আমাদের গ্রাম রচনাটি ক্লাস ৬, ৭, ৮, ৯ এর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা। শহরে বসবাস করা অনেক শিক্ষার্থীদের নিজ চোখে গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগই হয় না। কিন্তু যারা গ্রামে গেছে, গ্রাম দেখেছে তাঁরা খুবই সহজে আমাদের গ্রাম রচনাটি নিজেই লিখে ফেলতে পারবে।
আমাদের গ্রাম রচনা
ভূমিকাঃ
“তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়” – জসীমউদ্দিন
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ। আর এই সৌন্দর্য্যের প্রধান বাহক আমাদের দেশের অনিন্দ্য সুন্দর গ্রামগুলো। কবির কবিতার প্রতিটি চরণ যেন আমাদের গ্রামের অপরূপ শোভার জীবন্ত এক প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের মোট গ্রামের সংখ্যা হলো ৮৭,৩১৯টি। গ্রামের শ্যামল ছায়া, পাখিদের গান, চারপাশের সবুজ রূপ দেখে এখনো আমাদের মন অজান্তে গেয়ে ওঠে-
“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে
পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে
আমার জন্মভূমি”।
আমার গ্রামঃ আমার গ্রামের নাম আমিরাবাদ। এটি চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলার অন্তর্গত। আমার গ্রামের মোট আয়তন ৪,৩৬১ একর (১৭.৬৫ বর্গ কিলোমিটার)। উপজেলা সদর থেকে আমিরাবাদ ইউনিয়নের দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার। আমাদের গ্রামের মধ্য দিয়ে টংকাবতী নদী ও পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ডলু নদী বয়ে চলেছে।
গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যঃ
“ছোট্ট হলেও গ্রামটা মোদের সকল গ্রামের সেরা,
সোনা দিয়ে তৈরী এ গ্রাম
মায়া-মমতায় ঘেরা!
সবুজ ঘাসেতে ভরা মাঠ-ঘাট
দেখতে লাগে বেশ,
গ্রাম-বাংলার রূপ যে কভু
দেখা হয়না শেষ!”- গ্রাম-বাংলার স্মৃতি
(সৈয়দ শরীফ)
আমাদের গ্রামখানি যেন সৃষ্টিকর্তা নিজের মনের মত করে গড়েছেন। চারপাশের সারি সারি সবুজ মাঠ, পুকুর, চাষীদের মাঠে চাষ, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, গ্রামের দুরন্ত কিশোরদের দস্যিপনা সব মিলিয়ে আমাদের গ্রামটি যেন শিল্পীর নিঁখুত হাতে আঁকা অপূর্ব এক ছবি৷ বর্ষায় পুকুরের জলের টুপটাপ শব্দে মন হারিয়ে যায় একটি অচিন ভুবনে। আবার শীতে আমার গ্রাম যেন চাদরে ঢাকা নববধূ। সব মিলিয়ে অপরূপ রূপের সম্ভার আমার ছোট্ট গ্রাম।
গ্রামের জনসংখ্যাঃ আমাদের গ্রামে প্রায় ১০ হাজার লোকের বসবাস। এর মধ্যে ইসলাম ধর্মাবলম্বী ৭০% ও অন্য ধর্মাবলম্বী ৩০%। আমাদের গ্রামটি লোহাগাড়া উপজেলার উত্তরাংশে অবস্থিত। আমাদের গ্রামে ২টি মসজিদ ও একটি মন্দির রয়েছে৷ মাস্টার হাট এবং নতুন বাজার আমাদের গ্রামের প্রধান দুটি হাট। আমাদের গ্রামের যোগাযোগের প্রধান সড়ক হল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক।
আমার গ্রাম ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিঃ আমার গ্রামে সকল ধর্মের মানুষের বসবাস৷ এই সম্প্রীতি বহুবছরের। এই গ্রামের সকলেই অন্য ধর্মের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিতে আঘাত লাগে তেমন কার্যকলাপ ও মন্তব্য থেকে সর্বদা বিরত থাকে। সকলেই সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমার গ্রামে ঈদের চাঁদ দেখে যেমন সকলেই আনন্দে মেতে উঠে, তেমনি পূজাতেও ঢাকের আওয়াজে সকলের মনে আনন্দের সঞ্চার হয়। আমার গ্রামের সম্প্রীতি আমায় বারংবার কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত সে কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়ঃ
“মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান।
মুসলিম তার নয়ণ-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ॥
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান॥”
অর্থনৈতিক অবস্থানঃ গ্রামের বেশিরভাগ লোক এখনো কৃষি নির্ভর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে৷ কৃষিকাজ, মৎস্য চাষ এখানো এই গ্রামের অধিবাসীদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস৷ তবে, দেশের উন্নয়নের হাওয়া আমার গ্রামেও এসে লেগেছে৷ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে অনেকে স্বল্প পু্ঁজি দিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করেছে৷ অনেকে আবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছে৷ তাছাড়া, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিদেশ যাওয়ার জন্য সরকারিভাবে বিনামূল্যে যেসব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন অনেক তরূণেরা সে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে ভিনদেশে।
গ্রামের শিক্ষার হারঃ আমাদের গ্রামের অনেকেই এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এর প্রধান কারণ হচ্ছে দারিদ্রতা। সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেন, “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।” আমার গ্রামের শিক্ষার হার মাত্র ৫৭%। আমাদের গ্রামে ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি উচ্চ বিদ্যালয় ও ১টি মাদ্রাসা রয়েছে। বাল্যবিবাহ, কুস্ংস্কারের কারণে আমাদের গ্রামের অনেক মেয়েরা এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তবে, বর্তমানে শিক্ষিত তরুণেরা গ্রামবাসীর মাঝে শিক্ষার সচেতনতা তৈরির ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। গ্রামের বিত্তশালীরা যদি এগিয়ে আসে তবে আমাদের গ্রাম একদিন নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে।
