in

আইন কাকে বলে? আইনের বৈশিষ্ট্য, আইনের উৎস

সুশাসনের জন্য আইনের প্রয়োজনীয়তা

আইন কাকে বলে? আইনের বৈশিষ্ট্য, আইনের উৎস
আইন কাকে বলে? আইনের বৈশিষ্ট্য, আইনের উৎস

সাধারণভাবে আইন বলতে সামাজিকভাবে স্বীকৃত লিখিত ও অলিখিত বিধিবিধান ও রীতিনীতিকে বোঝায়। মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অধিকাংশ মানুষই এ নিয়ম-কানুনসমূহ মেনে চলে। সুতরাং আইন হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের নিয়ম-কানুন, রীতিনীতি বা বিধিবিধান। এ অর্থে আইন মূলত দুই ধরনের- সামাজিক আইন ও রাষ্ট্রীয় আইন। সামাজিক জীবনে যে সকল বিধিবিধান বা রীতিনীতি মানুষ মেনে চলে তা হচ্ছে সামাজিক আইন। আর রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালার পরিপ্রেক্ষিতে এবং মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে কিংবা সমাজে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধে সর্বজনীনভাবে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশই রাষ্ট্রীয় আইন নামে পরিগণিত। বিভিন্ন রাজনৈতিক তত্ববিদ ও আইনবিশারদগণ আইনের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।

টি. এইচ. গ্রীন বলেছেন, ‘রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত অধিকার এবং বাধ্যবাধকতাসমূহ আইন’। অধ্যাপক হল্যান্ডের মতে, “আইন হচ্ছে মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের কতগুলো সাধারণ নিয়ম যা সার্বভৌম রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক প্রণীত হয়”। আইনের একটি উৎকৃষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করেছেন উড্রো উইলসন। তিনি বলেন, “আইন হলো সমাজের সেইসকল প্রতিষ্ঠিত প্রথা ও রীতিনীতি যেগুলো সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং যা সরকারের অধিকার ও ক্ষমতার দ্বারা বলবৎ করা হয়।”

সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং মানুষের সামাজিক কল্যাণের জন্য গৃহীত সুনির্দিষ্ট নিয়মের সমষ্টিকেই আইন বলে।

আইনের বৈশিষ্ট্য

উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে আইনের যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় তা নিম্নরূপ:

১। আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণ ও ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে।

২। আইন হচ্ছে সর্বজনীন, তা সমভাবে রাষ্ট্রের সকলের জন্যই প্রযোজ্য হবে।

৩। আইন হচ্ছে একধরনের আদেশ বা নিষেধ, যা সকলকেই মান্য করতে হয়। যারা আইন অমান্য করে তাদের সাজা পেতে হয়।

৪। আইন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বমূলক হতে স্বীকৃত এবং আরোপিত।

৫। আইন হলো সমাজে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতি।

আইনের উৎস

আইনের বিভিন্ন উৎস রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হল্যান্ড আইনের ৬টি প্রধান উৎসের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলোঃ ১। প্রথা, ২। ধর্ম, ৩। বিচার সংক্রান্ত রায়, ৪। বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা, ৫। ন্যায়বোধ, ৬। আইনসভা।

১। প্রথাঃ প্রথা হলো আইনের সবচেয়ে প্রাচীনতম উৎস। সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি, আচার-আচরণ ও অভ্যাসই হচ্ছে সামাজিক প্রথা। এ সকল সামাজিক প্রথার আবেদন এতই বেশি যে, এগুলো অমান্য করলে সংঘাত ও বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়। কালক্রমে এসব প্রচলিত প্রথা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়ে আইনে পরিণত হয়েছে। যেমন- ব্রিটেনের অধিকাংশ আইনই এসেছে প্রথা থেকে।

