উন্নয়নশীল দেশ বলতে কি বোঝায় ও উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার শর্ত/ বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই লেখায় আলোচনা করা হয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশ
বিশ্বের উন্নত ও অনুন্নত দেশসমূহের মধ্যপর্যায়ে আরেক ধরনের দেশ আছে- যেগুলোকে বলা হয় উন্নয়নশীল দেশ। এসব দেশে মাথাপিছু প্রকৃত আয় উন্নত দেশসমূহের তুলনায় অনেক কম। উন্নয়নশীল দেশসমূহে অনুন্নত অর্থনীতির অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কৃষি খাতের প্রাধান্য, শিল্প খাতের অনগ্রসরতা, ব্যাপক বেকারত্ব, পরিবহন, যোগাযোগ ও বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা, শিক্ষার নিম্নহার, মূলধন গঠন ও বিনিয়োগের নিম্নহার, নিম্ন মাথাপিছু আয় ও দারিদ্র্য, জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার ইত্যাদি।
তবে অনুন্নত দেশসমূহের সাথে এ দেশগুলোর পার্থক্য এই যে, এসব দেশ পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনসংখ্যাকে ব্যবহার করে মোট জাতীয় উৎপাদন তথা মাথাপিছু প্রকৃত আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর ফলে দীর্ঘ সময় ধরে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির একটি প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে।
পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় এসব দেশ আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন ও দেশের দ্রুত শিল্পায়ন করার প্রচেষ্টা নেয়। ফলে পুঁজিগঠন ও বিনিয়োগের হার বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দেয়। জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো হয় এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এইসব উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ফলে অর্থনীতিতে বিরাজমান উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়।
উন্নয়নশীল দেশের বৈশিষ্ট্য
উন্নয়নশীল দেশসমূহের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিম্নে আলোচনা করা হলো।
১। অর্থনৈতিক অবস্থা বিষয়ে সচেতনতা ও পরিকল্পিত উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণঃ উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছে সেসব দেশ যারা নিজেদের অর্থনীতির উন্নয়নের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়ে তা পরিবর্তনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই পদক্ষেপের সূচনা হয় সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে। উন্নয়নশীল দেশসমূহে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে নানারকম বাধাবিঘ্ন থাকে। বস্তুত জনসংখ্যাধিক্য ও সম্পদের স্বল্পতার কারণে পরিকল্পিত কর্মসূচি ছাড়া উন্নয়ন অর্জন করা যায় না।
২। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাপ্যতা ও উন্নয়নের সম্ভাবনাঃ উন্নয়নশীল দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন- ভূমি, খনিজসম্পদ, পানিসম্পদ প্রভৃতি রয়েছে। জনসংখ্যার আয়তনও বড়। এসব প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
৩। কৃষির ওপর নির্ভরতা হ্রাস ও দ্রুত শিল্পায়নঃ কৃষিপ্রধান অবস্থা থেকে ক্রমশ শিল্পপ্রধান দেশে পরিণত হওয়ার ধারা উন্নয়নশীল দেশের লক্ষণ। এ উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে মৌলিক শিল্পস্থাপন ও শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
৪। কৃষির ক্রমোন্নতিঃ উন্নয়নশীল দেশসমূহে কৃষির আধুনিকায়ন করা হয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, কৃষির অবকাঠামো উন্নয়ন, উন্নতমানের বীজ, সার ও সেচসুবিধা সরবরাহ ইত্যাদির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ফলে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ে। কৃষিতে ক্রমোন্নতির সূচনা হয়।
৫। অবকাঠামো উন্নয়নঃ কৃষি ও শিল্পের প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় বিধায় উন্নয়নশীল দেশে আর্থ- সামাজিক অবকাঠামোর উন্নয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাই এসব দেশে উন্নয়ন শুরুর পর্যায়েই অর্থনৈতিক অবকাঠামো, যেমন- পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, মূলধন গঠন ও সরবরাহ এবং সামাজিক অবকাঠামো, যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই উন্নয়ন অর্জনের ধারায় ক্রমশ সামাজিক পরিবেশেরও উন্নতি ঘটে।
৬। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস ও মানবসম্পদ উন্নয়নঃ উন্নয়নশীল দেশে জনসংখ্যাধিক্য রয়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধীরে হলেও ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। দেশের জনগোষ্ঠীকে জনশক্তি বা মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য সাক্ষরতা প্রকল্প গ্রহণ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের বিস্তার এবং প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এছাড়া স্বাস্থ্যসুবিধা ও সেবার সম্প্রসারণ ঘটে। এসব কারণে জনগণ মানবসম্পদে রুপান্তরিত হয়। তাদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
৭। বেকারত্ব হ্রাস ও দারিদ্র্য বিমোচনঃ উন্নয়নশীল দেশেও ব্যাপক বেকারত্ব বিদ্যমান। তবে কৃষিতে আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ ও দ্রুত শিল্পায়ন এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্বের হার কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। সাধারণত উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় নানারকম প্রকল্পের মাধ্যমে বেকারত্ব হ্রাস করার ও দারিদ্র্য নিরসনের ব্যবস্থা করা হয়।
৮। বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা হ্রাসঃ উন্নয়নশীল দেশসমূহে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর অর্থ ও মূলধনের প্রয়োজন হয়। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পর্যাপ্ত তহবিল সংগ্রহ করা সম্ভব না হওয়ায় এসব দেশ বিদেশি ঋণ, সাহায্য ও অনুদানের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ নির্ভরশীলতা সাধারণত দীর্ঘদিন চলতে থাকে। তবে উন্নয়ন অর্জনের এক পর্যায়ে এ নির্ভরতা কমে আসে।
৯। জনগণের আর্থিক কল্যাণ নিশ্চিত করাঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল লক্ষ্য সকল জনগণের সর্বাধিক আর্থিক ও সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে আয়ের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে পারলে আর্থিক ও সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত হয়। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহে আর্থ- সামাজিক উন্নয়ন সূচিত হলেও বণ্টন ব্যবস্থায় ত্রুটি দীর্ঘ সময় থেকে যায়। ফলে আয় বণ্টনে বৈষম্য প্রলম্বিত হয়।
১০। নগরায়নের হার বৃদ্ধিঃ উন্নয়নশীল দেশসমূহে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে একটি ক্রমোন্নতির ধারা সৃষ্টি হয়। কোন কোন দেশে এ ধারা খুব বেগবান। কোন কোন দেশে ততটা নয়। তবে এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে ক্রমশ গ্রামীণ অর্থনীতির আধুনিকায়ন ও অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটে। শিল্পায়নের ফলে কাজের সন্ধানে গ্রাম থেকে জনগণ শহরমুখী হয়। এসব কিছুর ফলে দেশে নগরায়ন ঘটে।
১১। সামাজিক পরিবেশের উন্নয়নঃ উন্নয়নশীল দেশসমূহে ধীরগতিতে হলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন ব্যবস্থা, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান (যেমন- ব্যাংক ও বিমা), আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ইত্যাদি উন্নত ও সম্প্রসারিত হয়। এর ফলে কুসংস্কার ও গোঁড়ামি দূর হয়। উন্নত জীবনযাত্রার সাথে পরিচিত হওয়ার ফলে মানুষ উন্নয়ন অর্জনে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
১২। মাথাপিছু আয় ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধিঃ উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি প্রধানত পরিকল্পনার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তা বাস্তবায়নের ফলে উন্নতির একটি প্রবণতা সৃষ্টি হয়। ফলে এসব দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। জীবনযাত্রার মানে উন্নয়ন সূচিত হয়।
আরও পড়ুন- উন্নত দেশ কাকে বলে? উন্নত দেশের বৈশিষ্ট্য