যা শিখবে- অভিবাসন কি? অভিবাসন কত প্রকার? অভিবাসনের কারণ, অভিবাসনের প্রকারভেদ, অভিবাসনের সুফল ও কুফল।
অভিবাসন কি?
গ্রামের ছেলে শিহাব। স্থানীয় একটি কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করার পর চাকরির আশায় ভীড় জমিয়েছে ঢাকায়। চাকরি হওয়ার পর সে ঠিক করলো গ্রাম থেকে বাবা-মাকে নিয়ে এসে এখন থেকে তারা ঢাকায় থাকবে। শিহাবের মত জীবন ধারণের প্রয়োজনে বহু লোককে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করতে হয়। স্থায়ী বসবাসের উদ্দেশ্য কেউ গ্রাম থেকে শহরে, কেউ শহর থেকে অন্য শহরে আবার এক দেশ থেকে অন্য দেশে অভিগমন করে৷ মানুষের এই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন ও সেখানে বসবাস করাকে অভিবাসন বলে।
সাধারণ কর্মের মজুরি, পণ্যের মূল্য, চাষ পদ্ধতি, বাজার ব্যবস্থা, শহর বা গ্রামীণ উন্নয়ন, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন প্রভৃতি অভিবাসনকে প্রভাবিত করে। শুধু জন্মহার বা মৃত্যুহার বা অভিবাসন দিয়ে কোন দেশের প্রকৃত জনসংখ্যার হ্রাস বা বৃদ্ধি পরিমাপ করা যায় না। জনসংখ্যার সঠিক তথ্য বুঝতে হলে এই তিনটি বিষয়কেই সমানভাবে পর্যালোচনা করা আবশ্যক। অভিবাসনের ফলেঃ
১. বাস্তুত্যাগীদের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
২. গ্রামে ও শহরে কোথাও জনসংখ্যা কমে আবার কোথাও বাড়ে৷
৩. জনসংখ্যার কাঠামোগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
অভিবাসনের প্রকারভেদ
অভিবাসন দুই প্রকার। প্রকৃতি অনুযায়ী অভিবাসনকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ
১. অবাধ অভিবাসন
২. বলপূর্বক অভিবাসন
অবাধ অভিবাসন (Voluntary migration): ধরুন, আপনি স্বেচ্ছায় বাসস্থান ত্যাগ করে আপনার পছন্দসই নতুন কোন স্থানে বসবাস শুরু করলেন। নিজের ইচ্ছায় বাসস্থান ত্যাগ করে পছন্দসই কোন স্থানে বসবাস করাকে বলা হয় অবাধ অভিবাসন।
বলপূর্বক অভিবাসন (Forces migration): ধরুন, আপনি কোন একটি স্থানে বসবাস করছেন। কিন্তু স্থানীয় কিছু লোক আপনার উপর চাপ সৃষ্টি করছে সে স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র গমনের জন্য। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক চাপের মুখে বা পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ সৃষ্টির ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে যে অভিগমন করে তাকে বলা হয় বলপূর্বক অভিবাসন। গৃহযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক বৈষম্য বা যুদ্ধের কারণে কেউ যদি অভিগমন করে তবে তাকে বলপূর্বক অভিবাসন বলে।
বলপূর্বক অভিবাসনের ফলে যে সমস্ত ব্যক্তি কোন স্থানে আগমন করে এবং সেখানে স্থায়ীভাবে আবাস স্থাপন করে তাদেরকে উদবাস্তু (Refugee) বলে। যারা সাময়িকভাবে বসবাস করে ও সুযোগমত স্বদেশপ্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় থাকে তাদের শরণার্থী বলে।
অনেকে নিজ দেশের অভ্যন্তরে বসবাসের স্থান পরিবর্তন করে। কেউ কেউ গ্রাম থেকে শহরে আসে। আবার কেউ কেউ শহর থেকে অন্য শহরে অভিগমন করে। আবার অনেকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে গমন করে। স্থানভেদে অভিগমনকে দুইভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ
১. রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ (Internal)
২. আন্তর্জাতিক (International)।
অভিবাসনের কারণ
কোন ব্যক্তি প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে অভিগমন করতে পারে৷ বাংলাদেশের বহু মানুষ পৃথিবীর বহু দেশে গমন করেছে৷ কিছু কারণ রয়েছে যেগুলো মানুষকে পুরনো স্থান ত্যাগ করে নতুন স্থানে বসতি স্থাপনের জন্য উৎসাহিত বা প্ররোচিত করে সে সমস্ত কারণকে বলা হয় গন্তব্যস্থলের টান বা আকর্ষণমূলক কারণ (Pull factors)। কিছু কারণ রয়েছে যেগুলো মানুষকে পুরনো স্থান ত্যাগ করে নতুন স্থানে গমন করতে বাধ্য করে৷ সেগুলোকে বলা হয় উৎসস্থলের ধাক্কা বা বিকর্ষণমূলক কারণ (Push factors)। অভিবাসনের কারণ সমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
আকর্ষণমূলক কারণঃ
১. আত্মীয়স্বজন ও নিজ গোষ্ঠীভুক্ত জনগণের নৈকট্য লাভ।
২. কর্মসংস্থান ও অধিকতর আর্থিক সুযোগ সুবিধা।
৩. শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তাগত সুবিধা।
৪. বিশেষ দক্ষতার চাহিদা ও বাজারের সুবিধা।
৫. বিবাহ ও সম্পত্তির প্রাপ্তিমূলক ব্যক্তিগত সুবিধা।
বিকর্ষণমূলক কারণঃ
১. প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতি।
২. জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যা।
৩. সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্য।
৪. অর্থনৈতিক মন্দা।
৫. ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্রমাগত ক্ষয়ক্ষতি।
অভিবাসনের সুফল ও কুফল
জনসংখ্যা বন্টন বা অবস্থানিক পরিবর্তনকে অভিবাসনের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ বস্তুত, বিশ্বের জনসংখ্যা বন্টনের তারতম্য আনায়নের ক্ষেত্রে অভিবাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ অবস্থানগত পরিবর্তন ছাড়াও অভিবাসনের ফলে বিভিন্ন এলাকার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও জন্মবৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন সাধিত হয়। নিম্নে অভিবাসনের সুফল ও কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
অর্থনৈতিক ফলাফল
সিংহভাগ মানুষ অভিগমন করে উন্নত জীবন ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের আশায়। অভিবাসনের ফলে ব্যক্তি জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় পরিবর্তিত হতে পারে৷ যেমনঃ
- উৎস ও গন্তব্যস্থলে ভূমি ও সম্পত্তির শরিকানা।
- মজুরির হার।
- বেকারত্ব।
- জীবনযাত্রার মান।
- বাণিজ্যিক লেনদেনের ভারসাম্য।
- অর্থনৈতিক উৎপাদন ও উন্নয়ন ধারা৷
আবার নিরক্ষর বা স্বঅল্পশিক্ষিত লোকের জন্য অভিবাসন বিপদজনক হতে পারে৷ কারণ সে হয়তো লোকমুখে বা কোন অসৎ লোকের মুখের কথায় প্ররোচিত হয়ে অন্য দেশে গমন করতে পারে। এক্ষেত্রে, সে যে দেশে গমন করেছে সে দেশের আইনী জটিলতার দূর্ভোগ তাকে হয়তো পোহাতে হতে পারে৷ এতে করে তার নিজের কোন অর্থনৈতিক উন্নতি হবেইনা সাথে অন্য দেশে নিজ দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে৷ বলপূর্বক অভিবাসনে উদবাস্তুদের অর্থনৈতিক সুবিধার চেয়ে দুর্ভোগ বেশি পোহাতে হয়।
সামাজিক ফলাফল
সমাজের উপর অভিবাসন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। অভিবাসনের ফলেঃ
- সামাজিক আচার-আচরণের আদান-প্রদান হয়।
- সামাজিক অনেক রীতিনীতি একদেশ থেকে অন্যদেশে স্থানান্তরিত হয়।
- বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণের মধ্যে ভাব, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান হয়।
- গ্রাম ও শহর এলাকার মধ্যে পার্থক্য কমে আসে।
- জনগণের গুণগত পরিবর্তন সম্ভব হয়৷
তবে অভিবাসনের সবচেয়ে বড় নেতিবাচক দিক হচ্ছে এর ফলে অনেক সময় রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। কোভিড-১৯ এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তাছাড়া অধিকভাবে অন্য সংস্কৃতি রপ্ত করার কারণে নিজ দেশ বা সমাজের সামাজিক বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ণ হয়।
জনবৈশিষ্ট্যগত ফলাফল
অভিবাসন কোন দেশ বা অঞ্চলের জনবসতির উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। যেমনঃ
- উৎসস্থলে জনসংখ্যা কমে।
- গন্তব্যস্থলে মোট জনসংখ্যা পরিবর্তিত হয়।
- শিক্ষিত, যুবক, পেশাজীবি অভিবাসন করলে গন্তব্যস্থলে জনসংখ্যার কাঠামোগত পরিবর্তন হয়।
- নারী-পুরুষ অনুপাত ও নির্ভরশীলতার অনুপাতের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।
- মেধাবীরা দেশ ত্যাগ করলে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়৷
- কোন দেশের জনসংখ্যা কম থাকলে সে দেশ অন্য দেশ থেকে দক্ষ জনসংখ্যা নিয়ে নিজ দেশের জনসংখ্যার ভারসাম্য আনতে পারে৷
- উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে দক্ষ জনশক্তি পাঠিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে৷
সরকারি নীতিঃ ২০১২ সালের জনসংখ্যা নীতি রূপরেখায় মা ও শিশুর উন্নত স্বাস্থ্য, পরিবার কল্যাণ ও উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করার প্রয়াস দেওয়া হয়েছে। পরিবারের আকার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমকে সার্বিক সামাজিক পুনর্গঠন ও জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অত্যাবশ্যক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আরও পড়ুন- মানব বসতি কাকে বলে? বসতির শ্রেণী বিভাগ। বসতি স্থাপনের নিয়ামকগুলো কি কি?
আরও পড়ুন- জনসংখ্যার ঘনত্ব কাকে বলে? জনসংখ্যার ঘনত্ব নির্ণয়ের সূত্র