২। ধর্মঃ মানুষের ওপর ধর্মের প্রভাব অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ঐশ্বরিক আইন অনুসরণ করে আসছে। তাই ধর্ম, ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মগ্রন্থ আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য ইত্যাদি মূল্যবোধ ধর্ম চিহ্নিত করেছে বলে প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় রীতিনীতি প্রভাব বিস্তার করে। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় বিধানই রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে বিবেচিত হয়। ইসলামিক রাষ্ট্রের আইন প্রধানত কুরআন ও শরিয়ার ওপর নির্ভরশীল। হিন্দু আইনও মূলত হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ, যেমন- বেদ, গীতা, রামায়ণ প্রভৃতির ওপর নির্ভরশীল। বর্তমান যুগেও ধর্মীয় রীতিনীতি আইনরূপে গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় আইন প্রবর্তন করা হয়। বিবাহ, উত্তরাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্মীয় আইন মেনে চলে।

৩। বিচার সংক্রান্তঃ বিচারকের রায় অথবা বিচার বিভাগীয় রায়ও আইনের একটি উৎস। বিচারকালে বিচারক যদি প্রচলিত আইনের মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হন তখন তিনি নিজের বুদ্ধি, মেধা ও প্রজ্ঞার সাহায্যে প্রচলিত আইনের সাথে সঙ্গতি রেখে আইনের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে বিচারের রায় প্রদান করেন। এটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে যায় এবং এক সময় আইনে পরিণত হয়। তাই দেখা যায়, বিচারকের রায়ও আইনের একটি উৎস।

৪। ন্যায়বোধঃ বিচারক যখন প্রচলিত আইনের মাধ্যমে কিংবা উপযুক্ত আইনের অভাবে ন্যায়বিধান করতে ব্যর্থ হন তখন নিজের সামাজিক নীতিবোধের আলোকে ন্যায্য রায় প্রদান করেন। এরূপ নীতিবোধ দ্বারা প্রণীত আইন দেশের আইনের মর্যাদা লাভ করে। তাই ন্যায়নীতি ও ন্যায়পরায়ণতা আইনের একটি প্রকৃষ্ট উৎস।

৫। আইনসভাঃ আধুনিক রাষ্ট্রে আইনসভাই আইনের প্রধান উৎস। সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরই আইনসভা বা আইন পরিষদ আছে। এ আইনসভায় দেশের জনগণের স্বার্থকে লক্ষ্য রেখে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও সংশোধন হয়ে থাকে।

এছাড়াও রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও রাষ্ট্র প্রধানের জারিকৃত প্রশাসনিক ডিক্রি, বৈদেশিক চুক্তি, আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশনের রেটিফিকেশনও আইন হিসেবে গৃহীত হয়।

সুশাসনের জন্য আইনের প্রয়োজনীয়তা

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইনের অনুশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রে আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সকল নাগরিক সমানভাবে স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে। কেউ কারও অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে পারে না। সাধারণভাবে আইনের অনুশাসন দুটি ধারণা প্রকাশ করে, যথাঃ আইনের প্রাধান্য ও আইনের দৃষ্টিতে সকলের সাম্য।

আইনের প্রাধান্য বজায় থাকলে সরকার স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করতে সচরাচর সাহস করে না। বিনা অপরাধে কাউকে গ্রেফতার করা, বিনা বিচারে কাউকে আটক রাখা ও শাস্তি দেয়া প্রভৃতি আইনের প্রাধান্যের পরিপন্থি। আইনের প্রাধান্য নাগরিক স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। সমাজে আইনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে কেউ আইন অমান্য করে অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সরকারও কারও ব্যক্তিস্বাধীনতায় অযৌক্তিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সাহস পাবে না।

আইনের দৃষ্টিতে সাম্য বলতে বুঝায় সমাজে ধনী-দরিদ্র, সবল-দূর্বল, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলেই সমান। আইনের চখে কেউ বাড়তি সুবিধা পাবে না। সকলের জন্য একই আইন প্রযোজ্য। রাষ্ট্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা তখনই খর্ব হয় যখন আইনের অনুশাসন থাকে না। আইনের শাসনের অভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অনেক সময় নাগরিকদের হয়রানি করে বা বিনা অপরাধে আটক করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি না হলে আইনের শাসন কায়েম হয় না। বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন- রাষ্ট্র কাকে বলে? রাষ্ট্রের উপাদান কয়টি?