এম. এফ মুঞ্জাযের বলেছেন-
“সম্পদ কোনোদিনই দারিদ্রতা নিরসন করতে পারে না। দারিদ্রতা নিরসনের জন্য দরকার শিক্ষা।”
গ্রামের উন্নয়ন ও তরুণ সমাজঃ
“প্রাণ-চঞ্চল প্রাচীর তরুণ, কর্মবীর,
হে মানবতার প্রতীক গর্ব উচ্চশির।
দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, তোরা দৃপ্তপদ
সকলের আগে চলিবি পারায়ে গিরি ও নদ,
মরু-সঞ্চর গতি-চপল।
অগ্র পথিক রে পাঁওদল,
জোর কদম চল রে চল।।”- কাজী নজরুল ইসলাম
কথায় আছে, একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি সে দেশের তরুণসমাজ৷ আমাদের গ্রামের সার্বিক উন্নয়নে তরুণ সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইদানীং, অনেক শিক্ষিত যুবকেরা চাকরির আশায় বসে না থেকে বিভিন্ন জাতের ফসল উৎপাদন, মৎস্য চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এতে গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে অনেক গ্রামবাসীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। সামাজিক কর্মকাণ্ডেও তরুণ সমাজ পিছিয়ে নেই। বিভিন্ন ক্লাব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীদের বই পড়া সহ অনেক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলছে৷।
গ্রামের সামাজিক উৎসবঃ আমাদের গ্রামের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য হচ্ছে বহুবছরের প্রচলিত বিভিন্ন সামাজিক উৎসব সমূহ। আমাদের গ্রামে এখনো প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে মেলা বসার প্রচলন রয়েছে। তাছাড়া, পিঠা উৎসব, নৌকা বাইচ, ঘুড়ি উৎসব, শীতের রাতে বাড়ির উঠোনে পালা গান, কীর্তন আমাদের গ্রামের সংস্কৃতির অংশ৷ আমাদের গ্রামের উৎসব আমাকে একটি বিখ্যাত উক্তিটি মনে করিয়ে দেয়-
“একটি সংস্কৃতির মহত্ত্ব প্রকাশ পায় তার উৎসবের মাধ্যমে।”
গ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থাঃ আমাদের গ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো গ্রাম্য ডাক্তারের উপর নির্ভরশীল। যারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল তারা সদরে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারলেও যাদের সামর্থ্য নেই তাদের শেষ ভরসা ঐ পল্লী চিকিৎসক। একসময় ঔষুধের জন্যও সদরে ছুটে যেতে হতো। তবে, বর্তমানে গ্রাম্যহাটে দুই একটা ফার্মেসি রয়েছে। গ্রামে যে ছোট ক্লিনিক রয়েছে সেখানে প্রসূতি মায়ের সেবা ও জ্বর কাশির চিকিৎসা ছাড়া আর তেমন কোন স্বাস্থ্য সেবা মেলেনা।
গ্রামের একাল-সেকালঃ এক সময় আমাদের গ্রাম ছিল ধানে -মৎসে ভরা। আর এ পরিপূর্ণতার প্রধান শিল্পী ছিল কৃষকেরা। অনেকটা কবির কবিতার মত-
“সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।
দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিল বড়?
পুণ্য অত হবে নাক সব করিলে জড়।
মুক্তিকামী মহাসাধক মুক্ত করে দেশ,
সবারই সে অন্ন জোগায় নাইক গর্ব লেশ।”
-রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণী
কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে গোলা। এখন ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গা শুধু গল্পেই সীমাবদ্ধ। দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে কৃষকদের বাঁচতে হয়৷ তাঁতী, কামারেরা পূর্ব পুরুষের পেশা ছেড়ে দুমুঠো অন্নের জন্য বেছে নিয়েছে দিনমজুরি। আগে ছিল গ্রাম অন্ধকারাচ্চন্ন। এখনো ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। গ্রামের মেঠো পথের রূপ পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে পিচঢালা পথ৷
গ্রামের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিঃ আমাদের গ্রামে অনেক গুণী মানুষেরা জন্মেছেন। এ গ্রামের ধুলো কণা মেখে তাদের বড় হওয়া। তারা এখনো এ গ্রামবাসীদের অনুপ্রেরণা। মরেও তারা অমর । আমার গ্রামের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ হচ্ছে-
নওয়াজিস খান –– মধ্যযুগের কবি।
মেজর নাজমুল হক –– সেক্টর কমান্ডার, ৭নং সেক্টর, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ।
স. উ. ম. আবদুস সামাদ –– রাজনীতিবিদ।
ফতেহ আলী ওয়াসি – সুফি সাধক, ইসলাম প্রচারক ও ফার্সি ভাষার কবি৷
উপসংহারঃ আমার গ্রামের মাটি, হাওয়া, পুকুর সব কিছুর সাথে আমার আত্নার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক আত্মিক। মা আমাদের কাছে যেমন প্রিয় তেমনি প্রিয় আমাদের গ্রাম। এই নাড়ির টান অস্বীকার করা সাধ্য কারোর নেই। কবির সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই,
আমাদের ছোটো গ্রাম মায়ের সমান,
আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।
মাঠভরা ধান আর জলভরা দিঘী,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আমগাছ জামগাছ বাঁশ ঝাড় যেন,
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।
সকালে সোনার রবি পূব দিকে ওঠে
পাখি ডাকে, বায়ু বয়, নানা ফুল ফোটে।
-বন্দে আলী মিঞা
আরও পড়ুন- অন্যান্য রচনা।