“এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি। রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি” ভাবসম্প্রসারণটি ব্যাখ্যা করার আগে জানিয়ে দেই, এই বিখ্যাত উক্তিটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই বিঘা জমি কবিতার অংশ এই লাইনটি।
ভাবসম্প্রসারণঃ এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি। রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মূলভাবঃ কথায় আছে মানুষের চাওয়া পাওয়ার কোন শেষ নেই। যার যত ধন সম্পদ আছে সে আরো বেশি বিত্তশালী হতে চায়। আর মানুষের এই সম্পদ লাভের তীব্র আকাঙ্খা থেকে একসময় সৃষ্টি হয় লোভের৷ বিত্তবানদের লোভের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে দরিদ্র শ্রেণির উপর। এরিক ফর্ম বলেছেন –
“লোভ হলো এক অতল গহব্বর যা কোন ব্যক্তিকে কখনো সন্তুষ্ট না করেই প্রয়োজন মেটাতে অন্তহীন প্রয়াসে ক্লান্ত করে তোলে৷”
সম্প্রসারিত ভাবঃ কথায় আছে, জীবন পুষ্পশয্যা নয়। জীবন অনেকটা যুদ্ধের মত। এটি এমন এক যুদ্ধ যা আজীবন চলতে থাকে। সুন্দরভাবে জীবন নির্বাহ করতে হলে সব মানুষকেই পরিশ্রম করতে হয়৷ জীবন ধারণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু হচ্ছে অর্থ। সুন্দর জীবন নির্বাহ করতে হলে অর্থের কোন বিকল্প নেই। কিন্ত আমাদের সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি আছে যারা অর্থের নেশায় মত্ত হয়ে নিজেদের নীতিবোধ বিসর্জন দেয়। এই ধরণের ব্যক্তির চিন্তা জুড়ে শুধু থাকে শুধুমাত্র অর্থ। অর্থের জন্য এরা যেকোন অপরাধ করতে পিছপা হয় না৷ সমাজের দরিদ্র, অসহায়, দুস্থদের অর্থ আত্মসাৎ করতে এরা কুন্ঠিত হয় না। কারণ এই ধরনের লোভী মানুষের শিরায় শিরায় থাকে অর্থের লোভ৷
বর্তমানে প্রায় সময় শোনা যায় বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকটের কথা। আর এই সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী থাকে একদল অসাধু ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীরা অর্থের জন্যই পণ্যের সংকট তৈরি করে। তাদের বোধগম্য হয় না যে তাদের এই অর্থের লোভের কারণে অনেক পরিবারকে অনাহারে দিন কাটাতে হয়৷ খাবারের অভাবে পুরো পরিবারের আত্মহত্যা আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়৷ আর এসবের জন্য দায়ী কিছু ব্যক্তির অসততা ও লোভ। অর্থের মোহে এরা এতটাই মগ্ন থাকে যে এদের বিবেকবোধ, ভালো-মন্দ বিচারের জ্ঞান নষ্ট হয়ে যায়।
মানুষ হিসেবে ধনী হওয়ার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেকবান মানুষ হওয়া। যখন কেউ লোভের বিনিময়ে মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দেয় তখন বুঝে নিতে হবে সে নিজের গর্ত নিজেই খুঁড়ে রাখছে। একদিন এই লোভ নামের গর্তে সে নিজেই পতিত হবে আর তা থেকে মুক্তির কোন পথ খোলা থাকবে না৷ দুর্নীতিতে আমাদের দেশের অবস্থান সর্বদা প্রথম সারিতেই থাকে। আর এর জন্য দায়ী থাকে দেশের কিছু লোভী দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি। প্রচুর প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও এদের অর্থের চাহিদা কখনো পূরণ হয় না৷ ফলে তাদের এই চাহিদা নিবারণের জন্য তারা বেছে নেয় দুর্নীতির পথ। অবৈধ পথে উপার্জনের হাজার হাজার কোটি টাকা এরা বিদেশে পাচার করে দেয়। অন্যদিকে, দেশের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষদের বেশ নাজুকভাবে দিন কাটাতে হয়৷
অতি লোভী মানুষেরা তাদের অর্থের ক্ষুধা নিবারণের জন্য যেকোন অন্যায় করতে রাজী থাকে৷ এমনকি তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে কোন অসহায় মানুষের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিতে পিছপা হয় না। কারণ, এরা যত পায় তত চায়। এদের কখনো অপরের ভালো সহ্য হয় না। এদের মগজে সর্বদা অন্যের ক্ষতির চিন্তা ঘুরপাক খায়। একটা সময় অখণ্ড ভূ-খণ্ডে মহাজনদের বেশ উৎপাত ছিল। এদের প্রচুর প্রাচুর্য থাকার পরেও এদের লোভী দৃষ্টি সর্বদা পড়ে থাকতো সহায় সম্বলহীনদের ভিটেমাটির উপর। ছলে বলে কৌশলে অসহায় দরিদ্র শ্রেণীর সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া ছিল এদের লক্ষ্য। কালের বিবর্তনে মহাজন শব্দটি হারিয়ে গেছে কিন্তু এখনো লোভী শোষক শ্রেণী এ সমাজে ভদ্রতার মুখোশ পড়ে রয়ে গেছে৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ চারপাশের পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই লিখেছেন, “”এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি। রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি”। আরেক মনিষী সক্রেটিস বলেছেন, “যার যা আছে তাতে সে সন্তুষ্ট নয়, সে আরো পেলেও সন্তুষ্ট হবে না।” এটি এ সমাজের কিছু মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। লোভী মানুষ কখনো অল্পতে সন্তুষ্ট হতে পারেনা। আর এ লোভ তাদেরকে একটা সময় পশুতে পরিণত করে৷
মন্তব্যঃ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “ইমান ও লোভ এক অন্তরে একত্র হতে পারে না।” আমা দের সকলের নিজের যেটুকু আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থেকে সৎপথে জীবনধারণ করা।
গুরুত্বপূর্ণ সকল ভাবসম্প্রসারণ-
১। ভাবসম্প্রসারণঃ পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি
৩। ভাবসম্প্রসারণ: কীর্তিমানের মৃত্যু নেই / মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়
৪। ভাবসম্প্রসারণঃ ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ
৫। ভাবসম্প্রসারণঃ দুর্নীতি জাতীয় জীবনে অভিশাপস্বরূপ
৬। ভাবসম্প্রসারণঃ দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য
৭। পরের অনিষ্ট চিন্তা করে যেই জন
৮। ভাবসম্প্রসারণ: সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই
৯। ভাবসম্প্রসারণঃ সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত
১০। ভাবসম্প্রসারনঃ আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে..
১১। ভাবসম্প্রসারণঃ অর্থই অনর্থের মূল
১২। ভাবসম্প্রসারণঃ পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না।
১৩। ভাবসম্প্রসারণঃ গ্রন্থগত বিদ্যা পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন
১৪। ভাবসম্প্রসারণঃ লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু
১৫। ভাবসম্প্রসারণঃ ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল