ইউনিয়ন পরিষদ বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন স্থানীয় প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশপূর্ব আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির অগ্রযাত্রা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, গ্রাম এলাকায় জনপ্রতিনিধিত্বমূলক স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এটি কাজ করছে। ব্রিটিশ আমলে গ্রাম এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা করার জন্য চৌকিদারি পঞ্চায়েত আইন ১৮৭০ প্রবর্তিত হয়। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গ্রামে শান্তি- শৃঙ্খলা রক্ষা ও বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনা করার জন্য এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ১৮৮৫ সালে স্থানীয় পর্যায়ে অধিক দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গীয় স্থানীয় আইন পাস হয়। এই আইনে ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন কমিটি, মহকুমা পর্যায়ে মহকুমা বোর্ড ও জেলা পর্যায়ে জেলা বোর্ড গঠন করা হয়। ১৯১৯ সালের পল্লী আইনে চৌকিদারি পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন কমিটি বিলুপ্ত করে ইউনিয়ন বোর্ড নামে একটিমাত্র স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
পাকিস্তান আমলে এর নাম হয় ইউনিয়ন কাউন্সিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ, থানা পরিষদ ও জেলা পরিষদ- এই তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৯৭ সালে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) সংশোধিত আইনের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ গঠনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। সাধারণত গড়ে ১০-১৫টি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত। ইউনিয়ন পরিষদে একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান, নয় জন নির্বাচিত সাধারণ সদস্য ও তিন জন নির্বাচিত মহিলা সদস্য (সংরক্ষিত আসনে) থাকবেন। পূর্বে একটি ইউনিয়ন তিনটি ওয়ার্ডে বিভক্ত ছিল। সংশোধিত আইনে ওয়ার্ড সংখ্যা ৯টিতে উন্নীত করা হয়েছে। প্রত্যেক ওয়ার্ড থেকে একজন করে মোট নয়জন সাধারণ সদস্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। প্রতি ৩ ওয়ার্ডে একজন মহিলা সদস্য পুরুষ ও মহিলা সকলের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। ইউনিয়ন পরিষদের কার্যকাল ৫ বছর। বাংলাদেশে সর্বমোট ৪,৫৫৪টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ একটি সক্রিয় স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান- উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন।
ইউনিয়ন পরিষদের কাজ নিম্নে তুলে ধরা হলো-
ইউনিয়ন পরিষদের কার্যাবলী
ইউনিয়ন পরিষদের কার্যাবলিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথাঃ ১। প্রধান কার্যাবলি ও ২। ঐচ্ছিক কার্যাবলি।
প্রধান কার্যাবলি
১। জনশৃঙ্খলা রক্ষাঃ গ্রামে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ইউনিয়ন পরিষদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে কিছু চৌকিদার ও দফাদার নিয়োগ করা; অপরাধ, বিশৃঙ্খলা ও চোরাচালান বন্ধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ; ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিরসনে ভূমিকা পালন; গ্রাম আদালত সম্পর্কিত দায়িত্ব সম্পাদন; পারিবারিক বিরোধের আপোস-মীমাংসা উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ইউনিয়ন পরিষদ পালন করে থাকে।
২। জনকল্যাণমূলক কাজ ও সেবাঃ ইউনিয়নে অবস্থিত কৃষি, স্বাস্থ্য, মৎস্য, পশুপালন ও শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সংস্থার সেবা ও কার্যক্রম জনগণকে অবহিতকরণ এবং গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্থার কর্মসূচীর অধীনে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, স্যানিটেশন, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন, আত্মকর্মসংস্থান ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা ইউনিয়ন পরিষদের প্রধানতম কার্যাবলির মধ্যে পড়ে।
৩। স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নঃ এলাকার কৃষি উন্নয়নের জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, গ্রামীণ শিল্পের উন্নয়ন সাধন, বাজার সৃষ্টি, মৎস্য চাষ ও পশু পালনের উন্নত পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিতকরণ, উন্নত বীজ, চারা ও সার বিতরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা, জনগণের আয় বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমে পরামর্শ প্রদান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাঁধ নির্মাণ প্রভৃতি কাজ ইউনিয়ন পরিষদ সম্পাদন করে।
৪। প্রশাসনিক কাজঃ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব, গ্রাম পুলিশ ও পরিষদের অন্যান্য কর্মচারীদের পরিচালনা, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করা, সকল সভা আহ্বান, বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রণয়ন ও প্রেরণ করা, কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালন ইত্যাদিও ইউনিয়ন পরিষদ করে থাকে।
ঐচ্ছিক কার্যাবলি
জনপথ ও রাজপথের ব্যবস্থা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা; বিধবা, এতিম, গরিব ও দুস্থ ব্যক্তিদের সাহায্যকরণ; প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে ব্যবস্থাকরণ; প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার তদারকি এবং ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া; পরিবেশ সংরক্ষণ ও বনায়ন; ইউনিয়নের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, পাঠাগার স্থাপন, উদ্যান ও খেলার মাঠের ব্যবস্থা, গণসংযোগ; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকার্য সম্পাদন; দুস্থ ব্যক্তির তালিকা প্রণয়ন; সকল প্রকার শুমারি পরিচালনার দায়িত্ব পালন; সরকারি সম্পত্তি, যেমন- সড়ক, সেতু, খাল, বাঁধ, টেলিফোন ও বিদ্যুৎ লাইন রক্ষণাবেক্ষণ, পল্লি বিদ্যুতায়নের উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি ইউনিয়ন পরিষদের ঐচ্ছিক কাজের অন্তর্গত।
আরও পড়ুন- জাতীয় সংসদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি