজন্য খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমিয়েছিলাম। সকালে শুধু নাস্তা করে শুটিংয়ে যেতাম। দিনে হালকা ফলমূল ছাড়া কিছুই খেতাম না। এমনও হয়েছে দিনে অনাহার থেকে রাতে হোটেলে ফিরে খাবার খেয়েছি। যে পাউরুটি খেয়েছিলাম ওটা সত্যি সত্যি ময়লা ছিল। পানি খাওয়ার যে দৃশ্য আছে ওটা ন্যাচারাল ছিল। এক শটে নেয়া হয়েছে মানুষকে বিশ্বাস করানোর জন্য। এজন্য আমাকে ওই ময়লা পানিই খেতে হয়েছে। তেলাপোকার গন্ধ ছিল। আমি যে মাটিতে পড়ে ছিলাম ওই জায়গা বিশ্রী নোংরা ছিল। সব কিছু মিলিয়ে পরিশ্রম করেছি।‘

প্রতি স্ক্রিপ্টেই নিজেকে বদলাতে জানেন ফজলুর রহমান বাবু, ফিরোজ খান চরিত্রেও ছিলেন সাবলীল। কিন্তু কী কারণে এই গল্পকে কাজের জন্য আদর্শ মানছেন তিনি?
‘আমার মনে হয়েছে, এই ছবিটা কেবল অনলাইন নয়, যে কোনো প্ল্যাটফর্মের জন্য অন্য রকম। আমাদের এখানে নতুন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়েছে, গল্প ও কাহিনি নির্ভর, সেই জায়গা থেকে মনে হয় এটা একটা চমৎকার গল্প। সিনেমার যেমন নানা বাঁক থাকে, দ্বন্দ্ব থাকে, গল্পের নানা মোড় থাকে, যেখান থেকে দর্শক আবার নতুন করে আগ্রহী হয়ে ওঠে,গল্পের ভাঁজে ভাঁজে জড়িয়ে পড়েন দর্শক—এ রকম একটি ছবি খাঁচার ভিতর অচিন পাখি।‘

সারভাইভাল থ্রিলার জনরায় অবিস্মরণীয় ‘ছুটির ঘণ্টা’। বাংলাদেশে এরপর সেভাবে কোন চলচ্চিত্রই নির্মিত হয় নি। তাই সে অংশে নবদিগন্তের একটা হাতছানি ঠিকই দিয়েছে এই ছবি। একই উক্তি শোনা যায় নির্মাতার কণ্ঠেও,
‘যে কনসেপ্ট নিয়ে গল্প, সেই কনসেপ্টে বাংলাদেশে কেউ কাজ করে নি।‘
পরিপক্ব চিত্রনাট্যের বেশ কাছেই ছিল ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’। ক্লাইমেক্সে অতি মাত্রায় নাটকীয়তার আভাস থাকলেও বাড়তি চাপ ফেলে নি। বিশেষত ব্যক্তিগত ট্রাজেডির অংশটা অপ্রয়োজনীয়ই ঠেকেছে। এক মোড়কে সাবপ্লট আঁকতে গেলে অনেক সময়েই হড়কে যান দেশি নির্মাতারা। সে দিক থেকে যথার্থ ছিলেন রাফি ও তাঁর দল।
শুধু ওয়েব ফিল্ম হিসেবে নয়, পরিচালকের পরিকল্পনায় আছে বড় পর্দার হাতছানিও। দেড় থেকে দুই মাস বাদে সিনেমা হলে বন্দি দশা ঘোচাবার সাধ আছে এই অচিন পাখির।
-সারাহ তামান্না