করোনা মহামারী রচনা
ভূমিকাঃ বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত রোগের নাম হলো করোনা মহামারী। সারা পৃথিবীব্যাপী কোনো নতুন রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে তাকে মহামারী বলে। করোনা ভাইরাস মানুষের দেহকোষের মধ্যে নিজের গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ ধারণ করতে পারে এবং সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়, তাই করোনা ভাইরাস এতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। করোনার অনেক প্রজাতি রয়েছে, তন্মধ্যে সাতটি প্রজাতি মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। করোনা মহামারী শেষে প্রায় তিন বছর পুরো পৃথিবীকে স্থবির করে ফেলেছিল।
নামকরণঃ করোনা হলো এক ধরনের ভাইরাসের দ্বারা সৃষ্ট সংক্রামক রোগ। করোনা শব্দটি ল্যাটিন শব্দ। COVID-19 নামকরণের কারণ হলো co দিয়ে Corona, vi দিয়ে Virus, d দিয়ে Disease বোঝানো হয়েছে। এই ভাইরাসটি ২০১৯ সালে ছড়িয়ে পড়ে তাই এই নাম দেওয়া হয়েছে COVID-19। “করোনা” ও “ভাইরাস” দুটি শব্দই লাতিন ভাষার। করোনা শব্দের অর্থ মুকুট আর ভাইরাস শব্দের অর্থ বিষ। ভাইরাসটির আকৃতিই করোনা নামকরণের মূল কারণ। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে এই ভাইরাসটি দেখলে, সেখানে ভাইরাসটির শরীর জুড়ে অসংখ্য কাঁটারমতো খাজকাটা দেখা যায়। যা অনেকটাই মুকুটের মতো। তাই এই ভাইরাসের নাম দেওয়া হয় করোনা। এই ভাইরাস অন্যান্য ভাইরাসের চেয়ে বড়।
ভাইরাস শনাক্তঃ ভাইরাসটি মূলত প্রথম কোথায় সংক্রমণ ঘটায় তার ব্যাখ্যা স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হয় চীনের হুবাই প্রদেশের উহান শহরে অজানা ভাইরাল নিউমোনিয়ার ঘটনা থেকেই এর সংক্রমণ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এর সংক্রমণ ছড়ায় এবং অতি অল্প সময়েই মধ্যে মহামারী আকার ধারণ করে। চীনে প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু হয় ১১ ই জানুয়ারী ২০২০সালে। WHO Covid 19 কে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে ১১ই মার্চ ২০২০ সালে। বিজ্ঞানীরা ৯ই জানুয়ারী Covid 19 কে SARS গোত্রের ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করেন।
করোনার লক্ষণঃ করোনা রোগের সাধারণ লক্ষণগুলো হলো জ্বর,সর্দি, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, গলা ব্যথা, গন্ধ ও মুখের স্বাদ হারিয়ে যাওয়া প্রভৃতি। করোনা ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশের পর এর উপসর্গ প্রকাশ হতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় লাগে। উপর্সগ ছাড়াও করোনা সংক্রমণ হতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত রোগীরা সঠিক পরিচর্যা আর চিকিৎসা পেলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেন। কিন্তু যেসব মানুষ পূর্বেই নানা রকম রোগাক্রান্ত, যেমন- ডায়াবেটিক, হ্রদরোগে আক্রান্ত, শ্বাসকষ্ট বা ক্যান্সারে আক্রান্ত তাদের জন্য করোনা খুবই বিপদজনক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা মারা যান।
সংক্রমণঃ করোনা একটি সংক্রামক রোগ। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি উন্মুক্ত স্থানে হাঁচি কাশি দিলে আশেপাশের ১-২ মিটার পরিধি জুড়ে এ ভাইরাস বাতাসে ভাসমান থাকতে পারে। এতে করে অন্য কোনো ব্যক্তি আশেপাশে থাকলে সে অনায়াসে করোনা আক্রান্ত হবে। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে করোনা সংক্রমণ হবে। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি স্বাস্থ্যবিধি না মেনে হাত দিয়ে কোনো কিছু স্পর্শ করলে, সেই বস্তুতে ভাইরাস থাকতে পারে। যদি পরে অন্য কোনো ব্যক্তি বস্তুটি স্পর্শ করেন তবে তিনিও করোনা আক্রান্ত হবেন। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা ঘরে রাখতে হবে। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির জিনিসপত্র জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করতে হবে। হাত জীবাণুমুক্ত না করে নাক, চোখ মুখ স্পর্শ না করা উচিৎ নয়। কারণ কোনোভাবে কারো হাতে ভাইরাস লেগে গেলে, এরপর যদি হাত জীবাণুমুক্ত না করে নাক,চোখ, মুখ স্পর্শ করে তবে উন্মুক্ত শ্লেষ্মাঝিল্লি দিয়ে ভাইরাস দেহের ভিতরে প্রবেশ করে। এভাবে বহু মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছে।
