in

মীনা পাল থেকে কবরী, আমৃত্যু ছিলেন পাশের বাড়ির মিষ্টি মেয়ে

পারস্পরিক প্রেমই ছিল রাজ্জাকের সাথে কবরীর রসায়নের মূলমন্ত্র
পারস্পরিক প্রেমই ছিল রাজ্জাকের সাথে কবরীর রসায়নের মূলমন্ত্র

‘সাহস কার থাকে জানেন? যে সত্য কথা বলে।‘

ঢাকাই চলচ্চিত্রে প্রায় ছয় দশকের ফিল্মি জীবন, অথচ কবরী সরলতার প্রতিমা ছিলেন আজীবনই। পিছপা হননি বলিষ্ঠ জীবনবোধ থেকে। চলার সঙ্গীদের মাঝপথে ক্ষয়ে যেতে দেখেছেন, দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিধ্বংসী রূপকে। একাত্তরে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন, সৃষ্টি করেছেন জনমত। অকপটে জীবন ও শিল্পের কথা বলেছেন জীবনভর।

রাজ্জাক-কবরী জুটি বাংলা চলচ্চিত্রের অনন্য এক অধ্যায়। আজও সেই জুটির রসায়ন দর্শক স্মৃতিতে অম্লান। সেই রসায়নের মূলে কিন্তু ছিল ভালোবাসা আর সততার অসাধারণ যুগলবন্দী।

কতটা ভালোবাসতেন দুজন দুজনকে? আজকালকার মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা হয়তো মুচকি হেসেই এড়িয়ে যাবেন অথবা গসিপের মধ্যমণি হতে উসকে দেবেন। অথচ ষাটের দশক থেকে আজও প্রবল প্রতাপে স্থায়ী রাজ্জাক-কবরী জুটি কখনোই লুকোছাপা করেননি পারস্পরিক প্রেম বিষয়ে।

রাজ্জাক যেমন বলতেন তাঁর হৃদয় খুললে কবরীর ছবি ছেয়ে থাকবে তেমনি কবরীও একমত এই ধারণায়। সাময়িকীর সাক্ষাৎকারে কবরী বলেন,

‘আমাদের জুটি যে এতটা সফল হবে, তা কিন্তু আমরা অঙ্ক কষে করিনি। স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাভাবিক গতিতে এটা হয়েছে। আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল, সেটা কাজের প্রতি প্রেম। প্রেম তো খারাপ জিনিস নয়, প্রেম স্বর্গীয়।‘

সংসার ভেঙে প্রেমের কথা কখনো ভাবেননি দুজনে। উল্টো পরস্পরের পারিবারিক বন্ধুই হয়ে ওঠেন ক্রমান্বয়ে।

রাজ্জাক-কবরী জুটি, বাংলা চলচ্চিত্রের অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ জুটি; Photo: Steemit
রাজ্জাক-কবরী জুটি, বাংলা চলচ্চিত্রের অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ জুটি; Photo: Steemit

সাত কোটি দর্শকের হৃদয়জয়ী সেই যুগলের মাঝে ছিল বন্ধুত্ব, ঝগড়া, খুনসুটি, অভিমান। তবে সব ছাপিয়ে গিয়েছিল তাদের সততা আর শ্রদ্ধাবোধে। কাজের প্রতি ভালোবাসা, আবেগের পরিণয়ই জীবন্ত হয়ে উঠত পর্দার ‘রংবাজ’, নীল আকাশের নীচে, ময়নামতি, আবির্ভাব, দর্পচূর্ণ সহ অসংখ্য ছবিতে।

সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’(১৯৬৪) ছবির ‘পরানে দোলা দিলো এ কোন ভোমরা’ গানে চপলা কিশোরী মীনা পাল প্রথম দর্শনেই মন কেড়ে নিয়েছিলেন।

‘সুতরাং’ এ যখন পদার্পণ, তখন বয়স তেরোর অবলা-সরলা কিশোরী তিনি। প্রথম ছবির সাইনিং মানি হিসেবে পেয়েছিলেন এক হাজার এগারো টাকা।

সুভাষ দত্তের সাথে ‘সুতরাং’ এ; Photo: প্রথম আলো
সুভাষ দত্তের সাথে ‘সুতরাং’ এ; Photo: প্রথম আলো

মায়ের ছিল ঘোর আপত্তি। সেই কিশোরীকে তো গর্ভবতীও সাজতে হয়েছিল চরিত্রের খাতিরে। কেমন ছিল সেই প্রস্তুতি? জানা যায় তাঁর স্মৃতিচারণমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’ থেকে।

“গামছার মধ্যে তুলো ভরে পেটের ওপর লাগিয়ে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিল – পেট যেন বড় দেখায়”

বিগত শতকের ১৯৫০ সাল; ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জন্মগ্রহণ করেন মীনা পাল। বাবা শ্রীকৃষ্ণদাস পাল এবং মা লাবণ্য প্রভা পাল।

১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম নৃত্যশিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু। ক্রমে টেলিভিশন,পরে রূপালি পর্দায় অভিষেক। গত ১৭ এপ্রিল করোনার করাল গ্রাসে নিভে যায় তাঁর জীবন- দীপ।

