অধ্যবসায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা। ক্লাস ৬ থেকে শুরু করে ক্লাস ৯-১০ অবধি বাংলা পরীক্ষায় বারবার ঘুরেফিরে এই রচনাটি আসে। নিম্নে ১৩ পয়েন্টের অধ্যবসায় রচনা শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে তুলে ধরা হলো।
অধ্যবসায়
ভূমিকাঃ
পারিব না এ কথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার
পাঁচ জনে পারে যাহা
তুমিও পারিবে তাহা
পার কি না পার কর যতন আবার
একবারে না পারিলে দেখ শতবার
উপরোক্ত লাইনগুলো লিখেছেন কবি কালি প্রসন্ন ঘোষ। কোনো একটা কাজে একবারে সফল না হলে বারবার চেষ্টা করার অপর নাম অধ্যবসায়। অধ্যবসায় মানুষের মানবীয় গুণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটা গুণ। জীবনের প্রতিটি ধাপে অধ্যাবসায় একান্ত প্রয়োজন। অধ্যবসায়ী না হলে জীবনের কোনো ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া অসম্ভব। জীবনে চলার পথে বাধা আসবেই। এতে ভয় না পেয়ে সেই বাধা উতরে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে যে সামনে এগুতে পারে সে-ই জীবনে উন্নতি লাভ করে।
অধ্যবসায় কীঃ অধ্যবসায় শব্দের আভিধানিক অর্থ অবিরাম সাধনা বা ক্রমাগত চেষ্টা। কোনো কাজে সফলতা লাভের জন্য বারবার চেষ্টা করা আর ধৈর্য্য ধরার নামই হলো অধ্যবসায়। অধ্যবসায় হলো মানব জীবনের সফলতার অন্যতম হাতিয়ার। কোনো একটি কাজে প্রথমবারে বিফল হলে পুনরায় সেই কাজে চেষ্টা করা এবং কয়েকবার পরাজিত হওয়ার পরও সেই কাজে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, ধৈর্য্য ধরা, দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সেই কাজটাকে সফল করাই হলো অধ্যবসায়। অধ্যবসায়ের জন্য অসীম ধৈর্য্য, দৃঢ় মনোবল আর অপরিসীম পরিশ্রমের প্রয়োজন।
অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তাঃ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আসতে পারে নানান প্রতিবন্ধকতা। সেই প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যেতে পারলে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে না পারলে জীবনে কখনোই সফলতা আসবে না। জীবনের সকল বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করতে পারলেই মানুষ জীবনে উন্নতি লাভ করতে পারে। প্রবল ইচ্ছে শক্তি, একনিষ্ঠ পরিশ্রম আর সাহস নিয়ে সমস্ত বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করার নামই অধ্যবসায়। মানব সন্তান হিসেবে ভূমিষ্ট হলেই তাকে প্রকৃত মানুষ বলা যায় না। মানবিক গুণাবলি অর্জনের মধ্যে দিয়ে একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে হয়। আল্লাহ প্রতিটা মানুষকে কম বেশি নানান গুণ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের ভিতরে এসব গুণাবলী সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এ সুপ্ত গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে অধ্যবসায় অনিবার্য। জীবনের সকল বাধা অতিক্রম করা মানুষের পক্ষে একদিনে সম্ভব হয়নি। এর জন্য মানুষকে বহুদিন ধরে অধ্যবসায়ী হতে হয়েছে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের অধ্যবসায় আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে আধুনিক সভ্যতার দিকে, আমাদের জীবনে এসেছে সুখের সমারোহ। অধ্যবসায়ের গুণে পৃথিবীতে অনেক মানুষ স্মরণীয় হয়ে আছেন। অদম্য আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় মনোবল নিয়ে জীবনের সমস্ত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে তাঁরা সফল হয়েছেন।
অধ্যবসায়ের গুরুত্বঃ মানবসভ্যতার বিকাশের অন্যতম চালিকাশক্তি অধ্যবসায়। আদিম মানুষ মাটিতে, পানিতে, আকাশে বৈরীশক্তিকে মোকাবেলা করে নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় সফল হয়েছিল অধ্যবসায়ের কারণে। অনাবাদি জমিতে আবাদ করে ফসল ফলানো, জলাভূমি ভরাট করে নগর গড়ে তোলা, মরুভুমিকে বসবাসযোগ্য করে তোলা- সবই অধ্যবসায়ের ফলাফল। আদিম গুহাচারী মানুষ আজ মহাশূন্যে পাড়ি জমিয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-দর্শন, চিকিৎসা-শিল্পকলা ইত্যাদি প্রতিটি শাখায় মানুষের যে অভাবনীয় সাফল্য তার মূলে রয়েছে নিরন্তর সাধনা, উদ্যম, উদ্যোগ আর নিরবিচ্ছিন্ন কর্মপ্রচেষ্টা। বিভিন্ন ধর্মগন্থেও অধ্যবসায়কে একটি চারিত্রিক গুণের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
অধ্যবসায় ও প্রতিভাঃ কিছু মানুষের ধারণা হলো প্রতিভা না থাকলে জীবনে কখনো সফল হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু অধ্যবসায় না থাকলে শুধুমাত্র প্রতিভা দিয়ে বেশি দূর আগানো যায় না। প্রতিভাকে কাজে লাগাতে হলেও কিন্তু পরিশ্রম করতে হয়, চেষ্টা করতে হয়। অধ্যবসায়ের গুণে অনেক মানুষ প্রতিভাবান না হয়েও জীবনে সফলতা লাভ করেছেন। একজন দূর্বল ছাত্রও অধ্যবসায়ী হলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছেন, ‘প্রতিভা বলে কিছুই নেই। পরিশ্রম ও সাধনা করে যাও, তাহলে প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।’ পরিশ্রমী আর অধ্যবসায়ী হলে জীবনের যে কোনো বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে সফল হওয়া সম্ভব, তাই প্রতিভা না থাকলেও একজন মানুষের অধ্যবসায়ী হওয়া উচিত। অধ্যবসায় ছাড়া কারো প্রতিভা কখনো বিকশিত হতে পারে না। অধ্যবসায়ের বলেই মানুষ অসাধ্য সাধন করে। অধ্যবসায়ের কল্যাণেই মানুষ এখন সাগরের অতলগর্ভ, সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, অন্তরীক্ষে বিচরণ করতে শিখেছে।
ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ঃ ছাত্রজীবনে অন্যান্য গুণাবলী অর্জনের সাথে সাথে অধ্যবসায়ী হওয়ার শিক্ষা লাভ করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ ছাত্রজীবনই হলো একজন মানুষের ভবিষ্যত জীবনের মূল ভিত্তি।আলস্যপরায়ণ ও শ্রমবিমুখ ছাত্র কখনো বিদ্যার্জন করতে পারে না। কোনো ছাত্র অল্প মেধাসম্পন্ন হলেও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সফলতা লাভ করতে সক্ষম। অনেক ছাত্র পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে হতাশ হয়ে পড়ে।কিন্তু সাফল্য লাভ করতে হলে হতাশ না হয়ে তাকে দ্বিগুণ উদ্যমে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে হবে। কারণ চেষ্টা করলে তবেই সাফল্য আসবে। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে ছাত্রজীবনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন সম্ভব। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে ‘ Failure is the pillar of success’ জীবনের প্রথম ব্যর্থতাকে সাফল্যের প্রথম সোপান মনে করে এগিয়ে যেতে হবে।
ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ঃ প্রতিটা মানুষের জীবনে অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক। মানুষের জীবনে বিভিন্ন সময় বিপদ আপদ, বাধা বিপত্তি আসবে। সেই বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে সফল হতে হলে অবশ্যই অধ্যবসায় নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। জীবনে লক্ষ্য অর্জেনের জন্য মানুষকে দুর্বার সাহস নিয়ে অগ্রসর হতে হয়। কোনো কাজে মানুষ একবারে সফল হবে এমনটা নাও হতে পারে। প্রথম চেষ্টাতে সফল না হলে যারা ভেঙে পড়ে, হতাশ হয়, তারা বেশি দূর এগুতে পারে না। কোনো কাজে একবারে সফল না হলে, সেই কাজ নতুনভাবে, নতুন উদ্যমে, দৃঢ় মনোবল নিয়ে করতে পারলে সফলতা আসবে নিশ্চিত। জীবনে কোনো কিছু সহজে পাওয়া যায় না। কোনো জিনিস অর্জন করতে হলে বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দিতেই হবে।অধ্যবসায়ী মানুষ নিজের কাজে সফল হতে যে কোনো রকম পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে সক্ষম।অধ্যবসায়ী না হলে জীবনে কখনোই উন্নতি করা সম্ভব নয়। জগতের বড় বড় সব কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সৈনিক সবাই ছিলেন অধ্যবসায়ী। তাই ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ের ভূমিকা অপরিহার্য।
জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্বঃ জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। যে জাতি যত বেশি অধ্যবসায়ী সে জাতি তত বেশি উন্নত। অধ্যবসায়ের কারণে জাপান যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হয়েও বর্তমানে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর একটি। চীনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। গত তিন-চার দশকে চীনের মানুষ নিজেদের দারিদ্র মুক্ত করতে পেরেছে। চীন হয়েছে বিশ্বের অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার। কোন দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে হলে সেই দেশের প্রতিটি নাগরিককে অধ্যবসায়ী হতে হবে নিঃসন্দেহে। অবশ্য ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ের ফল জাতীয় জীবনের বৃহত্তম কল্যাণ নিয়ে আসে। যে কোনো কাজে সফলতা আসে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে, হোক সেটা ব্যক্তিজীবনে বা জাতীয় জীবনে।
অধ্যবসায় হীনের দূরাবস্থাঃ অধ্যবসায়হীন ব্যক্তি জীবনের কোথাও সফলতা পায় না, ফলে সে প্রতিনিয়ত ভাগ্যকে দোষারোপ করে। অধ্যবসায়ী না হলে, পরিশ্রম করে কোনো কাজ না করলে সে কাজে সফলতা আশা করাটা নিছক বোকামি। আমাদের আশে পাশে অনেক মানুষ আছে যারা অলসতার জন্য কোনো কাজ করে না বা কোনো কাজ করলেও সে কাজে মনোযোগী হয় না, সুন্দরভাবে কাজ শেষ করে না, এতে করে সেই কাজের ভালো কোনো ফল পায় না। যে কোনো কাজ মনোযোগী হয়ে, অধ্যবসায়ের সাথে করার চেষ্টা করলে সে কাজে সফল হওয়া যায়। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন, “অসম্ভব শব্দটি কেবল নির্বোধদের অভিধানে পাওয়া যায় “।
অধ্যবসায়ের দৃষ্টান্তঃ জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে সফল হওয়ার মূলমন্ত্র হলো অধ্যবসায়। অধ্যবসায়ী মানুষের জীবনে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। আমাদের সবার প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অধ্যবসায়ের অনন্য দৃষ্টান্ত। কত দুঃখ কষ্ট সয়েছেন মানুষকে ইসলামের পথে দাওয়াত দিতে গিয়ে। মহাকবি ফেরদৌসীর বিখ্যাত মহাকাব্য “শাহনামা” তাঁর সুদীর্ঘ তিরিশ বছরের সাধনার প্রয়াস।
কত শত বিজ্ঞানী তাদের অধ্যবসায়ের মাধ্যমে আজকের বিজ্ঞানকে এতটা উন্নত করে তুলেছেন। বিজ্ঞানের এত এত আবিষ্কার সবই বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল।
মনীষীদের জীবনে অধ্যবসায়ঃ জগতে যারা মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার আদর্শ হয়েছেন তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন অধ্যবসায়ী। মহাকবি ফেরদৌসীর অমর মহাকাব্য “শাহানামা” দীর্ঘ তিরিশ বছরের কাব্যপ্রয়াস। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাশ বিষ বছরের সাধনায় রচনা করে “বাংলা ভাষার অভিধান”। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়াই একক প্রচেষ্টায় প্রায় দু হাজার প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করেন খ্যাতনামা সংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস পরপর ছয়বার ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হলেও হাল ছাড়েন নি। শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিলেন। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটনের পৃথিবী বদলে দেয়া আবিস্কারের মূলে আছে বহু বছরের একনিষ্ঠ সাধনা ও নিরবিচ্ছিন্ন পরিশ্রম।
অধ্যবসায় সাফল্যের মূল চাবিকাঠিঃ মানুষের জীবনে সাফল্য লাভের মূল কারণটা হলো অধ্যবসায়। মানুষ ব্যর্থতাকে উপেক্ষা করে যখন প্রচন্ড মনোবল আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে কোনো কাজ করে তখন তার সাফল্য কেউ ঠেকাতে পারে না। মানুষ যদি ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে তবে সে আর বেশি কিছু করতে পারে না। সাফল্য পেতে হলে মানুষকে ব্যর্থতায় ভেঙে না পড়ে, সেই ব্যর্থতার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে অধ্যবসায়ের সাথে সেই কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। এতে করে সাফল্যের দেখা মিলবে। মনে রাখতে হবে সফল হতে হলে অধ্যবসায়ের বিকল্প কিছু নেই। যে যত বেশি অধ্যবসায়ী, তার সাফল্য তত বেশি।
উপসংহারঃ মানুষের নিজের জীবনকে সুন্দর ভাবে গড়তে হলে অধ্যবসায়ী হওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যাদের জীবনে অধ্যবসায় নেই তাদের জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী না হয়েও অনেক মানুষ পৃথিবীতে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের অধ্যবসায়ের গুণে। ধৈর্য্যশীল ও পরিশ্রমী ব্যক্তিরাই নিজের জীবনে সফলতা লাভ করেন। জীবনে সাফল্য ব্যর্থতা দুটোই আসবে। ব্যর্থতাকে পরাজিত করে সাফল্য পেতে হলে অধ্যবসায়ী হতে হবে।
আরও পড়ুন- অন্যান্য রচনা।