প্রতিরোধঃ করোনা যেহেতু মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ছড়ায় তাই বাইরে গেলে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নিজের কাজ করতে হবে। বাইরে বেরুনোর সময় মুখে মাস্ক পরা অত্যাবশ্যক। এতে করে নাক, মুখ দিয়ে ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। বাইরে থেকে এসে হাত জীবাণুমুক্ত করতে হবে এবং ব্যবহৃত জিনিসপত্র ভালো করে জীবাণুমুক্ত করে তারপর ঘরে আসা উচিত। বাইরে থেকে এসে ব্যবহৃত জামাকাপড় সাবান পানি দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে ধুয়ে নেওয়া উচিৎ।
এছাড়া বাইরে গেলে যেখানে সেখানে থুথু ফেলা যাবে না। অফিস, রেস্তোরাঁয় বা অন্য কোনো জায়গায় গিয়ে পানি বা খাবার গ্রহণের সময় যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোনো ব্যক্তির করোনা উপসর্গ দেখা দিলে, তার সাথে ন্যূনতম ৬ফুট দূরত্ব বজায় রেখে যোগাযোগ করতে হবে। জনসমাগম হয় এমন সব জায়গা এড়িয়ে চলা, হাসপাতালে গেলেও সবোর্চ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা, যেখানে সেখানে হাত না দেওয়া এবং কিছু সময় পর পর হাত জীবাণুমুক্ত করা করোনা প্রতিরোধের অন্যতম কিছু উপায়।
টীকাকরণঃ অনেকদিনের গবেষণার পর পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সফলতা লাভ করেন। সবার প্রথমে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণাকারী দল অনেক প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ করোনা ভাইরাসের একটি টিকা আবিষ্কার করে তার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করেন।পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন নিজেদের দেশে আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা শুরু করেন। ধীরে ধীরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনার ভ্যাকসিন কার্যক্রম চালু হয়। বর্তমানে পৃথিবীর বেশিরভাগ করোনা আক্রান্ত দেশই করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে নিয়েছেন। এতে করে করোনায় মৃত্যু হার প্রায় শূণ্যের কোটায় নেমে এসেছে।
করোনার বিশ্ব পরিসংখ্যানঃ মরণঘাতী করোনা মহামারীতে পুরো বিশ্ব পর্যুদস্ত হয়েছিল। করোনায় গোটা বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় ৩০ কোটি ৬ লাখ মানুষ। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫৪ লাখ ৮৯ হাজার। করোনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, পোল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতে। বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল ২০২০ সালের ৮ই মার্চ। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে প্রথম মৃত্যু ঘটে ১৮ই মার্চ।
করোনার প্রত্যক্ষ প্রভাবঃ সারা পৃথিবী জুড়ে করোনা মহামারীর প্রত্যক্ষ প্রভাব খুবই ভয়াবহ। করোনা মহামারীর ভয়াল থাবায় প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল। একটা সময় প্রতিদিনই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা আক্রান্তের হার বেড়ে যেত। এত এত মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেওয়াটাও চিকিৎসকদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।করোনায় মানুষ যে কত আপনজনকে হারিয়েছে, কত ডাক্তার, নার্স করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, কত পরিবার হারিয়েছে তাদের পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যকে তার সঠিক হিসেব দেয়া কঠিন। ধনী গরিব কেউ রেহাই পায়নি করোনার ছোবল থেকে।
আমেরিকা, ব্রিটেন, স্পেন, ইতালি, ব্রাজিলের মতো উন্নত দেশগুলোতে করোনা আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। স্বল্প উন্নত দেশগুলোও করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। নিজেদেরকে করোনা থেকে বাঁচাতে প্রতিটি দেশ ধীরে ধীরে অন্য দেশের সাথে সাময়িকভাবে যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছিল। করোনা উৎপত্তিস্থল চীন প্রায় ৩ বছর পুরো দুনিয়া থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু না হলে বাইরের শেষ থেকে কাউকে চীনে আসতে দেয়া হতো না। শত শত ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষা জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে এই করোনার কারণে। যদিও ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে চীন “জিরো কোভিড পলিসি” উঠিয়ে নেয়। চীনের মানুষ প্রায় তিন বছর পর করোনার কারণে শৃঙ্খলে আবন্ধ জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে।
তবে করোনা মহামারীর শুরুর দিকে শুধু চীন নয়, প্রায় সব দেশই আকাশপথ, স্থলপথ আর নৌ পথ বিদেশী যাত্রী যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছিল। সব দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। অফিস, আদালত, কল কারখানা, পর্যটন কেন্দ্র, মার্কেট, হোটেল, রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখা হয়েছিল অনেকদিন। বর্তমানে করোনা মহামারীর কারণে অর্থনীতিবিদরা, গবেষকরা ধারণা করছেন বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিবে মারাত্মকভাবে। এরই মধ্যে পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলোতে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশেই দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এ ভাইরাসের কারণে অনেক দেশে দারিদ্র্যতার হার বেড়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। মানুষের মধ্যে হতাশা ও আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেড়ে গেছে।
করোনার পরোক্ষ প্রভাবঃ করোনা মহামারী প্রতিরোধে লকডাউনের কারণে ছোট, মাঝারি, বড় সব ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত লক্ষ লক্ষ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। বেতন দিতে না পারায় অনেক প্রতিষ্ঠানই কর্মী ছাটাই করতে বাধ্য হয়েছেন। শতশত মানুষের ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। করোনা মহামারীর প্রভাবে শেয়ার বাজারে ধস, রেমিট্যান্স, আমদানি রপ্তানিখাত ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্প, হোটেল এবং পর্যটন শিল্পের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপকভাবে।ঔষধপত্র, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে করে বর্তমানে সাধারণ মানুষ দুর্বিষহ কষ্ট ভোগ করছে।
উপসংহারঃ মানবসভ্যতার ইতিহাসে মানুষ যত রকমের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে তন্মধ্যে করোনা মহামারী অন্যতম। মানুষ তার জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করে চলেছে নানা ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। মানুষ আজ আকাশ থেকে ভূগর্ভে পর্যন্ত বিচরণ করে চলেছে প্রবল দাপটে। মানুষ যখনই প্রকৃতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছে তখন প্রকৃতি মানুষকে নানান দুর্যোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। একটি ক্ষুদ্র ভাইরাস আমাদের অনেক বড় একটা শিক্ষা দিয়ে গেল। প্রকৃতির কাছে আমরা বড়ই অসহায়। করোনা মহামারীর প্রভাবে পুরো বিশ্বে এসেছে আমূল পরিবর্তন। মানুষের জীবনযাত্রা, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুর উপর করোনার প্রভাব পড়েছে ভয়াবহভাবে। তারপরও মানুষ হারতে শিখেনি। নতুন উদ্যমে,নতুন কর্মস্পৃহা নিয়ে মানুষ জীবনকে, এই পৃথিবীকে নতুন করে গড়ে তুলবে এটাই প্রত্যাশা।
আরও পড়ুন- অন্যান্য রচনা।