in

আয়নাবাজি থেকে প্রযোজকের আয় মাত্র ১২ লাখ!

আয়নাবাজির আয়
আয়নাবাজির আয়

২০১৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মুক্তি পায় অমিতাভ রেজা চৌধুরীর প্রথম চলচ্চিত্র আয়নাবাজি। একুশ শতকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র হাতে গোনা মাত্র যে কটি হিট সিনেমার মুখ দেখেছে তার মধ্যে আয়নাবাজি অন্যতম। সারা দুনিয়াব্যাপী স্বীকৃত আইএমডিবি’তে আয়নাবাজিই একমাত্র বাংলা সিনেমা যার রেটিং কিনা ৯.১!  আয়নাবাজির কল্যাণেই অনেক বছর পর টিকিটের জন্য দর্শকদের হাহাকার করতে দেখা গেছে। সিনেমা হলের সামনে দর্শকদের লম্বা লাইন দেখা গেছে। কিন্তু এত বড় সাফল্যের পরেও কিনা আয়নাবাজি লস প্রজেক্ট!!! প্রিয় পাঠক, ভুল পড়েন নি। পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী অভিমানের সুরে তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এমনটিই জানিয়েছেন।

অমিতাভ জানিয়েছেন, ৩০ সেপ্টেম্বর আয়নাবাজি মুক্তির দিন পর্যন্ত সব মিলিয়ে প্রযোজকের পকেট থেকে খরচ হয়েছে ২ কোটি ৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু নির্মাণ খরচই ছিল ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। বাকি ৪৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে সিনেমার প্রচারণা, সিনেমার হলে প্রোজেক্টর মেশিন ভাড়া দিতে। এছাড়া সিনেমাটি মুক্তির পর কলাকুশলীদের নিয়ে প্রচারণা, পোষ্টার ছাপানো, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচারণা চালানো সব মিলিয়ে আরও খরচ হয়েছে ২৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ এই সিনেমাটির জন্য প্রযোজককে সর্বমোট গুনতে হয়েছে ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

এত টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে প্রযোজক ঘরে তুলেছেন মাত্র ২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। লাভের অঙ্কে যেটি মাত্র ১২ লাখ!!! আয়নাবাজি মুক্তির পর বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ থেকে জানা যায় আয়নাবাজিকে ঘিরে কোন কোন সিনেমা হল দিনে লাখ টাকার বেশিও ব্যবসা করেছে। তাহলে সিনেমা হলে দর্শকদের উপচে ভরা ভিড়, কয়েকদিন অপেক্ষা করে টিকিট জোগাড় করা দর্শকদের টাকা কার পকেটে গেল?

অমিতাভ বলেন, তারা এখনো সিনেমা হলের মালিকদের থেকে ৬০-৭০ লাখ টাকা পাবেন। কিন্তু হল মালিকরা সেই টাকা তাদের দেবেন না! কেন দেবে না? হল মালিকেরা আয়নাবাজি টিমকে প্রকাশ্যে জানিয়েছে, তারা গত ১৫ বছর সিনেমায় ব্যবসা করতে পারে নি। আয়নাবাজির মাধ্যমে তারা যে ব্যবসা করেছে সে টাকায় তারা বাথরুম ঠিক করেছে, কেউ টাইলস ঠিক করেছে। হল মালিকেরা সাফ জানিয়েছে, আয়নাবাজি টিম আরেকটি ভালো ছবি দিলে ওরা টাকাটা ফেরত দিতে পারবে, না হলে পারবে না।

এতটুকু পড়ে যেকোন পাঠকই ভাবতে পারেন, এ কি মগের মুল্লুক নাকি! এটিও বাস্তবে সম্ভব? প্রিয় পাঠক, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে এমনটাই সম্ভব।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প আজ এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। যেখানে এক সময় ১৬০০টির মতো সিনেমা হল ছিল, সেখানে এখন সারা দেশে সব মিলিয়ে প্রায় ২০০ সিনেমা হল কেবল টিকে আছে। এফডিসি কেন্দ্রিক ছবিগুলো হলে দর্শক আনতে ব্যর্থ হওয়ায় হল মালিকদের সামনে হল বন্ধ করে দেয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। বাংলাদেশের সিনেমার বাজার এখন এমন একটা অবস্থায় দাঁড়িয়ে যে, দুই-তিন কোটি টাকা দিয়ে ছবি বানিয়ে সেটি থেকে লাভের মুখ দেখা প্রায় অসম্ভব। ঝামেলা শুধু এখানেই শেষ নয়! গোদের উপর বিষ ফোড়া হিসেবে আছে আরও অনেক অব্যবস্থাপনা। হলের টিকিট বিক্রির কোন স্বচ্ছ হিসেব নেই। ভালো মানের প্রজেক্টর নেই। মফস্বলের সিনেমা হলে নেই ভালো সাউন্ড সিস্টেম।

বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত শ্রেণী অনেক আগেই সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়েছে। মনপুরা, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, চোরাবালি, দেবী ঢাকা অ্যাটাকের মতো সিনেমা হলে দর্শকদের কিছুটা ফিরিয়েছিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে হলের ব্যবস্থাপনা ঠিক না করলে বছরে ১-২টি ভালো সিনেমা দিয়ে কিছু যায় আসবে না। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যেন এক চোরাবালিতে ডুবে আছে। নিম্নমানের চলচ্চিত্রের কারণে হল মালিকরা ব্যবসা করতে পারেন নাই। হল বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন আবার হল কমে যাওয়ায় বড় বাজেটের ছবি করে লাভের মুখ দেখা অনেক ঝুকির ব্যাপার।

উল্লেখ্য, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী আয়নাবাজির মোট আয় প্রায় ৫ কোটি টাকা। এছাড়া মেরিল-প্রথম আলো ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেও ছিল আয়নাবাজির জয়জয়কার। ১৯-তম মেরিল-প্রথম আলো পুরষ্কার আয়োজনে ২০১৬ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত করা হয় আয়নাবাজিকে। এছাড়া শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে অমিতাভ রেজা চৌধুরী, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে মাসুমা রহমান নাবিলা ও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতা (সমালোচক) হিসেবে চঞ্চল চৌধুরী মেরিল-প্রথম আলো পুরষ্কার জেতেন।

৪১তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মোট ৭টি শাখায় পুরস্কৃত হোন আয়নাবাজির কলাকুশলীরা। শ্রেষ্ঠ পরিচালক শাখায় অমিতাভ রেজা চৌধুরী, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা শাখায় চঞ্চল চৌধুরী, শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার শাখায় যৌথভাবে অনম বিশ্বাস ও গাউসুল আলম শাওন, শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক শাখায় রাশেদ জামান, শ্রেষ্ঠ চিত্রসম্পাদক শাখায় ইকবাল আহসানুল কবির, শ্রেষ্ঠ শব্দ গ্রাহক শাখায় রিপন নাথ, শ্রেষ্ঠ পোশাক ও সাজসজ্জা শাখায় যৌথভাবে সাত্তার ও ফারজানা সান বিজয়ী হোন।