আরও পড়ুন- শিল্পের জন্য অর্থের বরাদ্দ নেই, ওয়েব সিরিজেই আশার আলো দেখেন চঞ্চল চৌধুরী

আরও পড়ুন- মাত্র ৫০ লাখে শ্যুটিং, পাইরেসিই শাপেবর হয়েছিল ‘অজ্ঞাতনামা’ক্ষেত্রে

ঢাকাই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় পাঁচ নায়কের অভিষেকে ছিল তাঁর অবদান- ফারুক, সোহেল রানা, জাফর ইকবাল, আলমগীর, উজ্জ্বল। বুলবুল আহমেদের বিপরীতে ‘দেবদাস’ এ পার্বতী হয়ে তৈরি করেছেন ভিন্ন আবেদন, ‘সারেং বৌ’ এর সেই পল্লী সংগ্রামী তেজস্বিনী নারী হিসেবেও ছিলেন অনন্য। কাজ করেছেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৭৩) এর প্রধান ভূমিকায়। তাই ওপার বাংলাতেও তাঁর পরিচিতি বর্ণাঢ্যই।

সাফল্যের শীর্ষে আরোহণ করেও কখনো অতীত সংগ্রামকে ভুলে যাননি সদা অপাপবিদ্ধ হাসির কবরী।

রাজনীতির রণ ময়দানে নেমেছিলেন জনমানুষের হয়ে। বিস্মিত হয়েছিলেন বহুজন, তর্কও জমেছিল। নতুন পরিচয়ের চাপে মিষ্টি মেয়ে নামটাও কি হারাতে বসেছিলেন? উদার হাসিতে এর উত্তর দেন তিনি, ‘আমাকে নিয়ে আলোচনা না হলে সার্থকতা কোথায়? আমাকে নিয়ে বিশ্লেষণ করতে তো সমস্যা নেই।‘

বর্তমান ঢালিউড নিয়ে আক্ষেপের সীমা ছিল না। ক্ষোভের সাথেই জানান চিত্রনাট্যকার, সংলাপ নির্মাতা এমনকি মূল পরিচালকের মধ্যেও ন্যূনতম জ্ঞানের অভাব হতাশ করে। এর পেছনে বিশ্বায়নের চাইতে রুচি আর মেধার অসামঞ্জস্যতাকেই দায়ী করেন তিনি। অর্থের ছড়াছড়ি থাকলেও মৌলিক আবেদন হারিয়েছে এই শিল্প- এমনটাই মনে করতেন কবরী।

‘আমরা যখন ‘সুতরাং’ করি তখন একটা টিম ওয়ার্ক ছিল। এম এ খায়ের, কিউ এম জামান, দত্তদা, চিত্ত বাবু, শামসুল হক, সত্য সাহা এতগুলি মানুষ নিয়ে কী বিশাল একটা চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আজকে টাকা পয়সা, সময়, মানুষজন অনেক বেড়েছে, অথচ উন্নতি হয়নি। ছোট্ট বলয়েই এতগুলো মেধা তখন কাজ করেছিল।‘

জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত সহ বহু গুণী শিল্পীকেই কালের গর্ভে বিলীন হতে দেখেছে বাংলাদেশ। তবুও নিজ অবস্থান থেকে দমে যাননি সাগর নয়না এই নায়িকা। সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন শেষ দিন পর্যন্ত। বিশ্বাস করতেন সৃষ্টিতে, শূন্যতা যেমন তাঁকে আপ্লুত করতো তেমনি নবোদ্যমে অগ্রসর হতেও প্রেরণা যোগাত।

আজীবন ছাত্রের জীবন পালন করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রের গুণধর শিল্পীদের সাথে কাজ করে শেখার পাশাপাশি নিজের সন্তানদের সান্নিধ্যেও শিখেছেন অনেক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে খান আতাউর রহমান। বয়সের ব্যবধানকে তোয়াক্কা না করে প্রগাঢ় করেছিলেন বন্ধুত্ব। কোন কোন সময় রাজ্জাকের চাইতেও বেশি খান আতার শূন্যতা টের পেতেন কবরী।

মৃত্যু আর স্মৃতি প্রসঙ্গে মতিউর রহমানকে বলেছিলেন ‘মানুষের জীবনে অনেকগুলো দরজা থাকে। তার মধ্যে মৃত্যু হলো শেষ দরজা। মৃত্যুর কথা মনে হলে আমার চোখ জলেতে ভরে যায়। কবরী আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, সামান্য একটু কথা বলতেও নয়। সবাইকে ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যেতে হবে, ভাবলেই ভয় লাগে। তাই মৃত্যুর আগপর্যন্ত মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। যত দিন বাঁচব, মানুষের কাছে আপন হয়ে থাকতে চাই, মানুষের কাছাকাছি থাকতে চাই। আরও কিছু উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।‘

বাঙালি হারালো অতুলনীয়া এক গুণী প্রাণকে; Photo: BFA
বাঙালি হারালো অতুলনীয়া এক গুণী প্রাণকে; Photo: BFA

লিখেছেন- সারাহ তামান্না 

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী কবরীর উল্লেখযোগ্য একটি সাক্ষাৎকার