in

রচনাঃ একটি শীতের সকাল

একটি শীতের সকাল রচনা
একটি শীতের সকাল রচনা

এসএসসি ও এইচএসসি বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষায় একটি শীতের সকাল রচনা প্রায়ই এসে থাকে। যদিও রচনা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নিজের মতো লেখাই ভালো। কিন্তু রচনার পয়েন্ট মাথায় থাকলে রচনা নিজের মতো লিখে ফেলা সহজ হয়। নিম্নে একটি শীতের সকাল রচনাটি ১০ পয়েন্ট সহ তুলে ধরা হলো।

একটি শীতের সকাল

ভূমিকা:

রূপের রাণী বাংলাদেশ, ষড়ঋতুর বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতিটি ঋতুর রয়েছে নিজস্বতা, ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। পৌষ ও মাঘ এই দুই মিলে শীত কাল। শীত মৌসুমের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হল কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকাল। শীতের সকালের কুয়াশা মোড়ানো প্রকৃতি, শিশিরভেজা ঘাস এক নতুন আবরণ সৃষ্টি করে। শীতের সকালে কুয়াশার ঘন চাদর ভেঙে সূর্যের আলো এ পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারে না। শীতের সকালে উষ্ণতার খোঁজে খড় এবং শুকনো পাতায় আগুন জ্বালিয়ে শরীর উষ্ণ করার দৃশ্য বেশ পরিচিত।  কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন:

“শীতের হাওয়া লাগলো নাচন

আমলকীর এই ডালে ডালে

পাতাগুলো শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল

তালে তালে।”

শীতের বৈচিত্র্যময় সকাল:

শীত বছরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঋতু। শীতের সকালে শিশির ভেঁজা ঘাসের উপর হাঁটা আমাদের  স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ উপকারী । শীতের সকালের স্নিগ্ধ বাতাস ছোট বড় সকলের মনে এক অন্য রকম আনন্দের সঞ্চার করে। ধানের শীষের উপরে শিশির বিন্দু যেন শীতের সকালকে আরো বৈচিত্র্যময় করে তোলে। একটি শীতের সকালের হিম শীতল কনকনে হাওয়ার স্পর্শ শরীর ও মনে অনাবিল আনন্দের সৃষ্টি করে। এই সময়ে দিন ছোট হয় এবং রাত দীর্ঘ হয়। কফি এবং চায়ের মতো গরম পানীয় অন্যান্য ঋতুর তুলনায় শীতকালে বেশি উপভোগ্য হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে শীত পছন্দ করি। আমার কাছে শীতকাল মানে স্বাস্থ্যকর তাজা ফলমূল এবং হরেক রকম শাক-সবজি।  তাছাড়া শীতে বাগান ভরে উঠে গোলাপ, ডালিয়াসহ বিভিন্ন রকমের সুন্দর সুন্দর ফুলে। সব ঋতুর নিজস্ব কিছু বৈচিত্র্য থাকে। তবে শীতকালীন বৈচিত্র্য অন্যান্য ঋতু থেকে ভিন্ন। এডিথ সাইডওয়েল  বলেছেন-

“শীতকাল হলো আরামের, ভালো খাবার এবং উষ্ণতার জন্য, বন্ধুত্বপূর্ণ হাতের স্পর্শের জন্য, আগুনের পাশে আলাপ করার সময়, সময়টি একান্তই বাড়ির জন্য।”

শীতের সকাল ও গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য:

একটি শীতের সকালের প্রকৃত আনন্দ গ্রামে উপভোগ করা যায়। পৌষ ও মাঘ এ দুই মাস শীতকালীন মাস। শীতের সকালে গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায়। শীতের সকালে চারদিক ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকা ,উত্তরের ঠান্ডা হাওয়া, নদ-নদীর স্রোতের তীব্রতা হ্রাস পাওয়া ও সকালে পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজে প্রকৃতিকে মনে হয় যেন চঞ্চল এক কিশোরী। একটি শীতের সকাল মানে অদ্ভুত সুন্দর এক নীরবতা। যখন কুয়াশার নিস্তব্ধতায় কোনো পথিক হেঁটে যায় মনে হয় শীতের কনকনে ঠান্ডায় তার শরীর কাঁপছে। একটি শীতের সকালে ভোরবেলা ঘন অন্ধকারের মধ্যে গ্রামে মুয়াজ্জিনের আজানের কন্ঠের ধ্বনি ভেসে আসে।

শীতের সকাল ও গ্রামীণ জনজীবন:

একটি শীতের সকালে ঘোর কুয়াশা ভেদ করে দূর-দূরান্ত থেকে মুসাল্লিরা নামাজ পড়তে আসেন। ঘরের মহিলারা সকালে কুরআন শরীফ পড়েন। গ্রামের মক্তবে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে যান। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সকালের সূর্য স্নান সেরে শঙখ বাজিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা পাঠ করেন। তাদের ছেলে-মেয়েদের গীতাপাঠ ও প্রার্থনারত কন্ঠস্বর বহুদূর থেকে শোনা যায়। কবিগুরুর ভাষায়-

শ্রান্ত হয়েছে দিন,

আলো হয়ে এল ক্ষীণ,

কালো ছায়া পড়ে দিঘি-জলে।

শীত-হাওয়া জেগে ওঠে,

ধেনু ফিরে যায় গোঠে,

বকগুলো কোথা উড়ে চলে।’

গ্রামের কর্মঠ কৃষকরা সকালে পান্তা-ভাত খেয়ে লাঙ্গল নিয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন মাঠে কাজ করতে যায়। এ সময়ে শাক-সবজি উৎপাদন হয় বেশী। শীতের সকালে টিনের চালে, গাছের পাতায়, ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু গুলো যখন মুক্তার মতো চিকচিক করে তখন প্রকৃতি আরো সতেজ হয়ে উঠে। হলুদ সরষে ক্ষেত আর ফুলের বাগান মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়। এ অপরূপ সৌন্দর্য শীতকালীন সময়ে ফুটে উঠে। যখন স্নিগ্ধ ভোরের আলো ঝিলমিল করে, তখন কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্যের আলো উঁকি দেয়। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন-

“পৌষের প্রবল শীত সুখী যেজন।

তুলি পাড়ি আছারি শীতের নিবারণ ॥

ফুল্লরার কত আছে কর্মের বিপাক।

মাঘ মাসে কাননে তুলিতে নাহি শাক ॥’

শীতের সকাল ও  পিঠা:

শীতের সকালের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে শীতকালীন হরেক রকমের পিঠা। পিঠা ছাড়া যেন শীতের সকাল অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পরিবারের সকলের সাথে পিঠা ভাগাভাগি করে খাওয়া যেন শীতের সকালকে আরো আনন্দঘন করে তোলে। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে  শীতের সকাল মানে রসালো চিতই পিঠা, শুকনো চিতই পিঠা, খোলাঝারি পিঠা, ভাপা পিঠা, মিষ্টি পিঠা, খেজুরের রসের সাথে পায়েস (যাকে গ্রামের ভাষায় শিন্নি বলা হয়)। আর শীত মানে টাটকা খেজুরের রস। এছাড়াও বিভিন্ন রকমের পিঠা ঘরে বানানো হয়। কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন:

“পৌষ-পার্বণে পিঠা খেতে বসে

বিষম খেয়ে

আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের

বকুনি পেয়ে।”

শীতের সকালে শহরের জীবনব্যবস্থা:

যান্ত্রিক ব্যস্ত শহরের শীতকালীন সকাল একটু ভিন্ন। অন্যান্য ঋতুর চেয়ে শীতের বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য সকালে শহরবাসীর কাছে বেশ উপভোগ্য। শহরবাসীর কাছে একটি শীতের সকাল মানে কাকের ডাক, যানবাহনের শব্দ ও মানুষের কোলাহল মিশ্রিত ককর্শ আওয়াজ। শীতের দিনে শহরবাসীরা অনেকক্ষণ পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে। শহরের শীতের সকাল মানে শিশির ভেঁজা রাস্তা। গ্রামের শিশির ভেঁজা ঘাসের ছোঁয়া তাদের কাছে কেবলই স্বপ্ন। শীতের সকালের কুয়াশা, সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় শহরবাসীর মনে খুব একটা আনন্দের সঞ্চার করে না কারণ তারা বাঁধা থাকে ব্যস্ততার বেড়াজালে। কোট, সোয়েটার, মাফলার, চাদর, ক্যাপসহ বিভিন্ন আরামদায়ক পোশাক জড়িয়ে শীতের সকালকে শহরবাসীরা বরণ করে নেন। সব মিলিয়ে, শীতের সকাল যান্ত্রিক শহরের চেনারূপে নতুন মাত্রা যোগ করে।

শীতকালীন সময়ে ভ্রমণ:

শীত মানে ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে ব্যাগ গুছিয়ে ভ্রমণের জন্য বেড়িয়ে পড়া। শীতকালের শুষ্ক এবং সতেজ প্রকৃতি ভ্রমণের পিপাসা বাড়িয়ে দেয়। দেশীয় পর্যটক ছাড়াও এ সময় দেশে প্রচুর বিদেশী পর্যটকের সমাগম ঘটে। কক্সবাজার, টেকনাফ, সুন্দরবন, কুয়াকাটা, পাহাড়পুর, রাঙামাটি, বান্দরবান, তেতুলিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত জায়গাসমূহ বরাবরই পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে থাকে। শীতকালীন সময়ের ভ্রমণ একই সাথে আরাম ও আনন্দায়ক।

শীতকালীন অসুবিধা:

সাধারণত একটি শীতের সকাল ধনী ব্যক্তিদের জন্য আরামদায়ক। তারা নিজেদের গরম  চাদরের নীচে ঢেকে রাখে।তবে শীতের সময় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে শীত মানে গরম কাপড়ের অভাব আর ঠান্ডাজনিত রোগের সাথে লড়াই করা। গৃহহীন মানুষদের এসময় শীতের তীব্রতাকে সাথে নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হয়। প্রচন্ড ঠান্ডায় মৃত্যুর খবর প্রায়ই খবরের কাগজে উঁকি দেয়।

শীতকালে অনেক জমিতে চাষাবাদ সম্ভব হয় না। ফলে কৃষকদের অনাহারে দিন কাটাতে হয়। এ সময় অনেক গবাদি পশু অসুস্থ হয়ে মারা যায়। শীতের সকালের প্রকৃত রূপ দারিদ্রতার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। কবির ভাষায়:

“হে সূর্য

তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে

উত্তাপ আর আলো দাও।”

যানবাহন চলাচলের অসুবিধা:

শীতকালে রাত ও সকাল বেশিভাগ সময় কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে। দেখলে মনে হয় যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন। অনেক সময় এই ঘন কুয়াশার কারণে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। শীতকালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাও বেড়ে যায়। কুয়াশার কারণে রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় অনেক ক্ষেত্রে সামনের গাড়ি দেখা যায় না বা এর দূরত্ব আঁচ করা যায় না। তাই শীতের কুয়াশাকে সড়ক দূর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। কুয়াশায় নদী পথেও চলাচলের সময়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়। কুয়াশার কারণে লঞ্চ-স্টীমার ও ফেরি চলাচলের বিঘ্নতা নতুন কিছু না। যাত্রীদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

শীত ও চর্মরোগ:

শীতে ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, ত্বকে গুটি গুটি দানা দেখা যাওয়া, ভিটামিনের অভাবে ঠোঁটের কোণে ঘা বা জিহ্বায় ঘা হওয়ার মত বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই দেখা দেয়৷ শীতে ইনফ্যানটাইল একজিমা, চিলব্রেন নামক চর্মরোগের প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যায়। অনেকে এ ধরনের চর্মরোগকে গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে এই রোগসমূহ জটিল আকার ধারণ করতে পারে।

উপসংহার:

একটি শীতের সকালের হিম শীতল হাওয়া, শিশির ফোঁটা প্রকৃতিকে শিল্পীর আঁকা ছবির মতই মোহনীয় করে তোলে। এই ছবিতে নতুন মাত্রা যোগ করে শীতের সকালের মিষ্টি রোদ। শীতের সকাল কারো জন্য সুখকর আবার কারো জন্য অপ্রীতিকর। একটি শীতের সকালের নিজস্ব বৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্য রয়েছে। কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথে শীতের সকালের সকালের কুয়াশাকে সূর্য গ্রাস করে নেয়। শীতের সকালের কুয়াশা ঘড়ির টিকটিক শব্দের সাথে মিলিয়ে গেলেও তার রেশ রয়ে যায় বহুক্ষণ। সূর্য উঁকি দেওয়ার সাথে সাথে কুয়াশারা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তারপর শুরু হয় মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্ম। ক্রমবর্ধমান সূর্য ও শীতের তীব্রতাকে সাথী করে শুরু হয় চেনা কর্মজীবন। সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে যান। ভালো-খারাপ সব মিলিয়ে শিশির ভেজা এই শীতের সকাল আমাদের হৃদয়ের ভালো লাগার এক অন্যরকম অনুভূতি। কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন:

“এসেছে শীত গাহিতে গীত বসন্তেরি জয়,

যুগের পরে যুগান্তরে মরণ করে লয়।”

আরও পড়ুন- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রচনা (২০ পয়েন্ট)

আরও পড়ুন- চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান / চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান

আরও পড়ুন- বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তাঁর প্রতিকার

আরও পড়ুন- রচনাঃ কৃষি কাজে বিজ্ঞান

আরও পড়ুন- শ্রমের মর্যাদা রচনা (১৮ পয়েন্ট)

আরও পড়ুন- মায়া সভ্যতা বা মায়ান সাম্রাজ্যের ইতিহাস