২০০৪ সালে আমজাদ হোসেনের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘অবেলায় অসময়ে’ থেকে প্রথম তৌকির আহমেদের চলচ্চিত্র নির্মাণ; ‘জয়যাত্রা’। তবে ছবির নামের সাথে খুব একটা মিল ছিল না পরিচালক তৌকিরের যাত্রাটা। বরং গাঁটের পয়সা খরচের পর ক্ষতির মুখেই পড়তে হয়েছিল তাঁকে।
এমনকি বারবার চিত্রনাট্য, পরিকল্পনা সত্ত্বেও এগুতে পারেন নি। দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘রূপকথার গল্প’ মুখ থুবড়ে পড়ার পর এক প্রকার নির্বাসিতই করেছিলেন নিজেকে। তবে হাল ছাড়েন নি, ফিরে এসেছেন জেদের বশেই। এমনকি পরিবারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নক্ষত্র বাড়ি রিসোর্ট বানিয়ে আর্কিটেক্টের নিশ্চিত জীবন ছেড়ে নিজেকে পুরোপুরি সঁপেছেন চলচ্চিত্রের দুনিয়ায়।
অভিনেতা, নাট্য নির্দেশক হিসেবে তখন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে খ্যাতি তৌকির আহমেদের। নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমীর চার মাসের ডিপ্লোমা কোর্সে তাক লাগিয়ে দেন। সেখান থেকে প্রেরণা মিললেও তা আসলে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ছবির ক্ষেত্রে কাজে লাগে নি। ফলে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে স্বনামধন্য এই অভিনেতাকেও। এর কারণ অবশ্য গতানুগতিক বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা। ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ কিংবা সাধারণ দর্শকের মাইন্ডসেটকেই আসলে প্রথম চলচ্চিত্রের অসফলতার কারণ হিসেবে মনে করেন তৌকির।
বাংলা চলচ্চিত্রকে দুর্দশা থেকে টেনে তুলবার জন্য যারা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁদেরই একজন তৌকির। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে দুই দশক আশার আলো দেখালেও নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ থেকে পড়তির দিকেই বাংলা চলচ্চিত্রের মান।
পরপর দুই ছবির বাণিজ্যিক ব্যর্থতা আর ‘ফাগুন হাওয়া’র ভাবনা পিছিয়ে দিচ্ছিল তৌকির আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে সকল পরিকল্পনা (প্রযোজক ও বাজারের অভাবে সেই সময় নির্মাণ না করতে পারলেও ২০১৮ সালে মুক্তি পায় সিয়াম- তিশার ‘ফাগুন হাওয়া’)। সেই সময় আকাশ ফুঁড়েই আসে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ (২০০৭) ছবিতে কাজের প্রস্তাব। সেই সাফল্য পরিচালক হিসেবে তৌকিরকে পরিচিতি এনে দেয়। তবে মন-প্রাণ ঢেলে নির্মাণের সন্ধানে ছিল তৌকিরের শিল্পী মন।
‘অজ্ঞাতনামা’র (২০১৬) সাফল্যের গল্পটা বেশ অনাকাঙ্ক্ষিতই। প্রথমে মঞ্চ নাটকের আদলে এর চিত্রনাট্য তৈরি করছিলেন তৌকির। ২০১৩ সালে সেই বইও প্রকাশ পায়। শেষ কালে অবশ্য মঞ্চের সেটের সাথে যুগলবন্দী ঘটেনি। বড়সড় ঝুঁকি নিয়ে ফিল্মি রূপই দিয়ে ফেললেন। এতে যদিও প্রযোজনা সংস্থার বিশেষ একটা সায় ছিল না।
ইমপ্রেস টেলিফিল্মের কাছ থেকে ন্যূনত্বম পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। সেই চ্যালেঞ্জই আরও জেদ ঘনীভূত করেছিল। নিজের ব্যালেন্স থেকে মিলিয়ে মাত্র ৫০ লাখ টাকা হাতে নিয়েই কাজ শুরু করেন। পরীক্ষিত বন্ধু, অভিনেতা শহিদুজ্জামান সেলিম, ফজলুর রহমান বাবু, মোশাররফ করিমদের নিয়ে নেমে পড়েন শ্যুটিংয়ে। মাত্র ১৪ দিনের মধ্যে শেষ করেন অজ্ঞাতনামার চিত্র ধারণ।
মাত্র সাতটি হলের মালিক এই ছবিকে গ্রহণ করেছিল সে সময়। তবে হুট করেই মড়ার উপর খাড়ার ঘা পড়ে। আচমকাই পাইরেটেড কপি বের হয়ে যায় ইউটিউবে। তবে এই ঘটনাই বদলে দেয় ‘অজ্ঞাতনামা’র ভাগ্য। যেখানে হল ছিল দর্শক শূন্য সেখানে ইউটিউবে মাত্র চারদিনে দশ লক্ষ দর্শক দেখে ফেলেন ছবিটি।
সাথে সাথেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় প্রশংসার বন্যায় ভেসে যায় টিম অজ্ঞাতনামা। খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখেন তৌকির। দর্শকের কাছে নিজের সৃষ্টিকে তুলে ধরতে পারার মধ্যেই খুঁজে পান তৃপ্তি।
আলোচনা- সুনামের পাশাপাশি আঠারোটি আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যালের মধ্যে আটটিতে পুরস্কৃত হয় ছবিটি। খরচের খাতাটা ছিল আঁটসাঁট, তাই মন মতো নির্মাণ করতে পারেন নি। এই আফসোসটা আজও তাড়া করে পরিচালক তৌকিরকে।
হালদা নদীর গল্পে আলোড়িত ছিলেন বেশ আগেই। নারীর মাতৃত্ব আর মাছের প্রজনন ক্ষেত্রকে একীভূত করে গল্পটা তুলে আনেন সেলুলয়েডের ফিতায়। ‘হালদা’ও (২০১৭) লাভ করে অকুণ্ঠ প্রশংসা।
ইমদাদুল হক মিলনের সাথে আলোচনায় তৌকির আহমেদের চলচ্চিত্র জীবনের পাশাপাশি উঠে আসে পারিবারিক জীবনের খুঁটিনাটিও। টোনাটুনির সংসারেও থাকে সংঘাত, আর বিপাশা হায়াতের সাথে তো চাঁদের হাট। কেমন হয় ঠোকাঠুকি? একদমই নয়। বেশ সিরিয়াস টোনেই বলেন তিনি। বিপাশার আপন গুণে গুণান্বিত জীবন যেন আরও একরাশ সম্ভাবনাকে উসকে দিয়েছে। দাম্পত্যের বাইরেও তারা একে অপরের সমালোচক।
লিখেছেন- সারাহ তামান্না